একাকী ভিড়: প্যালেস্টাইন - বিশ্ব-ক্ষমতা কাঠামো ও এশীয় জ়ায়নবাদী শক্তিকেন্দ্র (পর্ব ২)

People's Reporter: অবশেষে ইহুদিদের জন্য একটা দেশ তৈরি করার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে বাস্তবায়িত হল। ইজ়রায়েল প্রতিষ্ঠিত হল। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ইহুদি জনগণ সেখানে আরও বেশী হারে আসতে শুরু করলেন।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স - আকাশ

অবশেষে ইহুদিদের জন্য  একটা দেশ তৈরি করার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে বাস্তবায়িত হল। ইজ়রায়েল প্রতিষ্ঠিত হল। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ইহুদি জনগণ সেখানে আরও বেশী হারে আসতে শুরু করলেন। প্যালেস্টাইনের গর্ভে সদ্য জন্ম নেওয়া ইজ়রায়েলের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকলো। ইজ়রায়েল হয়ে উঠল পাশ্চাত্যের এক আদর্শ সামরিক গড়নের প্রাচ্য সংস্করণ।

সংস্কৃতির পরিব্যাপ্তিতে ইজ়রায়েল হয়ে উঠল ঔপনিবেশিক আমেরিকা, যেখানের বেশিরভাগ সামাজিক ঐতিহ্য ইংল্যান্ড, স্পেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে আনা হয়েছিল। যুদ্ধের পদ্ধতি আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে কাদের অবদান ছিল, এই সত্যটি যদিও সাধারণত জানা যায় না। ঠিক যেমন জানা যায় না যে চীনারা গরুর মাংস খাওয়া (সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান) কোথা থেকে শিখেছিল। তবে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির বেশিরভাগই যে ইতালি থেকে উদ্ভূত, সেটা প্রমাণিত। আবার এই ইতালি, পালাক্রমে, গ্রীকদের কাছ থেকে জীবনধারার উপাদানগুলিকে ধার নিয়েছিল।

একসময় মনে করা হয়েছিল যে গ্রীস তার সংস্কৃতিকে নিজস্ব উপাদানে তৈরি করেছে। কিন্তু আর্থার ইভান্সের গবেষণার স্বীকৃতিতে এটা মেনে নেওয়া হয় যে গ্রীকরা ক্রিটদের থেকে প্রচুর পরিমাণে সাংস্কৃতিক উপাদান ধার নিয়েছিল। সেখানে বস্তুগত, অবস্তুগত, উভয় ধরনের উপাদানই হাজির ছিল। সেই কারণেই ব্রোঞ্জ যুগের সংস্কৃতিতে পুষ্ট ছিল মিনোয়ান সভ্যতা, যা ক্রিট দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এই ক্রিটরা তার সংস্কৃতির বেশিরভাগ উপাদান অবশ্য মিশর থেকে পেয়েছিল। ইউফ্রেটিস উপত্যকায় সংস্কৃতির চর্চা, পরবর্তী বিশ্বকে ব্যাপকভাবে মিশরের কাছে ঋণী করে তোলে।

এখন আবার প্রাচ্যবিদ্যার শিকড়সন্ধানীদের দাবি অনুসারে বলা হয় যে ওই ইউফ্রেটিস অঞ্চলের সঙ্গে ভারত ও চীনের সংযোগ ছিল, এবং মিশরের সঙ্গে ক্রিটের সংযোগে ফিলিস্তিনের অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐতিহাসিক জেরুজালেম হল বিশ্বের তিনটি ধর্মের কেন্দ্রস্থল। খ্রিষ্টপ্রাণ বেথলেহেম, যীশুর জন্মস্থান। এই সেই অঞ্চল, যেখানে আরব, হামাইট, কেনানাইট এবং জেবুসাইট জাতি দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করে এসেছে।  

সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইজ়রায়েল বহন করে না। করার কথাও নয়। ১৯৪৮র ইহুদিবাদ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির আচারে ধর্মকে লালন করে। নয়া-উপনিবেশবাদী আখ্যানে সে হল জ়ায়নবাদী চেতনা। এই জ়ায়নবাদ হল ‘সেটলার ঔপনিবেশিকতা’, যা ‘ক্লাসিক্যাল ঔপনিবেশিকতা’ থেকে অনেক কারণেই আলাদা। বসতি স্থাপনের চেতনায় এখানে অন্তত সাম্রাজ্যের ওপর দীর্ঘদিন নির্ভর করতে হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ফিলিস্তিনেও সেটা ঘটেছে। ফিলিস্তিনে জ়ায়নবাদ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে। ১৫মে, ১৯৪৮। ডেভিড বেন-গুরিয়ন হলেন প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী।

ইজ়রায়েলের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ১৯৪৮র রক্তাক্ত শরৎকাল আতঙ্কের হিমেল আবেশ বয়ে আনে। ৭,৫০,০০০ ফিলিস্তিনি আরবভাষী বাস্তুচ্যুত হন এবং অঞ্চলটি তিন টুকরো হয়। একটি ইজ়রায়েল রাষ্ট্র, অপর দুটি হল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) এবং গাজ়া উপত্যকা। শীতসন্ধ্যায় সেই জাতিগত নির্মূল অভিযানে একটা সাময়িক বিরতি টানা হল। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনকে আহ্বান জানিয়ে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘে ঘোষণা দেওয়া হল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন ১৯৪ দ্রষ্টব্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কেন্দ্র-প্রান্ত ক্ষমতাবিন্যাসে বিষয়টিকে আমরা দুইভাবে দেখতে পারি। এক, এটি হল ইজ়রায়েল, মিশর, জর্ডান, লেবানন এবং মিশরের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি। এবং দুই, এটি হল ইজ়রায়েলের অভ্যন্তরে অবশিষ্ট প্যালেস্টিনীয় বা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উপর সামরিক শাসন আরোপ করা, যা দীর্ঘদিন (১৯৬৬ সাল পর্যন্ত) বহাল থাকবে।

সেই দিক থেকে গাজ়া উপত্যকা আর জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল হয়ে উঠলো জ়ায়নবাদী আক্রমণের কেন্দ্রস্থল। পাল্টা আক্রমণের ঘটনা আরব দেশগুলিতে বেড়ে গেল। ১৯৫০ সালে ওই দেশগুলি থেকে বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইজ়রায়েলে চলে আসেন। এতে ইজ়রায়েলের ক্রমপ্রসারিত নিয়ন্ত্রণ রেখার অভ্যন্তরে থাকা মুসলিমদের দুর্ভোগ বাড়ে। আরবিভাষী খ্রিষ্টানও কখনও আক্রান্ত হন। ফিলিস্তিনের নাগরিক সমাজ ধর্ম, জাতি, ইত্যাদি দোষে পক্ষপাতমূলক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

বুদ্ধিজীবী শব্দটা ক্রমে ক্লিশে হয়ে যায়। নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীও তার নিরুত্তর অবস্থানে মাথাটাকে বাতাসে নিক্ষেপ করেন! দাঙ্গার পরিসর আক্রমণ ও তার প্রত্যুত্তরে প্রাণহানিকে সংখ্যাবাচক করে তোলে। তিনের দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ এবং জ়ায়নবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি ‘ইসলামিক পবিত্র যুদ্ধ’র নামে আরব বিদ্রোহের দিনে সিরিয়ার নির্বাসিত প্রচারক ইজ আদ-দিন আল-কাসামের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা যে প্রতি আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছিল, সেটাও বৃদ্ধি পায়। হাগানাহ, ইরগুন, লেহির পাল্টা আক্রমণকারীরাও সংগঠিত রূপ লাভ করে।

মিশরের নাসেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইজ়রায়েল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গী হয়ে ওঠে। ইজ়রায়েল বায়ু সেনা শক্তিশালী হতে থাকে। সিনাই উপদ্বীপ অঞ্চল দখল করার পাশাপাশি গাজ়া উপত্যকায় গণহত্যা সম্পাদিত হয়। ১৯৫৬র ২৯ অক্টোবর, ইজ়রায়েল তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় যে জর্ডান সীমান্তের কাছে সমস্ত আরব গ্রামগুলি যুদ্ধকালীন কারফিউর অধীনে থাকবে, নিয়ম ভঙ্গকারীদের জন্য নির্বিচারে গুলি বরাদ্দ করা হয়। একদিনেই প্রায় ৬০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনিকে মেরে ফেলা হয়। গণহত্যার ইতিহাসে এই ঘটনা কাফ কাসিম কুখ্যাতিতে পরিচিত।

গণহত্যার এই ধরনের ঘটনাকে, দাঙ্গার পরিসরকে সকল ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ যে সহজভাবে নিচ্ছিলেন, তেমনটি নয়। দেখা যায় আশকেনজি ইহুদি, যারা ফ্রান্স, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং রাশিয়া থেকে ইজ়রায়েলে এসেছেন, তাঁরা বামপন্থী রাজনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আরব জনগণের সঙ্গে শান্তি ও সৌভ্রাত্রে বসবাস করতে চাইতেন। যখন মরক্কো, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন সহ আরব ও মুসলিম বিশ্ব থেকে আগত ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় মুসলিম বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচ্যের ইহুদি পরিচয়ের সেই মিজ়রাহি ইহুদিরা অনেক বেশী দাঙ্গাপ্রবণ। জ়ায়নবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হলেন একজন মিজ়রাহি ইহুদি।

১৯৫৯ সালে ইজ়রায়েলের হাইফা শহরের ওয়াদি সালিব এলাকায় পুলিশ অফিসারের গুলিতে একজন মরোক্কান ইহুদি অভিবাসীর মৃত্যু হলে মিজ়রাহি ইহুদি জাগরণ ঘটে। বিক্ষোভ এবং ভাঙচুরের একটি ‘সিরিজ’ দেখা যায়। দখলীকৃত ইজ়রায়েল জুড়ে সেটা ঘটে। হাইফায় বৈষম্যের প্রতিবাদে ঘটে যায় মিজ়রাহি দাঙ্গা, যা ওয়াদি সালিব দাঙ্গা নামেও পরিচিত। ১৯৬৩ সালের ২৬ জুন বেন-গুরিয়ন যুগের সমাপ্তি ঘটলেও সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয় না।

পরিস্থিতি ক্রমে আরও খারাপ হয়। বিশেষ করে যখন সুয়েজ খাল এবং লোহিত সাগর দিয়ে ইজ়রায়েলের জাহাজ চলাচলের অধিকার নিয়ে ইজ়রায়েল ও মিশরের মধ্যে বিরোধ বাধে তখন যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন থেকে ১০ জুনের মধ্যে, ইজ়রায়েল সেনা মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়াকে পরাজিত করে সিনাই উপদ্বীপ, গাজ়া উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান হাইটস দখল করে। ছয় দিনের যুদ্ধ অঞ্চলটির স্বাভাবিক জনজীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি করে তোলে। এমন অবস্থায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর রেজোলিউশনে, যা ৩৩৮ নম্বরে পুনঃনিশ্চিত করা হয় ১৯৭৪ সালে, বলা হয় যে শান্তির জন্য সকল উদ্যোগ সব পক্ষকেই গ্রহণ করতে হবে। এবং তার জন্য প্রথম প্রস্তাবেই অধিকৃত এলাকা থেকে ইজ়রায়েলি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। এই ভূখণ্ডে প্যালেস্টিনীয় বা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বসবাসের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।

তবে সেই প্রস্তাবের আগেই ঘটে যায় অক্টোবর যুদ্ধ। ১৯৭৩র অক্টোবরে ইজ়রায়েল মিশরের অনেকটা অংশ দখল করে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে গোলান মালভূমির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, যা শান্তিকামী বিশ্বমানবকে অবাক করে দিয়েছিল। পরের বছর আরব লীগ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) কে ফিলিস্তিনিদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শুধু মাত্র আরব কুলে নয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে পিএলও স্বীকৃত হয়েছিল এবং ফিলিস্তিন নিয়ে জাতিসংঘের আলোচনায় অংশ নেওয়ার অধিকার সংগঠনটিকে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪র ১৩ নভেম্বর ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সেই প্রসঙ্গে ভাষণ দেন।

গ্যালিলে অঞ্চলের ইহুদিকরণের বিরুদ্ধে আরব জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী পিএলও সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিবাদে মুখর হয়। তারা ১৯৭৬র ৩০ মার্চ দিনটিতে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশের অন্যান্য সমস্ত জনগোষ্ঠীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা আহ্বান জানান। আরব জনগণ এই দিনটিকে ইজ়রায়েলে ‘ভূমি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্যও আহ্বান জানান এবং ইহুদিকরণের সরকারী বৈষম্যমূলক নীতি অবসানের দাবিতে সোচ্চার হন।

পরের বছর মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেরুজালেম সফর করেন এবং ইজ়রায়েলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের সেই পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েল ও মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তেল আবিবের উপর পিএলওর আক্রমণের পাল্টা জবাব দিতে ১৪ থেকে ২১ মার্চ ইজ়রায়েল সামরিক অভিযান শুরু করে। লিটানি নদীর দক্ষিণে পিএলওর উপস্থিতি নির্মূল করতে ইজ়রায়েলি বাহিনী দ্রুত দক্ষিণ লেবানন দখল করে।

পরিস্থিতি পুনরায় দুর্যোগপূর্ণ হয়ে ওঠে। তপ্ত হতে থাকে ফিলিস্তিনের মানব সম্পর্ক ও অধিকার। মাটি ভিজে যায় রক্তে, বাতাস ভরে ওঠে বারুদের গন্ধে। ফিলিস্তিনের দৈনন্দিন জীবন হয়ে ওঠে ভয়াতুর। শৈশব হারিয়ে যায় গুলি আর মর্টারের আওয়াজে। চোরাগোপ্তা আক্রমণে প্রতিদিন রক্ত ঝরে। ১৯৮১র জুলাইয়ে ইজ়রায়েল পিএলওর সদর দফতরে বোমা হামলা করে। বৈরুতের একটি ঘন জনবসতি এলাকায় সেই দপ্তর থাকার ফলে প্রায় ৩০০ জনেরও বেশী সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করে, যেখানে প্রথমে গোলান মালভূমি ইজ়রায়েলের সঙ্গে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত হয় এবং পরের বছর সিনাই অঞ্চল মিশরে ফিরে আসে।

আটের দশকের মাঝামাঝি আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের বহর বেড়ে যায়। ইজ়রায়েলি বিমান বাহিনী অপারেশন ‘উডেন লেগ’ চালায়, তিউনিসের পিএলও ঘাঁটিতে আঘাত করে এবং ৬০ জন পিএলও সদস্যকে হত্যা করে। পাল্টা আক্রমণ শানায় পিএলওর ফোর্স ১৭ বাহিনী। উদ্বাস্তু শিবিরগুলিও আক্রমণের নিশানা হয়ে ওঠে। এই দশকের শেষে সোভিয়েতের বিপর্যয় ইজ়রায়েলে অভিবাসন মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে। ইজ়রায়েলের পূর্ব ব্লক জুড়ে ইহুদি এবং অ-ইহুদিদের বসতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।  

২০ বছরেরও বেশি এই প্রত্যক্ষ সামরিক দখলদারির প্রতিরোধে প্যালেস্টাইনে শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। পশ্চিম তীর এবং গাজ়া উপত্যকায় ঘটা সেই স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান প্রথম শুরু হয় ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে। সীমানাহীন কারাগারে বন্দী ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের এই বিদ্রোহ প্রথম ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। সেই ‘কাঁপন বন্ধের’ বিক্ষোভে ইহুদিদের বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। বিশেষ করে জ়ায়নবাদী মিজ়রাহি ইহুদিদের। ট্যাক্স প্রতিরোধ, ধর্মঘট এবং ব্যাপকভাবে নিরস্ত্র বিক্ষোভ দ্বারা পিএলওর কাজকর্মে চিহ্নিত হয় এই প্রথম ইন্তিফাদা, যা ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল।

পিএলও এবং ইজ়রায়েল হোয়াইট হাউসের মধ্যস্থতায় অসলো নীতিমালার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭র পক্ষপাতদুষ্ট সেই মার্কিনী অবস্থানের কারণেই তখন থেকে ইজ়রায়েল সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্তি, সন্ত্রাস দমন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ন্যাটো সহযোগিতা করেছে। ন্যাটোর এই সহযোগিতা সন্ত্রাস দমনের নামে পিএলওর রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে খর্ব করে। কিন্তু পরের বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রেজোলিউশন ৪৩ / ১৭৭ অনুমোদন করে। এতে ১৯৬৭ সালে ইজ়রায়েলের দখল করা ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা হয়। এই ১৯৮৮তেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোষণাকে জাতিসংঘ স্বীকার করে এবং সংঘের ব্যবস্থায় ‘পিএলও’র নামকরণ ‘প্যালেস্টাইন’ শব্দে প্রতিস্থাপিত হয়।  

এই পরিস্থিতি ইজ়রায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আলোচনার জন্য একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। পরের বছর ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ, পিএনএ গঠিত হয় এবং পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত পিএনএর প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অধিকৃত প্যালেস্টাইন অঞ্চলে আসেন। সেই বছরই ইজ়রায়েল ও জর্ডান শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিরলস প্রচেষ্টার জন্য ইয়াসির আরাফাতকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

এর মধ্যেই অবশ্য প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন প্রতিবেশী কুয়েত আক্রমণ করেছেন এবং এটিকে ‘১৯তম প্রদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল সেই যুদ্ধ। জাতিসংঘের হুঁশিয়ারিতে ইরাক সেই যুদ্ধে বিরতি টানতে রাজী না হলে সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে অনুরক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী ন্যাটো বাহিনী ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে তার দখলদারি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। সেই সংঘাতের বিশ্বাবহে প্যালেস্টাইনে ইজ়রায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শত শত নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি অত্যাচারিত হন। তাদেরকে নির্বিচারে হয় খুন হতে, নয় অঙ্গহানিতে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে জয় করতে বাধ্য করা হয়।

তবে কুয়েত থেকে দখলদারের মুক্তিদাতা চরিত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যের এই ইমেজ তার ওপর চাপ বাড়িয়ে তোলে। আরব দুনিয়ার নাগরিক সমাজ সহ বহু মানবাধিকার রক্ষাকারী সংগঠন, প্রতিবন্ধী সংগঠন, এবং পিএলও, প্যালেস্টাইন থেকে জ়ায়নবাদী দখলদারির অবসান চায়। সেই চাপে একমেরু পৃথিবীর নায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই বছরেই মাদ্রিদে প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ডাক দেয়।

অ্যাকাডেমিক ফিল্ডে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে অনেককেই প্রায়শই বলতে দেখা যায় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবারে জাপান বোমা না ফেললে হয়তো আমেরিকা যুদ্ধে জড়াতো না। সেই যুদ্ধের আগে বিশ্বের অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকা তেমন মাত্রায় নাক গলায়নি। সে তখন আগ্রাসী ছিল না। এমন ধরনের আরও অনেক কথা শোনা যায়। এগুলো বলা হয়। তবে এই ধরনের বক্তব্যে, বয়ানে, অবশ্যই ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ায় ইজ়রায়েলের অবস্থান। রুশ বিপ্লবের পর থেকে মার্কিন কংগ্রেস ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮র পর, কোনোদিনই সেই অবস্থানের অন্যথা হয়নি।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এশীয় প্রাণভ্রমর হল জ়ায়নবাদী শক্তিকেন্দ্র ইজ়রায়েল। এটি অতিকথন নয়। অতিকথন হল পিএলওর সঙ্গে হামাসকে এক করে দেখা। জ়ায়নবাদী বয়ানে তেমনটিই প্রচার পায়। তদুপরি, ফাতাহর পাশাপাশি ফিলিস্তিনি অঞ্চলের বাসিন্দাদের বৃহত্তম প্রতিনিধি হামাস পিএলওকে মোটেও প্রতিনিধিত্ব করে না। নিশ্চিতভাবে হামাস আন্দোলন হল একটি ‘ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন’। সেই আন্দোলনের আরবি সংক্ষিপ্ত রূপ ‘হামাস’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘উদ্দীপনা’। ফিলিস্তিনের মাটিতে ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরের বছর এটি একটি সনদ প্রকাশ করে এবং দাবি করে যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইসলামের মতবাদের ঐক্যেই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।

আটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে মিশরে ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলন, মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি স্থানীয় শাখা থেকে হামাস সংগঠনটি প্যালেস্টাইনের মাটিতে বেড়ে ওঠে। এই জঙ্গি সংগঠনটি একটি দাতব্য ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে তাদের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু পিএলওর সঙ্গে তাদের যোগ না থাকলেও গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন একনাগাড়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে মুসলিম অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পিএলওর রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে খর্ব করতেই সেটা করা হয়েছিল। পেট্রোডলার নিয়ন্ত্রণে এশীয় রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে জ়ায়নবাদ, বিশ্ব-ক্ষমতা কাঠামোয় সাম্রাজ্যবাদের দোসর হয়েই সেই কাজ করে চলেছে।

ছবি প্রতীকী
একাকী ভিড় : সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতির প্যালেস্টাইন - ইজ়রায়েল ও তার জায়নবাদী ভূ-রাজনীতি (১ম পর্ব)
ছবি প্রতীকী
Israel-Hamas War: হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তানকে, বেদনা পিছনে রেখেই নিজের দায়িত্বে অটল গাজার সাংবাদিক

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in