WB Politics: শাসক দলের একাধিপত্যে রাজ্যে বিপন্ন গণতান্ত্রিক পরিসর - বিরোধীরা এর দায় এড়াতে পারেন কি?

People's Reporter: উপনির্বাচনের ফলাফল বলছে, আরজি কর কান্ডের প্রভাব অথবা আবাস দুর্নীতির যেসব ঘটনা সামনে এসেছে তার কোনও প্রভাব এই ভোটে পড়েনি এতটুকুও। এখনও তৃণমূলের ইলেকশন মেশিনারি অটুট।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীছবি সংগৃহীত
Published on

প্রত্যাশামতই রাজ্যের ছয় বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী শাসকদল তৃণমূল। এই ছয় কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফলে রাজ্য রাজনীতিতে বিরাট কিছু অদলবদল হবার ছিল না। ফলে এই ভোট ঘিরে সাধারণের আকর্ষণ কমই ছিল। দেখার ছিল, বিজেপির দখলে মাদারিহাট থাকে কিনা। ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে ২০২১-এ জেতা মাদারিহাটও হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। জয়জয়কার শাসকেরই। এখানে অপ্রত্যাশিত কিছুই নেই।

ছয় কেন্দ্রের ফলাফলের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে প্রায় একপেশে ভোট হয়েছে সব কেন্দ্রেই। এমনকি কেউ কেউ আশা করেছিলেন, আরজি কর কান্ডের প্রভাব অথবা আবাস দুর্নীতির যেসব ঘটনা সামনে এসেছে তার প্রভাব হয়তো এই উপনির্বাচনে পড়বে। যদিও ফলাফল বলছে, এর কোনও প্রভাব পড়েনি এতটুকুও। এত কিছুর পরেও তৃণমূলের ইলেকশন মেশিনারি অটুট। বিগত কয়েক বছরে ঠিক যেভাবে রাজ্যের নির্বাচন পর্ব দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সেভাবেই এবারের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। তৃণমূলের যে ভোট মেশিনারির সামনে এবার মাথা নোয়াতে হয়েছে রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপিকেও। যদিও, বিজেপি ঠিক কতটা গুরুত্ব এই উপনির্বাচনকে দিয়েছিল প্রশ্ন আছে তা নিয়েও।

রাজ্যের যে ছয় কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে দু'টি কেন্দ্রে জামানত বাজেয়াপ্ত (সিতাই ও হাড়োয়া - যে কোনও কেন্দ্রের মোট প্রদত্ত ভোটের ১৬.৬৬ শতাংশ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়) হওয়া সহ প্রত্যেকটিতে ভোট কমেছে বিজেপির। যার মধ্যে নৈহাটিতে কমেছে ২৩.৫৮ শতাংশ, মাদারিহাটে ১৯.৫২ শতাংশ, সিতাই কেন্দ্রে ২৮.৯৮ শতাংশ, মেদিনীপুর কেন্দ্রে ২.৮৬ শতাংশ, তালডাংরায় ৫.৭৬ শতাংশ এবং হাড়োয়ায় ৬.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ যে উত্তরবঙ্গকে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি বলে ধরা হয় সেই উত্তরবঙ্গে অনেকটাই জমি হারিয়েছে বিজেপি। পাশাপাশি বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রেও অর্জুন সিং-এর প্রভাব কমার সাথে সাথে প্রভাব কমেছে বিজেপির।

একইভাবে এখনও পর্যন্ত ভোট কমা বন্ধ হয়নি বামেদেরও। গত কয়েক বছর ধরে জোট, সমঝোতা বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবার পরেও কোনও পরীক্ষাতেই বামেরা এখনও ফুল মার্কস পেয়ে পাশ করতে পারেনি। এই মুহূর্তে রাজ্য বামফ্রন্টের বড়ো শরিক সিপিআইএম-এর কাছে সবথেকে বড়ো সমস্যা বোধহয় ছোটো শরিক দলগুলি। বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা মাথায় রেখে এদের নিয়ে চলতে হলেও বর্তমানে সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-র সংগঠন বা প্রভাব আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাজ্যের ২৯৪ আসনের একটিতেও এককভাবে লড়াই করার ক্ষমতায় নেই এই শরিকদলগুলি। যা ক্রমশই সিপিআইএম-এর কাছে সমস্যা তৈরি করছে।

কখনও কংগ্রেস, কখনও আইএসএফ অথবা কখনও সিপিআইএমএল-এর সঙ্গে চলতে গিয়ে সিপিআইএম নেতৃত্বকেও বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে দলের কঠোর শৃঙ্খলার রাশ এখন অনেকটাই আলগা। ফলে কৌশলগতভাবে দল কোনও সিদ্ধান্ত নিলেও সেই সিদ্ধান্ত নিজেদের মনমতো না হওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়াতে দলকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছেন কোনও কোনও কর্মী, সমর্থক, দরদী। যার ব্যাখ্যা সবসময় প্রকাশ্যে দেওয়া বাস্তবসম্মত নয় এবং নেতৃত্বের পক্ষে তা দিয়ে ওঠা সম্ভবও হচ্ছে না। কখনও কখনও সেই ব্যাখ্যা গোঁড়া কর্মী সমর্থকদের পছন্দ হচ্ছেনা। ফলে দলের ভেতরে এবং বাইরে প্রবল অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। যাতে শেষমেষ ক্ষতি হচ্ছে দলেরই।

এই নির্বাচনে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় রাজ্যে সেভাবে বুথভিত্তিক সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও শেষ কয়েকটি নির্বাচনের প্রতিটিতে বিজেপির দ্বিতীয় স্থানে থাকা। ইদানীংকালে রাজ্যের মানুষের সমস্যা নিয়ে কোনও আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্যে না থেকেও বিজেপি রাজ্যে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে। যার কিছুটা হয়তো কেন্দ্রে শাসনক্ষমতায় থাকার জন্য। কিন্তু সেটাই সব নয়।

অন্যদিকে বামেরা বেশ কিছু ইস্যুতে পথে নামলেও তার কোনও প্রভাব ভোটের ফলাফলে প্রতিফলিত হচ্ছেনা। এখনও পর্যন্ত বড়ো অংশের মানুষই বামেদের ভরসাযোগ্য মনে করছেন না এটা বাস্তব। সেই জায়গা ফিরিয়ে আনতে না পারলে ইভিএম-এ তার প্রতিফলন ঘটবে না।

বামেরা তৃণমূল বিজেপির যে বাইনারির কথা প্রচার করে তা হয়তো সত্যি। এই বিষয়ে একাধিক উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তা মানুষকে বিশ্বাস করানো বা বোঝানোর কাজটাও বামেদেরই করতে হবে। শুধু 'মিডিয়া আমাদের খবর করে না' বলে এই সমস্যা মেটানো যাবে না। আর এই সমস্যা না মেটাতে পারলে শাসক দল তৃণমূল কোনও সময়েই বিরোধীদের কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে না। রাজ্য রাজনীতির মূল সমস্যা বোধহয় লুকিয়ে এখানেই। এই বাইনারি পলিটিক্স-এর ধারা ভেঙে বেরোনোর পথ কী তা ভাবতে হবে বিরোধীদেরই।

প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের ফলাফলই একপেশে হবার কারণে প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি অঞ্চলে তৃণমূলের একাধিপত্য তৈরি হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। একদিকে দুর্বল বিরোধী অন্যদিকে একাধিপত্য তৈরি করা শাসকের মাঝে পড়ে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে গণতন্ত্রের। যা আগামী দিনে রাজ্যের মানুষের জন্য ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করতে পারে।

একনজরে উপনির্বাচনের ফলাফল

নৈহাটি

তৃণমূল বিধায়ক পার্থ ভৌমিক লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ায় নৈহাটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে কেন্দ্রে ২০২১-এর নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ ভোট এবার তা কমে হয়েছে ২৩.৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ নৈহাটি কেন্দ্রে বিজেপি ভোট কমেছে ১৪.৪২ শতাংশ। অন্যদিকে এই কেন্দ্রে ২০২১-এর অনুপাতে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ১২ শতাংশ। যা ৫০ শতাংশ থেকে পৌঁছে গিয়েছে ৬২.৯৭ শতাংশে।

নৈহাটি কেন্দ্রে এবার বামফ্রন্টের কোনও প্রার্থী ছিলনা। বামেরা সমর্থন জানিয়েছিল সিপিআইএমএল-কে। কংগ্রেসও আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল। উপনির্বাচনে নৈহাটিতে কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৩.১ শতাংশ ভোট এবং বাম সমর্থিত এমএল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৬.০৭। এই দুই প্রাপ্ত ভোট যোগ করলেও তা বামেদের ২০২১-এ প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কম। ২০২১-এ বামফ্রন্টের সিপিআইএম প্রার্থী এই কেন্দ্রে ভোট পান ১০ শতাংশ।

মাদারিহাট

মাদারিহাট কেন্দ্রে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগগা পেয়েছিলেন ৫৪.০৫ শতাংশ ভোট। তিনি লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ায় এই কেন্দ্রে ভোট হয়। যদিও মাত্র তিন বছর আগে জেতা আসন এবার ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। মাদারিহাটে এবার বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন ৩৪.৮৩ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ ২০২১-এর তুলনায় বিজেপি ভোট কমেছে ১৯.৫২। অন্যদিকে তৃণমূল নিজেদের ভোট ৩৬.৫৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে নিয়ে গেছে ৫৪.০৫ শতাংশে।

একসময় এই কেন্দ্রে বাম শরিক আরএসপি-র দাপট থাকলেও এখন তা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। গতবারের নির্বাচনে আরএসপি প্রার্থী তৃতীয় স্থানে থাকলেও এবার তারা চতুর্থ। গতবার আরএসপি প্রার্থীর ভোট ছিল ৪.২৪ শতাংশ। যা এবার আরও কমে হয়েছে ২.৩৩ শতাংশ। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ২.০৬ ভোট। বাম কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে তা ২০২১-এর জোট প্রার্থীর ভোটের চেয়ে সামান্য বেশি।

সিতাই

সিতাই কেন্দ্রে ২০২১-এ তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৪৯.৪২ শতাংশ। বিজেপির ভোট ছিল ৪৫.১৮ শতাংশ। এবার এই কেন্দ্রে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ১৬.২০ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপির ভোট কমেছে ২৮.৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ২৬.৬৬ শতাংশ। এই কেন্দ্রে গতবার বাম কং জোট প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ১.৬৬ শতাংশ। এবার যদিও আলাদা আলাদা লড়াই করে কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ৪.২১ শতাংশ এবং ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী পেয়েছেন ১.৫২ শতাংশ ভোট।

মেদিনীপুর

মেদিনীপুর কেন্দ্রে ২০২১-এর নির্বাচনে ৫০.৭২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। যা এবার বেড়ে হয়েছে ৫৩.৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে বিজেপির গতবারের প্রাপ্ত ভোটের (৪০.৫১%) অনুপাতে এবার ভোট কমেছে ২.৮৬ (৩৭.৬৫%) শতাংশ।

এই কেন্দ্রে গতবার বাম কংগ্রেস জোটের সিপিআই প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫.৪৩ শতাংশ ভোট। এবার আলাদা আলাদা লড়াই করে সিপিআই প্রার্থী পেয়েছেন ৫.৫২ শতাংশ ভোট এবং কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ১.৮৪ ভোট।

তালডাংরা

তালডাংরা কেন্দ্রে গত নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৬.১ শতাংশ ভোট । যা এবার বেড়ে হয়েছে ৫২.০৭ শতাংশ। বিজেপির প্রাপ্ত ৩৯.৯ শতাংশ ভোট ৫.৭৬ শতাংশ কমে এবার হয়েছে ৩৪.১৩ শতাংশ।

অন্যদিকে গতবার এই কেন্দ্রে বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী পেয়েছিলেন ১১.৬ শতাংশ ভোট। এবার আলাদা আলাদা লড়াই করে বামেদের সিপিআইএম প্রার্থী পেয়েছেন ১০.২৩ শতাংশ এবং কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ১.৪৯ শতাংশ ভোট।

হাড়োয়া

হাড়োয়া কেন্দ্রে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৫৭.৩৪ শতাংশ ভোট। যা ১৯.২৯ শতাংশ বেড়ে এবার দাঁড়িয়েছে ৭৬.৬৩ শতাংশে। অন্যদিকে বিজেপির ভোট ১৬.৯৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৬.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপির ভোট কমেছে ১০.৩১ শতাংশ।

এই কেন্দ্রে গতবার বাম জোটের আইএসএফ প্রার্থী পেয়েছিল ২১.৭৩ শতাংশ ভোট। যা এবার ৯.২ শতাংশ কমে হয়েছে ৬.২ শতাংশ। অন্যদিকে কংগ্রেস এই কেন্দ্রে পেয়েছে ১.৮৪ শতাংশ ভোট।

*মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

ছবি প্রতীকী
যে শত্রুকে মোদী ভোলেন না, তাঁর বিরোধীরা ভুলে যান
ছবি প্রতীকী
AI: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা - মানব সভ্যতা জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে না তো?

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in