
প্রয়াত হলেন জম্মু ও কাশ্মীর, মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক। এই দুই রাজ্য ছাড়াও তিনি রাজ্যপালের দায়িত্ব পালন করেছেন বিহার, গোয়া এবং ওড়িশাতেও। একসময় কেন্দ্রের সুনজরে থাকা এই সত্যপাল মালিকই অবশ্য বিগত কয়েক বছর ধরে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে। সাম্প্রতিক সময়ে বারবার তাঁর প্রশ্নবাণে ফালা ফালা হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন পুলওয়ামা কান্ড নিয়ে, কৃষক আন্দোলন নিয়ে, মণিপুরের হিংসা নিয়ে। আর তাঁর প্রতিটি প্রশ্নেরই নিশানায় ছিল বিজেপি। পাশাপাশি তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়েও। তাঁর মৃত্যুর পর একবার ফিরে দেখা যাক তাঁর সেইসব প্রশ্নবাণ, যা নিয়ে তোলাপাড় হয়েছিল জাতীয় রাজনীতি।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে তাঁর সময়কালেই রাজ্যের তকমা হারায় জম্মু ও কাশ্মীর। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় বিশেষ ক্ষমতা। সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকলেও তিনি কোনও প্রতিবাদ করেননি বলে অভিযোগ তোলে জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই ঘটনার ছ’বছর পর ২০২৫ এর ৫ আগস্টেই প্রয়াত হলেন সত্যপাল মালিক।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার সাক্ষী হয় গোটা দেশ। সেনা বাহিনীর কনভয়ে এক আত্মঘাতী জঙ্গি আইইডি বিস্ফোরণ ঘটলে, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৪০ সিআরপিএফ জওয়ানের। এই ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের গাফিলতিকেই দায়ী করেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন গভর্নর সত্যপাল মালিক। ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল এক অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বিস্ফোরক দাবি করেছিলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নিরাপত্তায় গাফিলতির জন্যই পুলওয়ামায় সৈন্যদের উপর বিধ্বংসী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল এবং এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে নিষেধ করেছিলেন তাঁকে।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘দ্য ওয়ার’-এ বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে পুলওয়ামা কাণ্ড থেকে ৩৭০ ধারা লোপ, বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষ, বিবিসি’র তথ্যচিত্র, রাহুল গান্ধীকে সংসদ থেকে সরানো সহ একাধিক বিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
মালিক দাবি করেন, পুলওয়ামাতে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের বা সিআরপিএফ-এর কনভয়ে আক্রমণ ভারতীয় সিস্টেম এবং বিশেষ করে সিআরপিএফ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের "অযোগ্যতা" এবং "অবহেলার"-ই ফলাফল। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন রাজনাথ সিং।
তাঁর দাবি অনুসারে, সিআরপিএফ তার জওয়ানদের পরিবহনের জন্য একাধিকবার বিমানের দাবি জানিয়েছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তা প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি জওয়ানদের যাওয়ার আগে রুটটি যথাযথভাবে স্যানিটাইজ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
পুলওয়ামাতে হামলার সময় করবেট পার্কে শ্যুটিং করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মালিক জানান, হামলার পরেই এই সমস্ত ত্রুটিগুলির কথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানান তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁকে এই বিষয়ে চুপ থাকতে বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গাফিলতির বিষয়ে কারও সামনে মুখ খুলতে নিষেধ করেন। এরপর এনএসএ অজিত ডোভালকে ফোন করেন মালিক। তিনিও তাঁকে চুপ থাকার পরামর্শ দেন।
মালিক জানিয়েছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী এবং ডোভালের কথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করি যে এই ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানের উপর দোষ চাপিয়ে সরকার ও বিজেপি নির্বাচনী সুবিধা অর্জন করতে চাইছে।''
পুলওয়ামার ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার দিকেও আঙুল তোলেন মালিক। তিনি বলেন, ৩০০ কিলোগ্রাম RDX বিস্ফোরক বহনকারী গাড়িটি পাকিস্তান থেকে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু ১৫ দিন ধরে জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল গাড়িটি। অথচ গোয়েন্দারা কিছুই জানতে পারলো না।
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে মালিক বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, কিছুই জানেন না। উনি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, বাকি সব চুলোয় যাক। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে আমাকে গোয়ার রাজ্যপালের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ বেশ কয়েকটি দুর্নীতি আমি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছিলাম, যেগুলো সরকার মোকাবিলা করার পরিবর্তে উপেক্ষা করতে চেয়েছিল। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনও মাথা ব্যথা নেই। উনি দুর্নীতিকে অপছন্দ করেন না।"
পুলওয়ামা ছাড়াও একাধিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন সত্যপাল মালিক। তিনি জানান, জম্মু কাশ্মীরের গভর্নর থাকাকালীন বিজেপি-আরএসএস নেতা রাম মাধব একটি হাইড্রো-ইলেকট্রিক স্কিম এবং একটি রিলায়েন্স বীমা স্কিমে অনুমোদন দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন। তাঁকে ৩০০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি।
প্রাক্তন গভর্নর স্পষ্ট জানান, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজত্ব অপসারণ করার সিদ্ধান্ত একটি ভুল ছিল এবং অবিলম্বে এটি পুনরুদ্ধার করা উচিত।
অবশ্য শুধু পুলওয়ামা কান্ডই নয়। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরের গভর্নর ছিলেন সত্যপাল মালিক। এই সময়কালে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পাশ করার জন্য, তাঁর কাছে ৩০০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব এসেছিল বলে নিজেই অভিযোগ করেছিলেন সত্যপাল মালিক। এর মধ্যে একটি ছিল কিরু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং অন্যটি রিলায়্যান্স কোম্পানির ইনশিওরেন্স সংক্রান্ত। এই ঘটনায় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সত্যপাল মালিকের বাসবভন সহ দেশের ৩০টি জায়গায় তল্লাশি চালায় সিবিআই। যা নিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে সত্যপাল মালিক লেখেন, 'আমি গত ৩-৪ দিন ধরে অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি আছি। তা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী শাসক সরকারি সংস্থার মাধ্যমে আমার বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। আমার চালক ও সহকারীকেও অকারণে হয়রানি করা হচ্ছে। আমি কৃষকের ছেলে, এসব অভিযানে ভয় পাব না"।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজক্লিকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার আশঙ্কা ক্ষমতার জন্য এঁরা রাম মন্দিরে বিস্ফোরণ করিয়ে দিতে পারে। বিজেপি’র কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করাতে পারে। সেই ক্ষমতা ওঁর (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) আছে। যে পুলওয়ামা করাতে পারে, সে সবকিছুই করাতে পারে। পুলওয়ামার ঘটনার পর যেভাবে উনি আমায় চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে এটাই প্রমাণিত হয়।“
২০২২-এর জানুয়ারিতে প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেন সত্যপাল। তিনি বলেন, "প্রধানমন্ত্রী অহংকারী। কৃষি আইন নিয়ে যখন তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম ৫ মিনিটের কথোপকথনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন তিনি। আমি তাঁকে বললাম ৫০০ জন কৃষক মারা গেছেন। এঁরা সকলেই আমাদের নিজেদের। উনি তখন জিজ্ঞেস করলেন, 'তাঁরা কি আমার জন্য মারা গেছেন?' আমি তাঁকে বলেছি হ্যাঁ আপনার জন্য মারা গেছেন কারণ আপনি দেশের প্রধান।"
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গোয়ার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন সত্যপাল মালিক। তাঁর অভিযোগ ছিল, গোয়া সরকারের সবকিছুতেই দুর্নীতি। তাই তাঁকে বিদায় করা হয়েছিল। লকডাউন পরিস্থিতিতে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাওয়ান্তের রাজ্য পরিচালনা নিয়েও প্রশ্ন তোলে তিনি। পাশাপাশি তিনি দাবি করেন, গোয়ায় একটি নতুন রাজভবন তৈরির বিষয়ে সাওয়ান্ত সরকারের 'অপ্রয়োজনীয়' পরিকল্পনা করেছিল, তিনি যার প্রতিবাদ করেছিলেন।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জয়পুরের বিড়লা অডিটোরিয়ামে তেজা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের কৃষক আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনও পর্যন্ত দেশে এতবড় আন্দোলন আগে কখনও হয়নি। কৃষকদের আন্দোলনে এখনও পর্যন্ত ৬০০ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। যখন কোনো পশু মারা যায়, তখন দিল্লির নেতারা শোকবার্তা পাঠান। কিন্তু ৬০০ কৃষকের মৃত্যুর পরেও দিল্লির নেতাদের থেকে কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি।
ওই বছরেরই আগস্ট মাসে হরিয়ানার কার্নালে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর "নৃশংস" লাঠিচার্জের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টারের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলেছেন তিনি। পুলিশের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া মহকুমা শাসকের বরখাস্তের দাবিও তুলেছেন তিনি।
কার্ণালে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর পুলিশি লাঠিচার্জ প্রসঙ্গে এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সত্যপাল মালিক বলেন, "মনোহর লাল খট্টারের উচিত কৃষকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া... হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের ওপর লাঠিচার্জ করেছেন। আমি শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেছিলাম কৃষকদের ওপর যেন বল প্রয়োগ না করা হয়।"
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন