
একদিকে দেশ জুড়ে যখন ‘ভোট চুরি’র অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে কংগ্রেস সহ একাধিক বিরোধী দল সেই সময়েই কেরালা বিজেপির (BJP) সহ সভাপতি বি গোপালকৃষ্ণান (B Gopalkrishnan) বিতর্কিত মন্তব্য করলেন। যে মন্তব্যে বিরোধীদের অভিযোগই মান্যতা পেল বলে মনে করছে দেশের রাজনৈতিক মহল। এর আগে বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুরও (Anurag Thakur) দেশের কয়েকটি কেন্দ্র নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। যে মন্তব্যের পর বিরোধীরা দাবি করেছিল, তাঁর মন্তব্যে বিরোধীদের অভিযোগই মান্যতা পেয়েছে।
শুক্রবার বিজেপি কেরালার সহ সভাপতি বি গোপালকৃষ্ণান জানান, কেরালার ত্রিশুর (Thrissur Parliamentary Constituency) কেন্দ্রে জয় নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোটারদের ত্রিশুর আনা হয়েছিল। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, “যে কেন্দ্রে আমরা জয়ী হব বলে মনে করি সেখানে আমরা প্রয়োজনে জম্মু ও কাশ্মীর থেকেও লোক নিয়ে আসি। আমরা সেখানে তাঁদের একবছরের জন্য রাখি এবং নিশ্চিত করি যাতে তাঁরা সেখানকার ভোট প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারেন। এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমরা ভবিষ্যতে আবারও এটা করবো।”
বিজেপি নেতার এই মন্তব্যের পরে সাংবাদিকরা বিজেপি নেতার কাছে জানতে চান, একাধিক বাড়ির মালিক দাবি করেছেন যে তাঁদের বাড়িতে কিছু মানুষ থাকেন বলে দাবি করা হচ্ছে, অথচ সে বিষয়ে তাঁদের কিছু জানা নেই। উত্তরে গোপালকৃষ্ণান জানান, এ সবই ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা। ত্রিশুরে কোনও জাল ভোটদান হয়নি। জাল ভোট মানে হল মৃত ব্যক্তির নামে ভোট দেওয়া অথবা একই ব্যক্তির দু’বার ভোট দেওয়া।
বিজেপি রাজ্য সহ সভাপতির মন্তব্যের সুরেই বক্তব্য রেখেছেন বিজেপির রাজ্য সম্পাদক এম টি রমেশ। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কোনও ভারতীয় নাগরিক ছ’মাসের বেশি কোনও জায়গায় বসবাস করলে তিনি সেই জায়গার ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করতে পারেন। এভাবেই ত্রিশুরে ভোটারদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জাল ভোট দিয়েছে কংগ্রেস ও সিপিআইএম। বিজেপি কোনও জাল ভোট দেয়নি।
ত্রিশুর লোকসভা কেন্দ্র
ইন্ডিয়াভোটস ডট কম-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় ত্রিশুর কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৪,৮৩,০৫৫ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ছিল ৭,৪১,৫২৮ জন এবং মহিলা ভোটার ৭,৪১,৫২৭ জন। শেষ লোকসভা নির্বাচনে ত্রিশুর কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১০,৯০,৮৭৬ বা ৭৬.৩%।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ত্রিশুর কেন্দ্র ভোটদাতার সংখ্যা ছিল ১২,৬৮,৬৭১। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ছিল ৬,০৯,৫৭৯ এবং মহিলা ভোটার ছিল ৬,৫৯,০৮৯। সেবার এই কেন্দ্রে মোট ভোট পড়েছিল ১০,৪১,৮৬৯ বা ৮২.৫ শতাংশ।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে কেরালার ত্রিশুর কেন্দ্রে ভোটার বেড়েছিল ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৩৮৪ জন।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ত্রিশুর কেন্দ্রে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী সুরেশ গোপী। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে তিনি পেয়েছিলেন ৪,১২,৩৩৮ ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিপিআই প্রার্থী ভি এস সুনীল কুমার পেয়েছিলেন ৩,৩৭,৬৫২ ভোট এবং তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস প্রার্থী কে মুরলীধরণ পেয়েছিলেন ৩,২৮,১২৪ ভোট।
২০১৯ সালে কেরালার ত্রিশুর কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী টি এন প্রতাপন। তিনি পেয়েছিলেন ৪,১৫,০৮৯ ভোট। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআই-এর রাজাজী ম্যাথু থমাস পেয়েছিলেন ৩,২১,৪৫৬ ভোট। এই কেন্দ্রে তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী সুরেশ গোপী পেয়েছিলেন ২,৯৩,৮২২ ভোট।
ত্রিশুর কেন্দ্রের অন্তর্গত সাত বিধানসভায় ২০২১-এর ফলাফল
এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র এবং ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে সেই সব কেন্দ্রের ফলাফল ছিল - গুরুভায়ুর (সিপিআইএম – ব্যবধান - ১৮,২৬৮), মানালুর (সিপিআইএম – ব্যবধান – ২৯,৮৭৬), অল্লুর (সিপিআই – ব্যবধান – ২১,৫০৬), ত্রিশুর (সিপিআই – ব্যবধান – ৯৪৬), নাট্টিকা (এসসি) (সিপিআই – ব্যবধান – ২৮,৪৩১), ইরিনজালাকুডা (সিপিআইএম - ব্যবধান – ৫,৯৪৯) এবং পুথুক্কাড (সিপিআইএম – ব্যবধান - ২৭৩৫৩)।
এই সাত কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে ছিল আইইউএমএল এবং একটি কেন্দ্রে কেরালা কংগ্রেস। বাকি পাঁচটি কেন্দ্রেই দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। কোনও কেন্দ্রেই দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি ছিল না এবং এই সাত কেন্দ্রে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে – মানালুর (৩৬,৫৬৬), ওল্লুর (২২,২৯৫), ত্রিশুর (৪০,৪৫৭), নাট্টিকা (৩৩,৭১৬), ইরিনজালাকুডা (৩৩,৬৮৫) এবং পুথুক্কাড (৩৪,৮৯৩)। অর্থাৎ ত্রিশুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৬টি কেন্দ্রে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ২,০১,৬১২।
গুরুভায়ুর কেন্দ্রে বিজেপির কোনও প্রার্থী ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ছিল না। ওই কেন্দ্রে সিপিআইএম-এর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল আইইউএমএল বা ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ প্রার্থীর। ওই কেন্দ্রে ডিএসজেপি বা ডেমোক্রেটিক সোশ্যাল জাস্টিস পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল বিজেপি এবং যিনি পেয়েছিলেন ৬,২৯৪ ভোট। হিসেবের সুবিধার জন্য এই ভোটও বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে যোগ করলে বিজেপির পক্ষের মোট ভোট দাঁড়ায় – ২,০৭,৯০৬ ভোট। আর এই সাত কেন্দ্রে বাম প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান ছিল মোট ১,৩২,২৩৯ ভোট।
ত্রিশুর লোকসভা কেন্দ্র - ২০২৪-এর ফলাফল
বিধানসভা কেন্দ্রিক ভোটের ফলাফল অনুসারে ত্রিশুর কেন্দ্রের অন্তর্গত গুরুভায়ুর কেন্দ্রে প্রথম কংগ্রেস (৫৭,৯২৫), দ্বিতীয় সিপিআই (৫০,৫১৯) এবং তৃতীয় বিজেপি (৪৫,০৪৯)।
মানালুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৬১,১৯৬), দ্বিতীয় সিপিআই (৫৩,১৮৩) এবং তৃতীয় কংগ্রেস (৫০,৮৯৭)।
ওল্লুর কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৫৮,৯৯৬), দ্বিতীয় সিপিআই (৪৮,৬৩৩) এবং তৃতীয় কংগ্রেস (৪৭,৬৩৯)।
ত্রিশুর কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৫৫,০৫৭), দ্বিতীয় কংগ্রেস (৪০,৯৪০) এবং তৃতীয় সিপিআই (৩৪,২৫৩)।
নাট্টিকা কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৬৬,৮৫৪), দ্বিতীয় সিপিআই (৫২,৯০৯) এবং তৃতীয় কংগ্রেস (৩৮,১৯৫)।
ইরানজালাক্কুডা কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৫৯,৫১৫), দ্বিতীয় কংগ্রেস (৪৬,৪৯৯) এবং তৃতীয় (৪৫,০২২)।
পুথুক্কাড কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি (৬২,৬৩৫), দ্বিতীয় সিপিআই (৪৯,৯৪৩) এবং তৃতীয় কংগ্রেস (৪২৭১৫)।৩,০৩৫৬
২০২৪ লোকসভা ভোটের ফলাফলের হিসেবে বিজেপি এই সাত বিধানসভা কেন্দ্রে মোট পায় ৪,০৯.৩০২ ভোট। অর্থাৎ ২০২১ বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট বেড়েছে ২,০১,৩৯৬। উল্লেখযোগ্যভাবে নির্বাচন কমিশনের দুটি ওয়েবসাইটের ফলাফলের পরিসংখ্যানে কিছু পার্থক্য আছে। বিধানসভা ভিত্তিক ফলের হিসেবে যেখানে বিজেপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৪,০৯,৩০২ সেখানে কমিশনের অন্য ওয়েবসাইটে বিজেপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৪,১২,৩৩৮। অর্থাৎ ফারাক আছে ৩,০৩৬ ভোটের।
এক নজরে যা দাঁড়ালো
২০১৯-এ ত্রিশুর লোকসভা কেন্দ্র বিজেপির প্রাপ্ত মোট ভোট - ২,৯৩,৮২২
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাত বিধানসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোট - ২,০৭,৯০৬ (গুরুভায়ুর কেন্দ্রে বিজেপির সমর্থিত প্রার্থীর ভোট সহ)
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের অনুপাতে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমে ৮৫,৯১৬
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট - ৪,১২,৩৩৮
২০১৯-এর অনুপাতে ২০২৪-এ বিজেপির ভোট বৃদ্ধি - ১,১৮,৫১৬
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে ২০২৪-এ বিজেপির ভোট বৃদ্ধি - ২,০১,৩৯৬
২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ত্রিশুর কেন্দ্রে ভোটার বৃদ্ধি - ২,১৪,৩৮৪
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিশুর কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭ বিধানসভা আসনে বামেদের জয়ের মোট ব্যবধান - ১,৩২,২৩৯
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন