
বাংলাদেশে আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট বদলের পর নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ৪১ জন বিশেষজ্ঞ দিয়ে ৪৪১টি পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে নতুন পাঠ্যতালিকায় স্থান পেয়েছে গত বছরের জুলাই মাসের গণ আন্দোলনের কথা। বদলে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ক তথ্যও। এই বিষয়ে বাংলাদেশ জুড়ে বেশ কিছু বিতর্কও দানা বেঁধেছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে তৃতীয় শ্রেণীর এক পাঠ্যবইতে ‘আমাদের চার নেতা’ নামক নতুন অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে এ কে ফজলুল হক, মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর নাম। চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইতে ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখায় মুজিবর রহমানের পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের ছবি দেওয়া হয়েছে।
বাংলা এবং ইংরেজি বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং কবিতা। যুক্ত হয়েছে জুলাই গণ আন্দোলন বিষয়ক বেশ কিছু গল্প কবিতা। যুক্ত করা হয়েছে আন্দোলনের বেশ কিছু গ্রাফিটি। ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ নামক বই থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের জাতির পিতা’ নামক অধ্যায়। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেসব ছবি ও উদ্ধৃতি দেওয়া ছিল তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় থাকা শেখ হাসিনার এসব উক্তিকে অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে এনসিটিবি-র চেয়ারম্যান জানিয়েছিলেন, ‘সেগুলো থাকবে না। সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক।’
সম্প্রতি এনসিটিবি-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান সংবাদমাধ্যমে জানান, এবারের বাংলা ও ইংরেজি বইতে জুলাই আন্দোলনের কথা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য যেসব নায়কদের এর আগে অবহেলা করা হয়েছিল এবার তাঁদের যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গত ১ নভেম্বর তিনি জানিয়েছিলেন, “ইতিহাসে যার যেভাবে ভূমিকা ছিল, তা সেভাবেই তুলে ধরা হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাসে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অবদানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হবে।”
নতুন পাঠ্যবইতে বদল করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি। আগে পঞ্চম শ্রেণির এই বইয়ে ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা’ শীর্ষক বিষয়ে লেখা ছিল, “...পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল “অপারেশন সার্চলাইট”। ঐ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।...”। যদিও এবার তা বদল করে করা হয়েছে, ‘...পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল “অপারেশন সার্চলাইট”। ঐ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬শে মার্চ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।’
যদিও তথ্য অনুসারে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তিনিই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বলে সরকারী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ইতিহাসে অনেক সংশোধনী আসে। সমসাময়িক সূত্র অনুসারে, শেখ মুজিব ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ইউএস ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে, শেখ মুজিব ২৬ মার্চ বাংলাদেশকে এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা নামক পাঠ্যপুস্তকে ছ’টি প্রবন্ধ, কবিতা বা ছড়া নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এখানেই ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে গত বছরের জুলাই গণ-আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ছবিসহ এই গণ-আন্দোলনে নিহত সকলকে স্মরণ করে লেখা যুক্ত হয়েছে। যদিও নিহত তিন জনের নামের ক্ষেত্রে এক নিহতের নাম ভুল ছাপা হয়েছে বলে জানা গেছে। দ্রুত এই ভুল সংশোধন করে নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই মাসে গণ আন্দোলন ও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করা হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানকে। এই সময়েই বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন করে এইসব পদে নিয়োগ করা হয়েছে।
অনেকের মতে শিক্ষা প্রশাসনে এই রদবদলের কারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। শেখ হাসিনার আমলে এঁদের অনেকেই শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদে বহাল ছিলেন। এঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এঁদের সকলকেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও মহলের মতে, রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের বিভিন্ন দ্বীপ এলাকা ও দুর্গম অঞ্চলে বদলি করা হচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যক্রম নিয়ে এই বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। সেখানে অভিযোগ উঠেছিল লিঙ্গ বৈষম্যেরও। ওই সময়েই বাংলা পাঠ্যবই থেকে হিন্দু ও ধর্ম না মানা লেখকদের লেখা বাদ দেবার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ ওই সময় বাদ দেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালিদাস রায়, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সুকুমার রায়, হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্ঞানদাস ও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের লেখা। পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক হয় ২০২৩ সালেও।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন