
বিক্ষোভ ও ধর্মঘটে উত্তাল গ্রিসের একাধিক শহর। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভকারীরা। গ্রিসের বিমান, রেল, নৌ পরিবহনের কর্মীরা ধর্মঘট সমর্থন করায় ২৪ ঘন্টার জন্য সমস্ত পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রিসের সর্বকালের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে বিচারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন শহরে জমায়েত করেছেন।
শুক্রবার গ্রিসের একাধিক শহরে ২০২৩-এর রেল দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তিতে ব্যাপক বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়। দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠন। সমর্থন জানায় গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি (KKE)। ধর্মঘটের সমর্থনে রাস্তায় নামেন লক্ষাধিক মানুষ। শুধুমাত্র রাজধানী এথেন্সে ১,৮০,০০০ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন।
শুক্রবার ভোরের দিকে, এথেন্সের কেন্দ্রস্থল সিনটাগমা স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে থাকে। কেউ কেউ প্ল্যাকার্ডে লিখে আনে ‘খুনিদের সরকার’। জমায়েত থেকে শ্লোগান ওঠে – “তোমরা মুনাফা গুনতে থাকো, আমরা মানুষ গুনি”। জমায়েতের এক প্রান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সাথে স্লোগান দিচ্ছিলেন - “আমরা কখনও এই অপরাধ ভুলব না” এবং “নতুন প্রজন্ম তোমাদের প্রতিশোধ নেবে”।
সময় যত এগিয়েছে জমায়েতে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। একটা সময় পুলিশের ব্যারিকেড টপকে, গ্রিসের সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভকারীদের মিছিল এসে পৌঁছায়। এরপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য করে টিয়ার শেল, রবার বুলেট চালায়। যে ঘটনায় শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। ৪০ জনের বেশি আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর। এর পরেই পাল্টা প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশও।
এই ধর্মঘট সংগঠিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি (KKE)। এথেন্সের কেন্দ্রীয় বিক্ষোভ সমাবেশে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক দিমিত্রিস কৌটসুম্বাস নিজে উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এক বিবৃতিতে দিমিত্রিস বলেন, "আজ গ্রীসের জনগণ, ট্রেড ইউনিয়ন, স্ব-নিযুক্তদের সংগঠন, বিজ্ঞানী, ছাত্র, মহিলা, ছাত্রছাত্রী, সমগ্র গ্রীক সমাজ মুখ খুলেছে। টেম্পের ঘটনায় হতাহতদের আত্মীয়স্বজনদের কথা বলার সময় এসেছে! আজ, যখন গ্রিসের জনগণ ২০০ টিরও বেশি শহর ও গ্রামে, সমগ্র ইউরোপ, বিশ্বজুড়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তখন কোনও আড়াল নয়, এই ভয়ংকর ট্র্যাজেডির দায় সরকারেরই নেওয়া উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "গ্রিক সরকার, যারা আজ পর্যন্ত শাসন করেছেন তাদের এই ঘটনার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা কাউকে ছাড় দেব না, তাদের পদ যত উচ্চই হোক না কেন। তাদের কঠোর শাস্তি দিত হবে, যাতে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের টেম্পের মতো আর কোনও ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে না হয়।"
২০২৩ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি মধ্য গ্রিসের টেম্পি গিরিখাতের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ভর্তি একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে একটি মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। নিহত হয় ৫৭ জন। দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী।
দুই বছর পরেও, বিচার বিভাগীয় তদন্ত অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে এবং দুর্ঘটনায় কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। পাশাপাশি, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নিরাপত্তা ঘাটতির কথাও সামনে এসেছিল। যদিও আজও তা পূরণ করেনি গ্রিসের দক্ষিণপন্থী সরকার।
উল্লেখ্য, বহুদিন ধরে গ্রিসের দক্ষিণপন্থী সরকারের ব্যয় সঙ্কোচ নীতি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অংশের মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ন্যূনতম মজুরি ও পেনশন থেকে বঞ্চিত। সরকারি পরিষেবাগুলি তহবিলের অভাবে ধুঁকছে। রেলের আধুনিকীকরণের নামে রেল বেসরকারিকরণও মানতে পারেনি একটা বড় অংশের মানুষ। রেল পরিবহনের খরচ বাড়লেও যাত্রী সুরক্ষা তলানিতে ঠেকেছিল।
তাই রেল দুর্ঘটনায় ৫৭ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার মৃত্যুতে মানুষের মধ্যে বহু দিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বড় অংশ।
গ্রিস সরকারের ‘ব্যয় সঙ্কোচ নীতি’ নিয়ে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ থাকলেও এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতায় ফিরেছে দক্ষিণপন্থী নিউ ডেমোক্র্যাসি পার্টি। তবে প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটাকিস এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে, গ্রিসের অন্তত ৬৬ শতাংশ মানুষ সরকারের উপর অসন্তুষ্ট। এই মুহূর্তে ভোট হলে প্রায় ৩ শতাংশ ভোট কম (২৫ থেকে নেমে ২২) পাবে শাসক দল নিউ ডেমোক্র্যাসি। তবে গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি (KKE)-র ভোট বাড়বে। ১০ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল হতে চলেছে তারা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন