Opinion: ভোটাধিকারহীনতার পথে বিহার : এই ভোটবন্দি কি সারাদেশের জন্য অশনি সংকেত?

People's Reporter: বিরোধীদের অভিযোগ, স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন আসলে এক সুপরিকল্পিত কৌশল, যা দিয়ে ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপি করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটের ময়দানে সমতা নষ্টের চেষ্টা চলছে।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স - আকাশ
Published on

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আর মাত্র প্রায় চার মাস বাকি, এমন এক সময়ে ২৪শে জুন, ২০২৫-এ জাতীয় নির্বাচন কমিশন (ECI) ঘোষণা করেছে সারাদেশে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (বিশেষ নিবিড় সংশোধনী) কর্মসূচি, যা প্রথমে বিহারে শুরু হবে এবং পরে ধাপে ধাপে গোটা দেশে কার্যকর হবে। প্রথম দেখায় এটি যেন সাধারণ ভোটার তালিকা সংশোধনের মতোই—যেমন প্রতিটি বড় নির্বাচনের আগে যোগ-বিয়োগের প্রক্রিয়া চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এই সংশোধনী প্রক্রিয়ার পদ্ধতি, কার্যকরী দিক, প্রয়োজনীয় নথিপত্র ইত্যাদি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ ও প্রশ্ন উঠে এসেছে।

নাগরিক অধিকার কর্মী, মানবাধিকার সংগঠন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC)-র আশ্চর্যরকম সাদৃশ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ২০১৯-২০২০ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, আসামের NRC এবং সেসময়ের দেশব্যাপী আন্দোলনের স্মৃতি এখনও জনমানসে তাজা। ফলে এই নতুন প্রক্রিয়াকে ঘিরে ভোটারদের এক বড় অংশের মধ্যে প্রবল উদ্বেগ, আশঙ্কা এবং অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এর ফলে ব্যাপকভাবে সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হতে পারে, এমনকি নাগরিকত্ব হারানো ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে সরকারি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা এসেছে দ্রুত নগরায়ন, ঘন ঘন অভিবাসন, প্রথমবার ভোট দিতে চলা নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি, মৃত্যুর তথ্য রিপোর্ট না হওয়া এবং তথাকথিত “বিদেশি অনুপ্রবেশকারী” নিয়ে উদ্বেগ থেকে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, এই স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন আসলে একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যার মাধ্যমে ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপি করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটের ময়দানে সমতা নষ্ট করার চেষ্টা চলছে।

২০১৯ সালের শেষদিকে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ পাশ হওয়ার পর, গোটা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল—JNU থেকে জামিয়া, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলিগড়—প্রায় সমস্ত শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই গণবিক্ষোভের চাপেই কেন্দ্র সরকার আপাতত পিছু হটে সর্বভারতীয় NRC বাস্তবায়নের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু বিজেপি এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের আধার RSS-এর কাছে সর্বভারতীয় NRC এখনও একটি প্রধান আদর্শগত অঙ্গীকার ও আকাঙ্ক্ষা।

ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)

ভারতের সংবিধান প্রণেতারা যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটি ছিল এক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র—যেখানে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেন এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের সরকার নির্বাচন করবেন। গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত গড়ে তোলার এ ছিল মূল ভিত্তি, যা ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। নির্বাচন এই গণতন্ত্রের একটি  প্রধান স্তম্ভ।

ভোটাধিকার শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে কোনো সময়েই ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হয়নি। বরং, কারো নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের উপর। কিন্তু আজ, প্রতিটি ভোটারকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে এবং তার নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় চাপানো হয়েছে তার নিজের কাঁধে। এই মানসিকতা শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, বিপজ্জনকও বটে।

সাধারণত, লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার নিয়মিত সংশোধন হয়—নতুন নাম যুক্ত হওয়া, মৃত্যুবরণ বা স্থানান্তরের কারণে নাম বাদ পড়া, কিংবা তথ্য হালনাগাদ হওয়া। এটি একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে কোনওরকম অস্থিরতা থাকে না। কিন্তু এবার জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (বিশেষ নিবিড় সংশোধনী) শুধুই নিয়মিত আপডেট নয়—এটি এক গভীর রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন পদক্ষেপ, যার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নাগরিকের ভোটাধিকার হরণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন যে প্রক্রিয়াটির সূচনা করেছে, সেটি প্রথমে বিহারে চালু হবে, তারপর ধাপে ধাপে সারা দেশে বিস্তৃত হবে। এই সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিক নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার পক্ষে এক গুরুতর হুমকি। যে অধিকার কোটি কোটি সাধারণ ভারতবাসী এতদিন ধরে চর্চা করে এসেছেন—ভোটাধিকার—এই নীতিগত মোড় ঘোরানোর ফলে সেটি কেড়ে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এর আগে বিহারে এমন ধরনের একটি নিবিড় সংশোধনী হয়েছিল ২০০৩ সালে। সে সময় কোনও নির্বাচন সামনে ছিল না। তৎকালীন ভোটার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫ কোটি, এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে কয়েক মাস সময় লেগেছিল। আর এবার, প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই ও যাচাইয়ের কাজ এক মাসের মধ্যেই শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা কার্যত এক রকম অবাস্তবতার পরিচায়ক। তার ওপর, নির্বাচন কমিশন এই অভিযান চালাতে চায় জুলাই মাসে—যে সময় বিহারে বর্ষার চূড়ান্ত সময়, কৃষিকাজ ব্যস্ততম পর্যায়ে থাকে, ঘনঘন বন্যা দেখা দেয়, এবং বহুসংখ্যক মানুষ জীবিকার তাগিদে বাইরে চলে যান। এই পরিস্থিতিতে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করা শুধু দুঃসাধ্য নয়, কার্যত অসম্ভব।

কিন্তু এই স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)-এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হল, যেভাবে এই সিদ্ধান্তটি গোপনে নেওয়া হয়েছে, এবং যেসব শর্ত এতে আরোপ করা হয়েছে, সেগুলি বিগত সত্তর বছরে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পরিচালিত কোনও ভোটার তালিকা সংশোধনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।

২০২৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের শুরু থেকেই প্রস্তুতির কাজ চলছিল। জেলা স্তরে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন একাধিক কর্মশালা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। কিন্তু এতদিন কোথাও কোনও পর্যায়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ‘নিবিড় সংশোধনের’ পরিকল্পনার কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দল কিংবা নাগরিক সমাজের কোনও স্তরকে আস্থায় না নিয়ে হঠাৎ করে এত বড় একটি প্রক্রিয়া চালু করা নিঃসন্দেহে এক অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।

বিহার, সারা দেশের মতোই, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার হালনাগাদ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল। সে সময়ে সমাজের কোনও স্তর থেকেই কোনও রকম আপত্তি বা আতঙ্ক প্রকাশ পায়নি। বাস্তবে, বিহারের জন্য এই তালিকাটির একটি নিয়মিত আপডেটই যথেষ্ট ছিল।

প্রয়োজনীয় নথিপত্রের বিস্তারিত বিবরণ এবং প্রক্রিয়া

২০০৩ সালের পর থেকে ডিজিটাল ভোটার তালিকা চালু হওয়ায় যেটি 'ইনটেনসিভ রিভিশন' নামে পরিচিত ছিল, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন সেই পুরনো নামের আড়ালে জাতীয় নির্বাচন কমিশন এক সম্পূর্ণ নতুন এবং বিভ্রান্তিকর পদ্ধতি চালু করেছে। এই প্রথমবার, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির দায়িত্ব রাষ্ট্রের থেকে সরিয়ে ব্যক্তিগত নাগরিকদের কাঁধে চাপানো হয়েছে। যারা ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে নতুন এনুমারেশন ফর্ম জমা দেবেন না, তাঁদের নাম খসড়া তালিকা থেকে সরাসরি বাদ দেওয়া হবে। এর থেকেও বেশি উদ্বেগজনক হলো—এই প্রথমবার, বৃহৎ সংখ্যক আবেদনকারীকে নাগরিকত্ব প্রমাণে বৈধ নথি জমা দিতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে কার্যত জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC)-র একটি পরোক্ষ রূপ বাস্তবায়িত করা হচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে যে বিহারে ১ জানুয়ারি ২০০৩ এর ভোটার তালিকাকে তারা প্রাথমিক রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে গ্রহণ করছে। অর্থাৎ, গত ২২ বছরে তৈরি হওয়া সমস্ত ভোটার তালিকাকে কার্যত অস্বীকার করা হচ্ছে। ২০০৩ সালের তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের তথ্য প্রমাণ ছাড়াই বৈধ হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু ২০০৩ সালের পর যাঁরা ভোটার হয়েছেন, তাঁদের এখন নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ সরকারী নথিপত্র জমা দিতে হবে—যার মধ্যে জন্ম তারিখ ও জন্মস্থানের প্রমাণ ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতার নথিও লাগবে।

এতদিন নাগরিকরা কেবল একটি হলফনামা দিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব ঘোষণা করলেই চলত, আর তদন্ত ও যাচাইয়ের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকত। এখন সেই ভার চাপানো হয়েছে নাগরিকদের উপরেই। একটি সার্কুলারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন কমিশন কার্যত ১৯৫১ সালের প্রতিনিধি আইন এবং স্বাধীন ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ার দীর্ঘস্থায়ী রীতি ভেঙে ফেলতে চাইছে।

৩০ জুন ২০২৫-এ নির্বাচন কমিশন একটি সংশোধনী প্রকাশ করে, যেটিকে অনেকেই বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। সংশোধন অনুযায়ী, প্রত্যেক ভোটারকে একটি নতুন এনুমারেশন ফর্ম জমা দিতে হবে, যেখানে সাম্প্রতিক ছবি, স্বাক্ষর, ব্যক্তিগত তথ্য এবং নাগরিকত্বের নথিপত্র বাধ্যতামূলক। তবে যাঁদের নাম ২০০৩ সালের তালিকায় রয়েছে এবং যাঁদের নাম ও ঠিকানা অপরিবর্তিত, তাঁরা ঐ তালিকার সংশ্লিষ্ট পাতার ফটোকপি জমা দিলেই চলবে। কমিশনের মতে, ৪.৯৬ কোটি নাগরিক (বর্তমান ভোটারের প্রায় ৬৩%) এই ব্যতিক্রমের আওতায় পড়বেন। অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি নাগরিককে এখনো পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বাড়বে, কারণ ২০০৩ সালের তালিকায় থাকা বহু নাগরিক ইতোমধ্যে মারা গেছেন, স্থান পরিবর্তন করেছেন, কিংবা তাঁদের তথ্য পরিবর্তিত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে ৪.৫ কোটিরও বেশি নাগরিককে নথি জমা দিতে হবে।

এই "নথি জমা"-ই এখন মূল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। যাঁদের নাম ২০০৩ সালে ছিল না কিংবা যাঁদের ঠিকানা পরিবর্তিত হয়েছে, তাঁদের জন্মস্থান ও জন্মতারিখ প্রমাণ করতে হবে (অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতারও)।

এক্ষেত্রে তিনটি বয়স বিভাগ তৈরি করা হয়েছে:

১. যাঁদের বয়স ৩৮-এর বেশি—অর্থাৎ ১ জুলাই, ১৯৮৭-এর আগে জন্ম, তাঁদের নিজস্ব জন্মস্থান ও জন্মতারিখের প্রমাণ লাগবে।

২. ২০ থেকে ৩৮ বছর বয়সী—অর্থাৎ ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৪-এর মধ্যে জন্ম, তাঁদের নিজের এবং বাবা/মায়ের একজনের নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দিতে হবে।

৩. ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী—অর্থাৎ ২ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে জন্ম, তাঁদের নিজের এবং বাবা-মা দুজনের জন্ম প্রমাণ করতে হবে। আবেদনকারীকে ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্মের প্রমাণ দেখাতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের তালিকায় যে নথিগুলি বৈধ হিসেবে বিবেচিত: জন্মসনদ (বার্থ সার্টিফিকেট), পাসপোর্ট, মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়/বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষাগত সনদ (সার্টিফিকেট), ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের পাসবই, এলআইসি নথি, স্থায়ী বাসিন্দা সনদ (সার্টিফিকেট), সরকারি কর্মচারী পরিচয়পত্র বা পেনশন পেমেন্ট অর্ডার, বনাধিকার সনদ (ফরেস্ট রাইটস সার্টিফিকেট), জাতিগত শংসাপত্র (OBC/SC/ST), NRC তালিকা (বিহারে প্রযোজ্য নয়), সরকার কর্তৃক জমি/বাড়ি বরাদ্দের বা  রেজিস্ট্রেশন এর নথি

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল, এই ধরনের নথিপত্র অধিকাংশ ভারতীয় (বিহার তার ব্যতিক্রম নয়) সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এই দায় জনগণের নয়, বরং রাষ্ট্রেরই। আজ সেই রাষ্ট্রই নাগরিকদের উপর দায় চাপাচ্ছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ না করতে পারলে তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও ভোটাধিকারহীন হতে পারে। বাস্তবে অধিকাংশ গৃহস্থের কাছে যা থাকে তা হলো আধার কার্ড, ভোটার কার্ড (EPIC), রেশন কার্ড ও MGNREGA কার্ড—কিন্তু এই চারটি নথির কোনওটাই SIR-অনুযায়ী বৈধ জন্ম ও জন্মস্থানের প্রমাণ নয়।

বিহারে জন্মসনদের (বার্থ সার্টিফিকেট) আওতায় মাত্র ২.৮ শতাংশ (প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে)। ২০২৩ পর্যন্ত মাত্র ২৭.৪৪ লক্ষ বৈধ পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে (আনুমানিক বিহারের জনসংখ্যার ২%)। ১ জুন ২০২৫ পর্যন্ত, বনাধিকার আইনের আওতায় বিহারে মাত্র ৪৬৯৬টি দাবি জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১৯১টি মঞ্জুর হয়েছে। সরকারি চাকরির  বা পেনশন অর্ডার পরিচয়পত্রধারীর সংখ্যা ৫% এরও কম। ২০২২ সালের বিহার জাতিগত সমীক্ষা অনুযায়ী, সে বছর রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৩.০৭ কোটি। এর মধ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC) ছিল ৩.৫৪ কোটি (২৭%), অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণি (EBC) ছিল ৪.৭০ কোটি (৩৬%), তফসিলি জাতি (SC) ছিল ২.৬ কোটি (২০%) এবং তফসিলি উপজাতি (ST) ছিল ২২ লক্ষ (১.৬%)। তবে এই সম্প্রদায়গুলোর কতজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে জাতিগত শংসাপত্র পেয়েছেন, সেই বিষয়ে কোনও সরকারি তথ্য নেই।

বিভিন্ন রিপোর্টের অনুমানে দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশের কাছাকাছি মানুষই কেবল জাতিগত শংসাপত্র পেয়েছেন। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিশেষত OBC, EBC, SC ও ST সম্প্রদায়ের বিরাট একটি অংশ, এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি স্বীকৃত পরিচয়পত্র পাননি—যেটা SIR-এর মত প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ বিহারবাসীর ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও, তাঁদের কাছে জমি-সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। এর মূল কারণ, রাজ্যে জমির মালিকানার হার অত্যন্ত কম। ২০১১ সালের সমাজ-আর্থিক ও জাতিগত জনগণনার (Socio-Economic and Caste Census) তথ্য অনুযায়ী, বিহারের ১.৭৮ কোটি গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে ৬৫.৫৮ শতাংশ পরিবারেরই কোনও জমির মালিকানা নেই।

শিক্ষা-সনদের (এডুকেশন সার্টিফিকেট) প্রাপ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন অনুমান রয়েছে, কারণ বিগত দুই দশকে স্কুল ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক বেসরকারিকরণ ঘটেছে। কিছু অতিশয় উদার অনুমান অনুযায়ী, মাধ্যমিক (মেট্রিকুলেশন) বা শিক্ষাগত সনদপত্র (এডুকেশন সার্টিফিকেট) বর্তমান তালিকাভুক্ত নথিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাপ্তিযোগ্য ও গৃহীত নথি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই সনদ সব প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে আনুমানিক ৩০+ শতাংশের এবং ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী জনগণের মধ্যে প্রায় ৪০+ শতাংশের কাছেই আছে বলে ধরা হচ্ছে।

বাস্তবিক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, এই তালিকার অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথিগুলোর থেকে শিক্ষা-সনদের (এডুকেশন সার্টিফিকেট)  বেশি সহজলভ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, কার্যত আজকের ভারতে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার অর্জনের অঘোষিত শর্ত হয়ে উঠেছে মাধ্যমিক পাশ হওয়া।

একটি দেশ, যে নিজেকে “গণতন্ত্রের জননী” হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে, সেখানে শিক্ষার ভিত্তিতে (যা ধীরে ধীরে অধিকার থেকে পণ্যে পরিণত হচ্ছে) ভোটাধিকারকে বিভাজন করা, এই দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের বিরুদ্ধে এক গভীর রাজনৈতিক পাপ। শিক্ষা, জাত, শ্রেণি বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে পরোক্ষ ও বৈষম্যমূলক প্রতিবন্ধকতা আরোপ—এই প্রবণতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের ঘটনাগুলিকে, যেখানে আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটাধিকার প্রথমে প্রত্যক্ষভাবে এবং পরে পরোক্ষভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল; কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।

বিহার তথা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়ার ভার সবচেয়ে বেশি গিয়ে পড়বে—নারী, আর্থিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী, দলিত, আদিবাসী ও বহুজন সম্প্রদায়ের উপর। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল সামাজিক বৈষম্যকেই ঘনীভূত করে না, বরং সরাসরি সাংবিধানিক চেতনা ও বিধানের বিরোধিতা করে—যেখানে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারভোগের সমান সুযোগকে সংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই মৌলিক ভোটাধিকার ছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের বন্দোবস্তের সবচেয়ে শক্তিশালী বাস্তব। ঔপনিবেশিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন ভারতের নাগরিকত্বের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে “সমান রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন”-এর ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

আনুমানিক ২.৫ কোটি নাগরিক—অর্থাৎ বিহারের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ—নতুন নথির অভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না। এই সংখ্যাটি বাস্তবে আরও বেশি হতে পারে, যদি আমরা সাময়িক অভিবাসন, কাগজপত্র সংগ্রহে অক্ষমতা, অনুপস্থিত শংসাপত্র, প্রশাসনিক ভুল ইত্যাদি বিবেচনা করি। ধরুন, এই পূর্বানুমান অতি-আকস্মিক, এবং বাস্তবে বাদ পড়ার সংখ্যা ১ কোটির কাছাকাছি হয়—তবুও এটিই ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভোটাধিকার হরণের এক নজির হয়ে থাকবে।

স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)-এর সঙ্গে আসামের NRC প্রক্রিয়ার অনেক মিল রয়েছে। ছয় বছর ধরে চলা আসামের NRC তে ৩৩ মিলিয়ন নাগরিকের নথি যাচাই হয়েছিল, যার শেষে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ তালিকা থেকে বাদ পড়েন। তাঁদের অনেকেই আজও অনিশ্চয়তা, হয়রানি ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অথচ, এত বড় প্রক্রিয়ার পরেও আসাম সরকার NRC-কে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

আসাম ও বিহারের মধ্যে পার্থক্য একটিই—আসামে রেফারেন্স তারিখ ছিল ২৪ মার্চ ১৯৭১, আর বিহারে তা ১ জানুয়ারি ২০০৩। তবে বিপদ আরও বেশি বিহারে—দু’গুণ জনসংখ্যার রাজ্যে মাত্র তিন মাসে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় নির্বাচন কমিশন। ১ মাসে খসড়া তৈরি, ২ মাসে চূড়ান্ত তালিকা। কত মানুষ ভোটাধিকার হারাবেন, তা এখনও অজানা।

২৫ জুন থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে বিহার সরকারের উপর বিশাল দায়িত্ব পড়েছে—প্রায় ১ লক্ষ বুথ লেভেল অফিসার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, সমস্ত রাজনৈতিক দলের বুথ এজেন্টদের সঙ্গে সমন্বয়, প্রচার অভিযান, প্রত্যেক ঘরে ফর্ম পৌঁছানো ও ২০০৩ সালের তালিকার কপি বিতরণ। ফর্ম সংগ্রহ, তথ্য আপলোড, নথি যাচাই—সব এক মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে, বর্ষা ও বন্যার মধ্যে। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রথম ১০ দিনের মধ্যে মাত্র ১৪% ফর্ম পূরণ হয়ে ফেরত এসেছে।

বিহারের সমস্ত বিরোধী দল—আর জে ডি , কংগ্রেস, সিপিআই এম এল (লিবারেশন), সিপিআইএম, সিপিআই  —এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাঁরা নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে এবং এবার মাঠে নেমে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তাঁদের মতে, এটি একটি পরিকল্পিত ভোটাধিকার হরণ প্রক্রিয়া, যাতে আগামী নির্বাচনের আগে সমতা ধ্বংস করা যায়।

সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে—এই স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন শুধু বিহারে সীমাবদ্ধ নয়, আগামী মাসগুলিতে এটি সারা দেশে চালু করা হবে। ২০২৬ সালের নির্বাচনের মুখে থাকা রাজ্যগুলো—পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়ু তেও এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। পশ্চিমবঙ্গে শেষবার এই প্রক্রিয়া হয়েছিল ২০০২ সালে। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালের ভোটার-তালিকাকে রেফারেন্স হিসেবে ধরা হবে। ফলে গত ২৩ বছরে বাংলার ভোটার তালিকাতে হওয়া সমস্ত সংশোধনী-পরিবর্তন সন্দেহের চোখে দেখা হবে, আর প্রমাণের দায় পড়বে নাগরিকদের উপর। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে একে NRC-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ তাঁর কাছ থেকে এই বিষয় সংক্রান্ত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছে।

ভোটাধিকারহীন নাগরিকদের সামনের পথ?

আসামে, যাঁরা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC)-তে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন, তাঁদের ‘সন্দেহভাজন ভোটার’ বা D-Voter হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেইসব নাগরিক আজও এক দীর্ঘ, জটিল ও অবসন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে বন্দী—নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাঁদের। অনিশ্চয়তা, সামাজিক উৎকণ্ঠা এবং প্রশাসনিক হয়রানি তাঁদের জীবনের স্থায়ী বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এইবার, স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)-এর প্রেক্ষিতেও, জাতীয় নির্বাচন কমিশন (ECI) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে—যাঁরা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হবেন, অর্থাৎ যাঁরা “সন্দেহভাজন বিদেশি নাগরিক” হিসেবে গণ্য হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হবে এবং সেই মোতাবেক তাঁদের নাম সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।

এই ঘোষণা এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্তের দরজা খুলে দেয়—একটি প্রকৃত প্যান্ডোরার বাক্স। প্রশ্ন উঠে গেছে: এইভাবে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকেরা তাঁদের আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, রেশন, DBT ভর্তুকি বা সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি থেকেও কি বঞ্চিত হবেন? এমনকি সরকারি চাকরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিসেবার মতো ক্ষেত্রেও কি তাঁদের অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়বে?

এই পরিস্থিতিতে আমরা কার্যত এমন একটি দেশে পরিণত হব, যেখানে নাগরিকরা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হবেন—কেউ পূর্ণ নাগরিক, কেউ সীমিত নাগরিক, কেউ “সন্দেহভাজন”। প্রত্যেকের অধিকার, সুযোগ, মর্যাদা ও নাগরিক সুরক্ষা ভিন্ন ভিন্ন হবে—এ হবে এক বহু-রূপী নাগরিকত্বের ভারত।

এই পুরো প্রক্রিয়া, যা বর্তমানে SIR-এর নামে চলছে, তা ভারতবর্ষের যে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও রাষ্ট্রগত চেতনা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে সমতা ও নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, আজ সেই রাষ্ট্রে ভোটাধিকারহীনতা, সন্দেহ, ও বৈষম্য মূল নীতিতে পরিণত হচ্ছে।

উপসংহার

এক গভীর ঐতিহাসিক পরিহাস এই যে, স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) শুরু হয়েছে ২৫শে জুন, ২০২৫, সেই দিনটিতে যেটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘জরুরি অবস্থার (ইমার্জেন্সি) পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি’ হিসেবে চিহ্নিত—যা বর্তমান মোদী সরকার নিজেই “সংবিধান হত্যা দিবস” নামে অভিহিত করে থাকে। আর ঠিক এই দিনেই, বিহারের নাগরিকদের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার—ভোটাধিকার—কে বিপন্ন করে, এই কেন্দ্রের সরকার-নিযুক্ত জাতীয় নির্বাচন কমিশন (ECI) যেন স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ৭৫তম বর্ষে এক গুরুতর আঘাত হানল।

গোটা দেশকে আজ বিহারের পাশে দাঁড়াতে হবে—এই গভীরভাবে উদ্বেগজনক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে বিপজ্জনক উদ্যোগের বিরুদ্ধে। “প্রশাসনিক সংস্কার”-এর নামে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা আদতে স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থার ভিতকেই দুর্বল করে দিতে পারে। নির্বাচন পরিচালিত হওয়া উচিত নিয়মমাফিক, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক ভোটার তালিকা হালনাগাদ (সংশোধনীর) প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে, এইরকম অস্বচ্ছ, বৈষম্যমূলক ও বহিষ্করণমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে নয় , যেমনটি আমরা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)-এর ক্ষেত্রে দেখছি।

বিহারকে কখনোই এমন একটি পরীক্ষাগারে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না, যেখানে নাগরিকদের গণহারে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক বিপজ্জনক ও অমানবিক কৌশল পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ভারতের গণপ্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে থাকা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার-এর মৌলিক ধারণাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। বিহার যেন এক 'পরীক্ষাগার' না হয়ে ওঠে, যেখানে ‘ভোটাধিকার বন্ধ’ বা “ভোটবন্দি” নামক এক গণবর্জনের কৌশল পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কারণ এই নীতির সফল বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে দেশের বাকি অংশেও একই ধরণের ভোটাধিকার হরণের পথ সুগম করে তুলতে পারে—যা ভারতের গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার মেরুদণ্ড—সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারকে ধ্বংস করে দেবে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল প্রতিটি জন্ম নথিভুক্ত করা—নাগরিকের কাঁধে নয়, যে তাকে জন্মসূত্রে তার নাগরিকত্ব বারবার প্রমাণ করতে হবে। জন্মের বৈধতা শুধুমাত্র রেজিস্ট্রেশন না-হওয়ার কারণে কখনও বাতিল হতে পারে না। মানুষকে পুরনো ও দুর্লভ নথি খুঁজে আনতে বাধ্য না করে, বরং রাষ্ট্রের কর্তব্য হল জন্ম ও মৃত্যুর সর্বজনীন ও পদ্ধতিগত রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা—যা নাগরিক অধিকারের প্রতি সম্মান রেখেই প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

এই সংকটের মুহূর্তে—যখন কোটি কোটি নাগরিক ভোটাধিকার হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে—একটি ব্যাপক দেশজুড়ে গণ-আন্দোলনের প্রয়োজন এই অস্বচ্ছ, একতরফা ও অবৈধ ভোটবন্দি প্রকল্পের বিরুদ্ধে। দেশের সাধারণ মানুষ এর আগেও সহ্য করেছেন নোটবন্দি (ডিমনিটাইজেশন) এবং দেশবন্দি (লকডাউন)-এর মতো অস্বচ্ছ ও দুর্ব্যবস্থাপিত সরকারি কর্মসূচির পরিণাম। আর এবার এই ভোটবন্দির বিপরীতে, দেশের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের একত্রে রুখে দাঁড়াতে হবে।

জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে এই অনিয়মিত, দুর্ভাবনাপ্রসূত ও অস্বচ্ছ নির্দেশিকা প্রত্যাহার করতে হবে, এবং বিগত দুই দশক ধরে গৃহীত নিয়মিত ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া-তেই ফিরতে হবে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহৃত ভোটার তালিকাই হোক মূল রেফারেন্স পয়েন্ট। এবং বর্জন করা হোক এই পদ্ধতি যেখানে মানুষকে ২০০৩ সালের পুরোনো ভোটার তালিকা বা ৪-৫ দশক পুরনো জন্মস্থান বা জন্মতারিখ প্রমাণ করার অপ্রাসঙ্গিক নথি খুঁজতে হয় ।

আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত—নাগরিককে ক্ষমতায়িত করা, যাতে তারা সহজেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। নাগরিকদের বাদ দিয়ে কিংবা বিভ্রান্তিকর প্রশাসনিক বাধা তৈরি করে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের চেতনা রক্ষা করতে গেলে, ভোটাধিকারকে সহজ ও সুলভ করতে হবে, কঠিন ও জটিল নয়।

Keywords: Bihar voting rights, voter suppression in India, Bihar elections 20threat to Indian democracy, voting crisis in Bihar, electoral rights in hts India, nationwide voter suppression alert.

* মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

ছবি প্রতীকী
Emergency 1975: সব 'জরুরি অবস্থা' শুধু কি ঘোষণার মাধ্যমেই হয়?
ছবি প্রতীকী
যে শত্রুকে মোদী ভোলেন না, তাঁর বিরোধীরা ভুলে যান
ছবি প্রতীকী
Lok Sabha Polls 24: নির্বাচন ২০২৪ - ভারতীয় গণতন্ত্রের কঠিনতম পরীক্ষা

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in