
সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে মৃত্যু হল জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গর্গের। মাত্র ৫২ বছর বয়সেই শেষ হয়ে গেল শিল্পীর জীবন। তাঁর মৃত্যুতে সঙ্গীতজগত যেমন হারালো এক গুণী শিল্পীকে তেমনই প্রতিবাদী জনতা হারালো এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকেও। যিনি আর সবকিছুকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র গান গেয়ে সময় কাটাননি, বরং বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি প্রতিবাদে অংশ নিয়েও নিজের প্রতিবাদী চরিত্রেরও ছাপ রেখেছেন। বিশেষ করে সিএএ আন্দোলনের সময় তাঁর ভূমিকা বারবার শিরোনামে এসেছে।
আন্দোলনের ময়দানে জুবিন গর্গ
সাল ২০১৯। দেশ জুড়ে চলছে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ, আন্দোলন। দেশব্যাপী সেই আন্দোলনের সময় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি জুবিন গর্গ। বরং কেন্দ্রের প্রস্তাবিত নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। বারবার প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন রাস্তায় নেমে, গান গেয়ে, বিবৃতি দিয়ে। নিজের কেরিয়ারের ভালো মন্দ না ভেবেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনে। সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা শক্তি বাড়িয়েছিল আন্দোলনকারীদের।
২০১৯-এর ১৫ ডিসেম্বর নিউজ পোর্টাল দ্য প্রিন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুবিন জানিয়েছিলেন, “মূল সমস্যা হল ওরা (মোদী এবং শাহ) আমাদের বোঝে না। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু তাদের এটা বুঝতে হবে। ওরা আমাদের সবসময় ডাস্টবিন ভাবে।” প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে করা এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, “আমরা ওঁদের বিশ্বাস করি না।” জুবিন জানিয়েছিলেন, “আসাম দেশকে পেট্রোল, চা, কয়লা দেয়। আমরা দেশকে অনেক কিছু দিই। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পাই?”
২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুবিন গর্গ জানান, “বিজেপি আসামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি পছন্দ করেনা। তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এনে হিন্দু-মুসলিম, অসমিয়া-বাঙালির মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করছে। আমরা আসামকে কারও পরীক্ষাগারে পরিণত হতে দেব না।"
ওইদিনই তিনি আরও বলেছিলেন, “সরকার আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করছে, আসামে এমন কারফিউ কখনও দেখিনি। এটা একনায়কতন্ত্র। এরা কাশ্মীরে যেমন করেছিল, আসামেও তেমনই বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।”
আসামে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন হিংসার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন জুবিন গর্গ। গুয়াহাটির বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, এই কাজ অন্য কোনও তৃতীয় শক্তির।
বিতর্কের পরেও স্পষ্ট অবস্থান
২০২০-র ১৭ ফেব্রুয়ারি আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে মুখোমুখি দেখা হয় জুবিন গর্গের। দু’জনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর জুবিনকে আলিঙ্গন করেন মুখ্যমন্ত্রী। এই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় এবং কোনও কোনও মহল থেকে দাবি করা হয় শাসকদলের দিকে ঝুঁকেছেন জুবিন। কোনও কোনও মহল থেকে তাঁর কড়া সমালোচনাও করা হয়।
যদিও এই ঘটনার পর আবারও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন জুবিন। তিনি বলেন, আমি তাঁকে অনেকদিন ধরে চিনি। সেকারণেই আমি তাঁর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। এ নিয়ে অবাঞ্ছিত বিতর্ক কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিবাদ আন্দোলনে ছিলাম এবং আছি। ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমি সিএএ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে গেছি। আমাদের আন্দোলন চলছে এবং চলবে।
তিনি আরও বলেন, “যদি কোনও কিছু আমার অপছন্দ হয়, আমি তা জোরের সঙ্গেই বলি। যদি আমার কিছু পছন্দ হয়, আমি তাও প্রকাশ্যে বলি। খেলাধুলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ইত্যাদির উপর অনুষ্ঠান হোক। এগুলোতে বাধা দেওয়া করা উচিত নয় কারণ বহু মানুষ এর সাথে জড়িত এবং এর মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তারা কষ্ট পাবে। আমি চাই না যে এরকম কিছু ঘটুক। খেলাধুলা, সিনেমা এবং সঙ্গীতের পাশাপাশি আমাদের আন্দোলনও অব্যাহত থাকবে।"
শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থানে অনড়
সাম্প্রতিক সময়েও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন তিনি। ২০২৪-এর ২৭ মার্চ এক ফেসবুক পোষ্টে তিনি জানিয়েছিলেন, আসামের মানুষ কখনই সিএএ মেনে নেবে না এবং এর বিরুদ্ধে রক্তপাতহীনভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া উচিত। ওই পোষ্টে তিনি আরও জানান, সিএএ যখন বিল ছিল সেই ২০১৭ থেকেই তিনি এর বিরোধিতা করছেন এবং এখনও তিনি তাঁর অবস্থানে অটল।
সিএএ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে সিএএ বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করার পাশাপাশি তিনি তাঁর বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও বলিষ্ঠতার সঙ্গে সিএএ বিরোধী মতামত জানিয়েছেন। যদিও কোনও সময়েই রাজনীতিতে যোগ দেবার বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। এবং বারবারই জানিয়েছেন, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে আগ্রহী নন।
স্মৃতিতে থেকে যাবেন দুই জুবিন
আজ দুর্ঘটনায় তার মর্মান্তিক মৃত্যুর সাথে সাথেই আমরা যেমন হারালাম এক গুণী সঙ্গীত শিল্পীকে তেমনই হারিয়ে ফেললাম এক প্রতিবাদী চরিত্রকেও। যদিও সঙ্গীতস্রষ্টা জুবিনকে সাধারণ মানুষ যেমন ভুলবে না তেমনই ভুলে যাবে না প্রতিবাদী জুবিনকেও।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন