

পশ্চিমবঙ্গের এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের নিজেদের মধ্যেই কি মতদ্বৈধতা আছে? একাধিক বিজেপি সাংসদ, বিধায়কদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য থেকে সেরকম মনে হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই তালিকায় নাম নেওয়া যেতে পারে সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের, নাম আসতে পারে বিধায়ক অসীম সরকারের। এমনকি অতি সম্প্রতি যিনি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন সেই বিজেপি সাংসদ নগেন্দ্র রায় বা অনন্ত মহারাজেরও। আবার এইসব মন্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে একাধিক বিজেপি নেতা যা বলেছেন তাও যথেষ্ট গোলমেলে। এসআইআর নিয়ে বিজেপির কাছেই যে ধারণা স্বচ্ছ নয় তা এঁদের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট এবং যা বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
সম্প্রতি কোচবিহারের সিতাই-এর আদাবাড়ি ঘাটে দলীয় এক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ অনন্ত মহারাজ (নগেন্দ্র রায়)। সেখানেই ভাষণ দিতে গিয়ে রীতিমত বিস্ফোরক মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর নিশানা থেকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেউ রেহাই পাননি। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সকলেই বাংলাদেশী। কে প্রমাণ করবে? তাঁর কথায়, দেশের মাথারাই বাংলাদেশি, আমরা কাকে কাগজ দেখাবো?
উল্লেখযোগ্যভাবে বিজেপি সাংসদ ওইদিন কার্যত রাজ্যের বিরোধীদের সুরেই কথা বলেছেন। এতদিন এসআইআর নিয়ে বিরোধীরা যা যা অভিযোগ এনেছে, সভায় অনন্ত মহারাজও প্রায় একই কথা বলেছেন। ওইদিনের সভায় বিজেপি সাংসদ অনন্ত মহারাজ বলেন, "ভোটার তালিকায় নাম না উঠলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত হতে পারে, বন্দীশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ডিটেনশন ক্যাম্প বানাবেন, যাদের নাম ওঠেনি তাঁদের রাখবেন। তারপর প্রমাণ করবে তোমরা কোন দেশি – এদেশি না ওদেশি।" অনন্ত মহারাজ যা বলেছেন, সাধারণ মানুষের মনে যে সেই একই প্রশ্ন নেই তা বলা যাবেনা। বরং অনেকেই এসআইআর নিয়ে যে এরকমই ভাবছেন, তা একটু নিচুতলার মানুষজনের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাচ্ছে।
অনন্ত মহারাজের আগে এসআইআর প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের মন্তব্যেও যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছিল। বাগদার এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “পঞ্চাশ লক্ষ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি মুসলিম, পাকিস্তানি মুসলিমকে বাদ দিতে যদি আমার সম্প্রদায়ের এক লক্ষ মানুষকে ভোটদান থেকে বিরত থাকতে হয় তাতে কোনটা লাভ? এসআইআর আমাদের কোনও সমস্যা নয়। ভারত সরকারকে সহযোগিতা করতে যদি এসআইআর সহ্য করতে হয়, করব না কেন?” মূলত মতুয়া সমাজের উদ্দেশ্যেই তিনি একথা বলেছিলেন। যদিও তাঁর এই কথায় বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। মন্ত্রীর কাছে যা ‘লাভজনক’ সাধারণ মতুয়ারা তাকে লাভজনক বিষয় বলে মনে করেননি আদৌ।
ওই সভা থেকেই শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘‘সিএএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সিএএ করা মানে কেন্দ্রীয় সরকারকে সহযোগিতা করা। সিএএ কারা করবেন, যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাঁদের সিএএ করতে হবে। আপনার নাম কেন্দ্রের খাতায় নেই। ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড থাকলেই নাগরিক হওয়া যায় না। সেই কারণে সিএএ বানানো হয়েছে।’’
অবশ্য এবারই প্রথম নয়। এর আগেও এসআইআর প্রসঙ্গে এরকমই বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন শান্তনু ঠাকুর। আগে তিনি বলেন, এসআইআর-এ যদি কোনও মতুয়ার নাম বাদ যায়, তাহলে এক-দু’বার ভোট দিতে না পারলেও পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। যে বক্তব্যের উত্তরে সিপিআইএম সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, “মতুয়াদের সর্বনাশ করছে শান্তুনু ঠাকুর।” তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। তিনি আরও বলেন, ভোটার লিস্টের নামের সঙ্গে নাগরিকত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ভুল করেও কেউ সিএএ ফর্ম ফিলাপ করবেন না। কারণ এই ফর্ম জমা দেবার অর্থই হচ্ছে আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন আপনি নাগরিক নন।
গত ২২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১৮ মিনিটে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ থেকে করা এক পোষ্টে বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর জানিয়েছেন, "সমগ্র উদ্বাস্তু সমাজের নিকট একটাই বার্তা, দ্রুততার সহিত সকলে #CAA তে আবেদন করুন। ভারতীয় সংবিধান এবং কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত আইনকে ভুল বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছে তৃনমূল কংগ্রেস সহ সকল বিরোধীরা। এদের প্ররোচনায় পা না দিয়ে স্বাধিকার সুরক্ষিত করুন।"
এরও আগে চলতি বছরের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে হরিণঘাটার বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকারও এসআইআর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সমাজমাধ্যমের এক পোষ্টে তিনি বলেন, “SIR-এ নাম কেটে দিলেও এইটুকু বলতে পারি সিএএ তে আবেদন করলে আপনি নাগরিকত্ব পাবেন এবং ভোটার লিস্টে নাম উঠবেই।” বিজেপি বিধায়কের এই পোষ্টের পরেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে, যার নাম এসআইআর-এ বাদ পড়বে সে আবার নাকি সিএএ-তে নাগরিকত্ব পাবেন? ভোটার তালিকায় ফের নাম তুলে দেবার দায়িত্ব বিধায়ক নেবেন তো?
সম্প্রতি তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, এসআইআর-এ মতুয়াদের কোনও সমস্যা নেই। সব হিন্দুদের নামই থাকবে। এই কারণেই সিএএ তৈরি হয়েছে। যারা সিএএ করবে তাঁদের সবার দায়িত্ব বিজেপি নেবে। সিএএ করলে তারা নাগরিকত্ব পাবেই। যারা সিএএ করবেনা তারা মরে যাক। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি নেতৃত্ব কেন সবাইকে সিএএ-তে আবেদন করার কথা বলছে? কারণ এই প্রসঙ্গে একই সুরে কথা বলেছেন শান্তনু ঠাকুর এবং অসীম সরকার। যারা দুজনেই বিজেপির সাংসদ ও বিধায়ক। ঠাকুরনগর সহ বিভিন্ন জায়গায় রীতিমত ক্যাম্প করে সিএএ ফর্ম পূরণের কাজ করা হয়েছে বিজেপির তরফে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন একটাই, এত তৎপরতা কেন?
প্রসঙ্গত এসআইআর প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বিজেপি নেতৃত্ব বলে এসেছে এর ফলে কয়েক কোটি রোহিঙ্গার নাম বাদ যাবে। যদিও এখনও পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া যতটা এগিয়েছে তাতে সেরকম কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। অনন্ত মহারাজের বক্তব্যের উত্তরে বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা যেমন বলেছেন, হিন্দু যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাঁদের আমরা শরণার্থী বলি। সিএএ মারফৎ তাঁদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্র। এখন নির্বাচন কমিশনও দিয়ে দিয়েছে। অতএব যারা হিন্দু তাঁদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বিজেপি সাংসদ অনন্ত মহারাজের বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো সুরেই কথা বলেছেন তিনি। অনন্ত মহারাজের বক্তব্য প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এসআইআর-এর সঙ্গে ডিটেনশন ক্যাম্পের কোনও সম্পর্ক নেই।
এসআইআর নিয়ে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির কারণ বোধহয় লুকিয়ে আছে এখানেই। এটা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এসআইআর-এ স্বচ্ছতার অভাব আছে। যে স্বচ্ছতার অভাব আরও স্পষ্ট হচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে। যাতে সাধারণ মানুষ আরও বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের আতঙ্ক আরও বাড়ছে। এখনও পর্যন্ত বহু মানুষ বুঝে উঠতে পারছেন না ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম না উঠলে ঠিক হবে? তাঁদের ঠিক কোন সমস্যার মুখে পড়তে হবে?
ভারতের প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুখী সাংবাদিকতা — যা আপনার সামনে সঠিক খবর পরিবেশন করে। পিপলস রিপোর্টার তার প্রতিবেদক, কলাম লেখক এবং সম্পাদকদের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আপনাদের মতো পাঠকদের সহায়তা। আপনি ভারতে থাকুন বা দেশের বাইরে — নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে একটি পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন