Manipur: অডিও টেপ কান্ড অথবা বিজেপি বিধায়কদের অনাস্থা - প্রায় দু'বছর পর এন বীরেন সিং-এর ইস্তফা কেন?
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অবশেষে ইস্তফা দিলেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা এন বীরেন সিং। রবিবার তিনি রাজ্যপাল অজয় কুমার ভাল্লার হাতে তাঁর ইস্তফাপত্র তুলে দেন। ২০১৭ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো এন বীরেন সিং মণিপুরে হিংসার ঘটনা ঘটার পর থেকে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হচ্ছিলেন। একাধিকবার তাঁর নিজের দলের নেতৃত্ব ও কর্মীদের কাছেই তিনি সমালোচিত হয়েছেন। এছাড়াও গত বছরের আগস্ট মাস থেকে অডিও টেপ বিতর্ক তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। বিভিন্ন বিতর্কের জেরে অবশেষে তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। তাঁর পদত্যাগের পরেই মণিপুর বিধানসভার অধিবেশন বাতিল করা হয়েছে। আজ ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে এই অধিবেশন শুরুর কথা ছিল।
গত বছরের জুন মাসের শেষের দিকে মণিপুরের বিজেপি বিধায়কদের একটা বড়ো অংশই চেয়েছিলেন পদ থেকে ইস্তফা দিন এন বীরেন সিং। যদিও ইস্তফা দেবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাওয়া অথবা ইস্তফা দেওয়া কোনোটাই আমার হাতে নেই।
আগস্ট মাসের ৭ এবং ২০ তারিখে এন বীরেন সিং-এর দুটি অডিও টেপ প্রকাশ্যে আসে। যেখানে তাঁকে মেইতেইদের পক্ষে কথা বলতে শোনা যায়। জাতিগতভাবে বীরেন সিং-ও মেইতেই গোষ্ঠীভুক্ত। এই অডিও টেপ ভুয়ো বলে মণিপুর সরকারের তরফে দাবি করা হলেও দ্য কুকি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস ট্রাস্ট (KOHUR) এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (CFSL) থেকে এই অডিও টেপের সত্যতা পরীক্ষা করার নির্দেশ দেয়। যদিও এর আগেই কোহুর-এর পক্ষের আইনজীবী প্রশান্তভূষণ ১৮ জানুয়ারি জানান, বেসরকারি ও অলাভজনক সংস্থা ট্রুথ ল্যাব ওই অডিও টেপ পরীক্ষা করে জানিয়েছে, ওই অডিও টেপের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কণ্ঠস্বরের নমুনা ৯৩ শতাংশ মিলে গেছে। এরপরেই মণিপুর জুড়ে হিংসার ঘটনায় এন বীরেন সিং-এর জড়িত থাকার অভিযোগ জোরদার হয়।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মণিপুরের দাঙ্গা পরিস্থিতিতে নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে রাজ্যবাসীর কাছে ক্ষমা চান বীরেন সিং। ওইদিন তিনি বলেন, “রাজ্যে যা হয়েছে আমি তার জন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। বহু মানুষ তাঁদের কাছের মানুষকে হারিয়েছেন। বহু মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।” যদিও এর ঠিক পরের দিন মণিপুরের হিংসার পুরো দায় তিনি চাপিয়ে দেন কংগ্রেসের ওপর।
তবে কংগ্রেসের ওপর দায় চাপালেও একসময় তিনি কংগ্রেস নেতা ছিলেন এবং রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিং-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। যদিও ২০১৬ সালে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন এবং মূলত তাঁর হাত ধরেই ২০১৭ সালে মণিপুরে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০০২ থেকে রাজ্যে কংগ্রেস সরকার ছিল।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে মণিপুরের হিংসার ঘটনা প্রসঙ্গে এক সমীক্ষা করে সি ভোটার। যে সমীক্ষায় এক বড়ো অংশের মানুষ চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করুন। মণিপুরে হিংসা বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে সামগ্রিকভাবে ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা ইতিবাচক উত্তর দিয়েছিলেন।
ওই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুসারে এনডিএ এবং বিরোধী সমর্থকদের মধ্যে এই বিষয়ে কোনও উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য ছিলোনা। মণিপুরের হিংসার ঘটনা প্রসঙ্গে বিরোধী নেতাদের অভিযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রী দু’মাসের বেশি সময় ধরে মণিপুর হিংসার ঘটনা প্রসঙ্গে চুপ করে থেকেছেন।
জনমত সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিং-এর পদত্যাগ চেয়েছিলেন৷ CVoter সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের প্রায় ৬০ শতাংশের মতামত দেন যে বীরেন সিংকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। যদিও এন বীরেন সিং পদত্যাগ করেননি।
ওই বছরের জুলাই মাসেই চূড়াচাঁদপুরের সাইকত কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপ এক সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে লেখা নিবন্ধে মণিপুরের অশান্তি ও হিংসার পরিস্থিতিতে এন বীরেন সিং সরকারের মদতের অভিযোগ তুলে সরব হন। তিনি জানান, “রাজ্যের এই জাতিগত প্রতিহিংসায় সরকারের মদত রয়েছে। সেই জন্যই অশান্তি শুরুর এতদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্যে শান্তি ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না।”
গত বছরের নভেম্বর মাসে এনপিপি-র সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় রাজ্যের বিজেপি জোটসঙ্গী এনপিপি। যে কথা বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন দলের প্রধান এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড কে সাংমা। চিঠিতে তিনি লেখেন, মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ রাজ্যের এন বীরেন সিং সরকার। গত কয়েকদিনের ঘটনায় আমরা দেখেছি পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে, যেখানে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং রাজ্যের মানুষকে অসহনীয় অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে শেষ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি-র ভোট কমেছে ১৭.৭৫ শতাংশ এবং জোটসঙ্গী এনপিএফ-এর ভোট কমেছে ৩.৬৮ শতাংশ। অন্যদিকে দুই আসনেই জয়ী কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে প্রায় ২২.৮৮ শতাংশ। মণিপুরে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ শিবিরের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৫.৪৫ শতাংশ। এবার যা কমে হয়েছে ২১.৪৩ শতাংশ।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন