
মহালয়ার পর থেকে কার্যত পুজো শুরু। কয়েকটি প্যান্ডেল ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে উদ্বোধন। কিছুতে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। কিন্তু সোমবার রাতভর প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতা কার্যত বানভাসি শহরে পরিণত হয়েছে। ফলে একাধিক মণ্ডপ ভেঙে পড়েছে, বহু জায়গায় হাঁটুজল ঢুকে গিয়েছে প্যান্ডেলের ভিতরে। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বুধবার থেকে আবারও বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে পারে। ফলে উদ্যোক্তাদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। এখন প্রশ্ন, মাত্র চার দিনের মধ্যে এই ক্ষয়ক্ষতি কতটা সামাল দিতে পারবেন তাঁরা? আর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা— যদি ফের ভারী বৃষ্টি নামে, তবে কি এ বছরের দুর্গোৎসব আনন্দের বদলে বিপদের আশঙ্কা নিয়েই কাটবে?
৮৪তম বর্ষে পা দিল সিংহী পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব। এ বছরের থিম 'নবচেতনায় অকালবোধন'। মঙ্গলবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু সোমবার রাতের বৃষ্টিতে রাস্তায় কোমরসমান জল। জলের তোড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে প্যান্ডেলের নীচের অংশ। শিল্পী সুদীপ্ত মাইতি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নতুন কাঠামো তৈরি শুরু করেছেন। তবে উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা— সময়মতো শেষ করা যাবে কি না।
উল্টোডাঙা সংগ্রামী ক্লাবের মণ্ডপও কার্যত জলমগ্ন। পার্শ্ববর্তী খাল উপচে পড়ায় হাঁটুজল ঢুকেছে ভেতরে। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, কয়েক ঘণ্টা ধরে পাম্প চালানো হলেও জল নামছে না।
সল্টলেক ইসি ব্লকের পুজো এ বছর ৪৯তম বর্ষে। থিম 'নীর', অর্থাৎ জল। মণ্ডপ ও আশপাশের এলাকা কার্যত জলে ভাসছে। উদ্যোক্তারা সকাল থেকে পাম্প চালিয়ে জল বার করার চেষ্টা করছেন। দুপুর নাগাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও শঙ্কা রয়েই গেছে।
বেহালা আদর্শপল্লী: শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা চলছিল। প্রবল বৃষ্টিতে কাজ থেমে যায়, এমনকি প্যান্ডেলের সামান্য অংশ ভেঙেও পড়ে। উদ্যোক্তাদের মতে, বৃহস্পতিবার উদ্বোধনের আগে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ সারতে হবে।
দেবদারু ফটক: ময়দানে পুজো হয়। মাঠে জল জমেনি, তবে প্যান্ডেলের সামনে জল জমায় কাজ বন্ধ ছিল। এখন ফের শুরু হয়েছে।
নূতন দল: এ বছর গ্লাস ফাইবার আর মার্বেলের ফ্লোরে প্যান্ডেল। উঁচু মঞ্চ থাকায় ক্ষতি হয়নি। উদ্যোক্তারা বলছেন, ‘‘আমরা বেঁচে গেছি, তবে চারপাশে জল জমেছে।’’
সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র হাতিবাগান নবীন পল্লীতে। উদ্যোক্তা শৌভিক ভড় জানিয়েছেন, ‘‘প্যান্ডেল ভেঙে গিয়েছে। মঞ্চ উঁচু করে বানানো ছিল বলে প্রতিমা বেঁচে গেছে। নইলে ঠাকুরটাও জলে নষ্ট হত।’’ হতাশ উদ্যোক্তাদের মতে, এত কষ্ট করে তৈরি থিম আর কোনও ছাপ রাখতে পারবে না।
হাতিবাগান সর্বজনীনের উদ্যোক্তা শাশ্বত বসুও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আশপাশের তিনটি বড় পুজো— শিকদারবাগান, নবীন পল্লী, নলিন সরকার স্ট্রিট— সর্বত্রই জল দাঁড়িয়ে।
শ্যামবাজার পল্লি সংঘ: এ বছর ৬৫তম বর্ষ। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, আর এক দফা বৃষ্টি হলেই মণ্ডপের ভেতরে জল ঢুকে যাবে।
বেলেঘাটা পল্লি উন্নয়ন সমিতি: প্যান্ডেলের ভেতরেই জল ঢুকে গেছে। পাম্প আনা হয়েছে, ড্রেন পরিষ্কারের কাজ চলছে।
গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কেল (বেলেঘাটা): মেন রোডে হাঁটুজল। উদ্যোক্তারাই পুরসভার সঙ্গে মিলে ড্রেন পরিষ্কার করছেন।
দমদম নাগেরবাজার ক্ষুদিরাম কলোনি: এ বছর ৭৬তম বর্ষ। উদ্যোক্তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা— ডেঙ্গি। মাঠে বাঁশের গর্তে জল জমছে, তাই মশার লার্ভা যাতে না জন্মায় সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বেলগাছিয়া সাধারণ দুর্গোৎসব ও দক্ষিণপাড়া যুব পরিষদ: আগে থেকে উঁচু প্ল্যাটফর্ম বানানো ছিল। ফলে বৃষ্টি সামলেও মণ্ডপ বেঁচে গেছে।
পূর্বাচল উদয়ন সংঘ: মণ্ডপ খোলা থাকায় রঙ-তুলির কাজ ধুয়ে গেছে। শিল্পী সোমনাথ মুখোপাধ্যায় চিন্তায়, ‘‘পুজোর আগে শেষ করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে।’’
যাদবপুর অ্যাথলেটিক ক্লাব: সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র। প্রতিমাই জলের তলায়। এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। উদ্যোক্তারা অসহায়।
খিদিরপুর ২৫ পল্লির উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁদের এলাকায় জল জমেনি। ফলে প্যান্ডেল অক্ষত। একই অবস্থা ৭৪ পল্লি ও সিমলা ব্যায়াম সমিতির ক্ষেত্রেও।
কলকাতা পুরসভার কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। মধ্য ও উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া, আমহার্স্ট স্ট্রিট বা কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের মতো এলাকা ৩৬ ঘণ্টা পরেও জলমগ্ন রয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতায় বালিগঞ্জের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এছাড়াও পার্ক সার্কাসের ভিতরে বহু এলাকা এখনও জলমগ্ন। শেক্সপিয়র সরণিতেও জল পুরো নামেনি। জলমগ্ন কসবার বহু এলাকা। দক্ষিণ শহরতলির অবস্থাও অনেক জায়গায় শোচনীয়। তার মধ্যে রয়েছে পাটুলি।
আজ দুপুরে ফের বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। একটু বেশি বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন অংশ আবার বেহাল হয়ে পড়তে পারে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন