
সম্প্রতি দিল্লি ও বিহারে ৪ ম্যাগনিটিউডের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভারতের টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান এবং হিমালয় সংঘর্ষ অঞ্চলের প্রভাবের কারণে এই ভূমিকম্প বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
ছোটো ভূমিকম্পের তাৎপর্য:
অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট কম্পনগুলি (Foreshock) দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ সালে চীনের হাইচেং ভূমিকম্পের আগে উল্লেখযোগ্য ফোরশক লক্ষ্য করা গেছিল, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আগেই সতর্ক করেছিল। তবে, সব বড়ো ভূমিকম্পের আগে ফোরশক থাকে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৩০% বড় ভূমিকম্পের আগে ফোরশক দেখা যায়।
অ্যাক্সেলারেটিং মোমেন্ট রিলিজ (AMR):
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে ছোট কম্পনগুলির সঞ্চিত শক্তি একটি নির্দিষ্ট ছকে বৃদ্ধি পায়, যা বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে। তবে, এই পদ্ধতি সবসময় নির্ভরযোগ্য নয় এবং বাস্তব সময়ে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন।
দিল্লি ও বিহারের প্রেক্ষাপট:
প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগে, আফ্রিকান প্লেট থেকে আলাদা হওয়ার পর, ভারত মহাসাগর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে ভারতীয় টেকটনিক প্লেটটি ইউরেশিয়ান টেকটনিক প্লেটের সাথে ধাক্কা খেয়ে, ইউরেশিয়ান প্লেটের তলায় চলে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া শুরু করে। এই সংঘর্ষ থেকেই সৃষ্টি হয় হিমালয়।
দিল্লি ও বিহার ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের অংশ, যা হিমালয় সংঘর্ষ অঞ্চলের কাছে অবস্থিত। এই অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেট একে অপরের নিচে ঢুকে যাওয়া থেকে তৈরি ভূতাত্ত্বিক চাপের কারণে ভূমিকম্পের প্রবণতা রয়েছে।
ভারতীয় প্লেটের পাতালে প্রবেশের ফলে তৈরি হওয়া ভূতাত্ত্বিক চাপ, অতীতেও একাধিক বড় ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নেপাল বা ২৬শে ডিসেম্বরের অভিশপ্ত সুনামি তার সাক্ষী।
দিল্লি বিহার হয়ে এই ফল্ট লাইন, বঙ্গীয় সব প্লেটের ফল্ট লাইনে মিশে যায়, যা কলকাতাকেও অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার অধীনে ফেলে দেয়।
তবে, ছোট কম্পনগুলি সবসময় বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নয়; এটি নির্ভর করে স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতির উপর।
উপকথা ও বিশ্বাস:
বিশ্বের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছোট কম্পনকে বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস হিসেবে বিবেচনা করার কাহিনী রয়েছে।
জাপানের পুরাণে নামাজু নামে একটি বিশাল ক্যাটফিশের কথা বলা হয়, যার নড়াচড়া ভূমিকম্প সৃষ্টি করে।
মাওরি সংস্কৃতিতে রুয়ামোকো দেবতা পৃথিবীর অভ্যন্তরে কম্পন সৃষ্টি করেন, যা বড় পরিবর্তনের সংকেত।
নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে মাটির নড়াচড়াকে বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা হয়।
কাসকেডিয়ান সাবডাকশন জোন, আমেরিকার উত্তর পশ্চিম অংশে, পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে বারংবার এইরকম ভূমিকম্পের নজির রয়েছে, যার থেকে একাধিক উপকথা তৈরি হয়েছে।
এই ধরনের সাবডাকশন জোন থেকে তৈরি হওয়া ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী হতে পারে, যে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে হওয়া একটি ভূমিকম্পের থেকে তৈরি সুনামির রেকর্ড জাপানি উপকথায় খুঁজে পাওয়া যায়।
সতর্কতা ও প্রস্তুতি:
গত ১০০০ বছরে ভূমিকম্পে পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮০ লক্ষ মানুষ। সর্বস্ব হারানো, পরিজন হারানো, পঙ্গু হওয়া মানুষের সংখ্যা কোটি কোটি। ছোট ভূমিকম্পগুলি বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস হতে পারে, যদিও তা সবসময় নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তাই, আমাদের সবসময়েই সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
বাড়ির স্থাপত্য মজবুত করা, জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা এবং নিয়মিত মহড়া করা উচিত। সাম্প্রতিক কম্পনগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির শক্তি অপ্রত্যাশিত হতে পারে, এবং আমাদের আগাম প্রস্তুতি ও সচেতনতা জীবন রক্ষা করতে পারে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন