ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স - আকাশ

Emergency 1975: সব 'জরুরি অবস্থা' শুধু কি ঘোষণার মাধ্যমেই হয়?

People's Reporter: ঘোষিত জরুরী অবস্থার ৫০ বছরের মাথায় এসে আমাদের রাজ্য হোক বা কেন্দ্র, একটা অঘোষিত জরুরী অবস্থার বাতাবরণ তৈরী হয়েছে ২০১১র বা ২০১৪র পরবর্তী সময় থেকে।
Published on

আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ১২ই জুন এলাহাবাদের হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহের রায়ে রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল হয়, তদুপরি পরের ৬ বছর ওনার নির্বাচনে লড়ার অধিকারও এই রায়ে খারিজ হয়ে যায়। দেশজোড়া দাবী ওঠে ইন্দিরার পদত্যাগের। ঐ রায়ের পরের দিনই গুজরাট বিধানসভার ফলাফলে কংগ্রেস পরাজিত হয়। দেশজোড়া এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, যখন ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতায় থাকাটাই প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই ২৫শে জুন ১৯৭৫, মাঝরাত্তিরে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশজুড়ে অন্তর্বর্তী জরুরী অবস্থা (Emergency) ঘোষণা করলেন।

প্রয়াত জননেতা জ্যোতি বসু তাঁর আত্মজীবনী "যতদূর মনে পড়ে" তে এই প্রসঙ্গে লিখছেন: "(ইন্দিরা) জারি করলেন জরুরী অবস্থা ১৯৭৫ সালের ২৬শে জুন। ভারতের রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র পাকাপাকি একটা ভিত্তি পেয়ে গেল। দেশে সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। একমাত্র শাসক কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী জনগণের কাছে রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়, এমনকি তার দলের অন্য কোনো নেতারও অধিকার থাকবে না। অর্থাৎ, শুধুমাত্র দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির অধিকারই তিনি হরণ করলেন না, কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকেও কবরে পাঠালেন।"

এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের একটা বড় অংশই ঐ সময়টা দেখেননি বা দেখলেও উপলব্ধি করার বয়সে পৌঁছাননি, কিন্তু সেই প্রজন্মও ২০২৫ সালে এসে দেখছে এই রাজ্যের রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোর গরমের ছুটি আচমকাই ঘোষিত হয়েছিল ৩০ শে এপ্রিল এবং খুলেছিল ২রা জুন। কিন্তু দুটো দিনের একটাও শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেননি, করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এটা কি তাঁর কাজ? শিক্ষা দপ্তর বলে তো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দপ্তর আছে এবং একজন গোটা মন্ত্রীও আছেন - অর্থাৎ জ্যোতিবাবুর সেই কথাটাই, নাম - পরিচয় পাল্টে ফিরে আসছে ৫০ বছর বাদেও "একমাত্র শাসক কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী জনগণের কাছে রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়, এমনকি তার দলের অন্য কোনো নেতারও অধিকার থাকবে না।"

ঘোষিত জরুরী অবস্থার ৫০ বছরের মাথায় এসে আমাদের রাজ্য হোক বা কেন্দ্র, একটা অঘোষিত জরুরী অবস্থার বাতাবরণ তৈরী হয়েছে ২০১১র বা ২০১৪র পরবর্তী সময় থেকে। কার্টুন ফরোয়ার্ড করার অপরাধে যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের জেল, সরকার বিরোধী স্বর চড়ালে আরবান নকশাল বলে দেগে দেওয়া, কলেজ ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজের প্রশ্ন পছন্দ না হওয়ায় টক শো ছেড়ে উঠে যাওয়া, নিজের বাড়ির সামনে গৌরী লঙ্কেশের খুন হয়ে যাওয়া, মঞ্চে ভাষণরত অবস্থায় শিলাদিত্য চৌধুরীকে মাওবাদী বলে চিনে নেওয়া, ফ্রিজে গরুর মাংস আছে বলে উত্তরপ্রদেশে মহম্মদ আখলাখকে পিটিয়ে মেরে দেওয়ার মধ্যে ক্ষমতার শীতল হুমকি মাখা চোখ যেটার জানান দেওয়ার চেষ্টা করে, সেটাকেই অঘোষিত জরুরী অবস্থা বলে।

সেই সময়ে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ মজুমদারদের গ্রেপ্তারি আর আজকের দিনে নিউজ ক্লিকের প্রবীর পুরকায়স্থের গ্রেপ্তারি বা সমাজকর্মী তিস্তা শীতলাবাদের গ্রেপ্তারির মধ্যে চরিত্রগত তফাৎ প্রায় নেই বললেই চলে। ক্ষমতার মূল লক্ষ্য সবসময়ই বিরোধী কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখা, যাতে সে আওয়াজ না তুলতে পারে, জনমত তৈরী করতে না পারে এবং তার জন্য যতদূর যেতে হয়, ক্ষমতার অলিন্দ ততটাই যেতে রাজি।

জরুরী অবস্থা চলাকালীন গণশক্তি রবীন্দ্রনাথের লেখা ছাপতে পারে নি, শরৎচন্দ্রের লেখা ছাপায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ রা জুলাই "গায়ের জোরে প্রভু" শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের পুরো লেখাটাই কেটে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতিবাদে সেই অংশ ফাঁকা রেখেই প্রকাশিত হয়েছিল গণশক্তি - জরুরী অবস্থা চলাকালীন মাথা না নোয়ানোর একটা ছোট্ট নিদর্শন।

মাঝে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার বদলে গেছে। ভারতের রাজনীতিতে বহু বদল এসেছে। কংগ্রেসের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস নামক একটি আপাদমস্তক নীতিহীন রাজনৈতিক দল, যাদের রাজনীতির মূল পুঁজি বলতে সীমাহীন নৈরাজ্য। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পরে সেই নৈরাজ্যকে পুঁজি করেই ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। গোটা রাজ্যের প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে ঝুলতে শুরু করে সততার প্রতীক এর কাটআউট, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ভিআইপি রোডে পা দেওয়ার মুখ হোক বা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলাকালীন নন্দন চত্ত্বর জুড়ে একজনেরই মুখের ছবি, ভরা মিটিংয়ে শব্দের মানে না জেনেই "ডহরবাবু" বলে ডাক দেওয়া - সবকিছুর মধ্যেই যেটা প্রচণ্ডভাবে প্রকাশ পায় সেটা হল একটা সীমাহীন ঔদ্ধত্য।

বিরোধীদের মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখার নিদান দেওয়া হোক বা বইমেলার গেটে কর্তব্যরত পুলিশের কর্তাব্যক্তিকে সর্বসমক্ষে "চাবকানো উচিৎ" বলা - এটাও অলিখিত জরুরী অবস্থার একটা ফর্ম, মানুষকে ধমকে - চমকে দাবিয়ে রাখা। আপনি যদি দেখেন যে একদিকে ফেসবুকে কার্টুন ফরোয়ার্ড করার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করছে আর মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজকে সমর্থন করছেন, অথচ উল্টোদিকে সেই মুখ্যমন্ত্রীই মাঝররাত্তিরে থানায় ঢুকে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানে গ্রেপ্তার করা অপরাধীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বা পুলিশকে বোমা মারার নিদান দেওয়া তৃণমূলের নেতার পিঠে মুখ্যমন্ত্রী হাত রাখছেন জনসভায় দাঁড়িয়ে - তাহলে কোনো প্রতিবাদে সামিল হতে গেলেই আপনার মেরুদন্ড দিয়ে একটা ভয়ের স্রোত নামবে আর উনি সেটাই চান।

ইন্দিরার জরুরী অবস্থার সময় লোকসভায় প্রশ্নোত্তর, দৃষ্টি - আকর্ষণী, স্বল্পমেয়াদী নোটিশে প্রশ্নোত্তর, বেসরকারী প্রস্তাব সমস্যাদি পেশ করার অধিকারগুলি সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রীর প্রস্তাব অনুসারে স্থগিত রাখা হয়।

এই প্রসঙ্গে জ্যোতি বসু লিখছেন " জরুরী অবস্থার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আরো কতগুলি কালাকানুন পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এগুলির মধ্যে মিসা, সংসদের কার্যবিবরণী প্রকাশ নিরোধক আইন, বোনাস বাতিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।"

পাঠক খেয়াল করে দেখুন, বিগত দেড় দশকে এই রাজ্যে কতগুলো গুরুত্ত্বপূর্ণ বিলের আলোচনা গিলোটিনে চলে গেছে এবং সেই অবস্থায় পাশও হয়ে গেছে স্বাভাবিক ভাবেই। উল্টোদিকে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে স্রেফ ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে গেছে একের পর এক বিল।

১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সারা দেশে দশ হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, যার মধ্যে ২৩ জন ছিলেন সাংসদ। ফিরে আসুন, ২০১১ সালে, রাজ্যে পালাবদলের পরে কয়েক হাজার বামপন্থী পার্টিকর্মী গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলায় ঘরছাড়া, প্রাক্তন বিধায়কের জেল হচ্ছে কয়েক বছর আগে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির পরনের অটুট অন্তর্বাস দেখে, মনে রাখবেন শরীর কঙ্কাল হয়ে গেছে কিন্তু অন্তর্বাস এতটুকুও বিকৃত হয় নি।

রাজ্য ছেড়ে রাজধানীর দিকে নজর ঘোরাবেন? দিল্লির জওহরলাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র নাজিব আহমেদ কোথায়? ২০১৬-র ১৫ অক্টোবরের পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ আছে?

দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধী, যিনি ১৯৭৫ সালের আগেই "এশিয়ার মুক্তিসূর্য" হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে গেছিলেন, তিনিও ১৯৭৭ সালে, ইমার্জেন্সী পিরিয়ডের পরে হওয়া লোকসভা ভোটে জিততে পারেননি। মানুষ তাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিল। ২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে আসনের নিরিখে বিরোধীদের বহু পেছনে ফেলে দেওয়া বিজেপিও ২০২৪ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি শুধু নয়, তারা বাধ্য হয়েছে এমন দুজনের হাত ধরতে, রাজনীতিতে ডিগবাজি খাওয়া যাদের কাছে জলভাত।

'৭৫ সালের জুন মাসে জারি হওয়া জরুরী অবস্থা স্থায়ী হয়েছিল '৭৭ সালের ২১ শে মার্চ পর্যন্ত, তারপরেই ইন্দিরা নির্বাচনে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে "সুপ্রীম কোর্টে একটি বিচার চলছিল। তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল নীরেন দে সওয়াল করছিলেন। বিচারপতি প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাহলে কি মানতে হবে যে এখন বেঁচে থাকার অধিকার নেই। নীরেন দে উত্তর দিয়েছিলেন 'ঠিক তাই, ইওর অনার' "। ২০২৫ সালের ২৪শে জুন কালীগঞ্জ নামক একটি বিধানসভা উপনির্বাচনে জেতার পরে একটা বিজয়মিছিল থেকে বোমা মেরে খুন করা হয় ক্লাস ফোরের তামান্নাকে... বাঁচার অধিকার আছে? বিরোধী দলের সমর্থক হলে বাঁচবেন এই বাংলায়?

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত চলা দমবন্ধকর জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ মানুষ; ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে জবাব পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এবার দায়িত্ত্ব আমাদের। ২০১১ থেকে চলা অঘোষিত জরুরী অবস্থা থেকে বাংলাকে বাঁচানোর দায় আমাদের। স্কুলের লাইব্রেরিতে নিজের বই ঢুকিয়ে হোক বা কার্টুন শিল্পী মঞ্জুলের আঁকা ছ'বছর আগের ব্যঙ্গচিত্র মুছে দেওয়ার চাপ দিয়ে যতই নিজের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ বিল্ডিংয়ের চেষ্টা করুন উনি - শেষের সেদিনের আগমনী গাওয়ার দায় এখন এক এবং একমাত্র আমাদের। ভবিষ্যতের কাছে এটাই এখন আমাদের দায় এবং দায়িত্ব।

উদ্ধৃতাংশ জ্যোতি বসুর " যতদূর মনে পড়ে" থেকে নেওয়া। অন্যান্য তথ্যসূত্র: গণশক্তি

* মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

ছবি প্রতীকী
Emergency 1975: পোহালে শর্বরী নতুন দেশ : জরুরি অবস্থার কয়েকটি কথা
ছবি প্রতীকী
WB Politics: শাসক দলের একাধিপত্যে রাজ্যে বিপন্ন গণতান্ত্রিক পরিসর - বিরোধীরা এর দায় এড়াতে পারেন কি?

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in