Humayun Kabir: বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেস - কোনও দলই ঘুরতে বাকি রাখেননি হুমায়ুন কবীর
রাজনৈতিক জীবনের সমস্তটা জুড়েই তিনি ক্ষমতার বৃত্তে থেকেছেন। যখনই তিনি ক্ষমতার বৃত্ত থেকে দূরে সরেছেন তখনই তাঁকে নিয়ে হয় বিতর্ক, নয় বহিষ্কার অথবা দলবদল। ঠিক এভাবেই মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীরের রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত। এবার যদিও তাঁর বহিষ্কার কিছুটা অন্য কারণে। যেখানে ঘটনা পরম্পরায় মনে হয়েছে হুমায়ুন কবীর হয়তো নিজেই চাইছিলেন তাঁকে বহিষ্কার করা হোক এবং রাজনৈতিক মহলের এক অংশের মতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সুবিধা করে দিতেই তাঁর বর্তমান পদক্ষেপ। যে পদক্ষেপে বাংলা জুড়ে মেরুকরণের রাজনীতি আরও তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা।
সিপিআইএম-এর বাংলা বাঁচাও যাত্রা, রাজ্যে ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের রায় সহ একাধিক ইস্যু পেছনে ফেলে বৃহস্পতিবার থেকে রাজ্য রাজনীতি সরগরম তাঁকে নিয়ে। সমস্ত মিডিয়ার শিরোনামে তিনি। গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনার মধ্যে থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে তিনি উঠে এসেছেন শিরোনামে। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। যাকে গতকালই সাসপেন্ড করেছে তৃণমূল। তার সাসপেনশন ঘোষণা করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
এরপর থেকেই শুরু হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক আক্রমণ। গতকাল থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম সহ একাধিক তৃণমূল নেতৃত্ব তার আক্রমণের নিশানায়। বার বার বিদ্রোহ, দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ, বহিষ্কার, দলবদল, বিতর্ক এবং একাধিক অভিযোগ – রাজনৈতিক জীবনে এই সবকিছু নিয়েই হুমায়ুন কবীর। আর গতকাল তার সাসপেনশনের পরে অধীর রঞ্জন চৌধুরী তো সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে হারানোর জন্য এই হুমায়ুন কবীরকেই ব্যবহার করেছিল তৃণমূল।
স্বয়ং হুমায়ুন কবীর বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে জানিয়েছেন “এই ক্ষমতা ক’দিন থাকে, আমি বেঁচে থাকলে দেখব। মুসলিমদের বোকা বানাচ্ছে তৃণমূল। মুসলমানদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসছে। অথচ মুসলমান জনপ্রতিনিধিদের কোনও গুরুত্ব নেই। উনি আরএসএস-এর হয়ে কাজ করছেন। এরকম আরএসএস মার্কা মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে ডাইরেক্ট বিজেপির কেউ মুখ্যমন্ত্রী হলে আমি ওয়েলকাম জানাব '।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরীর অনুগামী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন হুমায়ুন কবীর। রেজিনগরে কংগ্রেস করতে করতেই তাঁর রাজনৈতিক উত্থান। একসময়ের জেলা পরিষদ সদস্য হুমায়ুন কবীর ২০১১ সালে কংগ্রেস তৃণমূল জোটের প্রার্থী হিসেবে রেজিনগর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস বিধায়ক নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে ৮,৭৬১ ভোটে তিনি আরএসপি প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মণ্ডলকে পরাজিত করেন।
যদিও এর কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি। কংগ্রেস তৃণমূলের জোট ভেঙে যাওয়ার পরে কংগ্রেসের হাইকমান্ডে নির্দেশে সাবিনা ইয়াসমিন, আবু হেনা, মানস ভুঁইয়া তখন কংগ্রেসে ছিলেন, আবু নাসের খান চৌধুরীর মতো নেতারা মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু প্রাণীসম্পদ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হুমায়ুন পদত্যাগ করেননি। এর পরেই কংগ্রেস তাঁকে সাসপেন্ড করে। ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন একসময় অধীর চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হুমায়ুন। যদিও ২০১৩ সালে রেজিনগর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থানে শেষ করেন এবং ওই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন কংগ্রেস প্রার্থী রবিউল আলম। মন্ত্রিত্ব চলে যায় তাঁর।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৃণমূল বহিষ্কার করে হুমায়ুনকে। দলের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। তার নিশানা থেকে বাদ যাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন দলে গুরুত্ব পাচ্ছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার জেরেই বহিষ্কার। সেবার তার বহিষ্কারের নির্দেশ ঘোষণা করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এরপর ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে রেজিনগর কেন্দ্র থেকেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন হুমায়ুন কবীর। এবার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলেও জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন হুমায়ুন কবীর। পরাজয়ের ব্যবধান ছিল ৫,৫৬০।
এরপর আবার কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ। ফের নিজের পুরোনো দলে ফেরেন তিনি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ময়দানেও তাঁকে দেখা যায়। যদিও আবারও দলত্যাগ। ২০১৮ সালের জুন মাসে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন হুমায়ুন কবীর। যদিও মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে এবারও তৃতীয় স্থানে শেষ করেন তিনি।
এরপর আবার দলত্যাগ। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে তিনি বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে আবার যোগ দেন তৃণমূলে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভরতপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪৩ হাজার ৮৩ ভোটে তিনি বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করেন।
এবার আরও একবার সাসপেনশন তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় বাবরি মসজিদ তৈরির ঘোষণা করেছেন হুমায়ুন। মসজিদের শিলান্যাসের জন্য ৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এই সমগ্র ঘটনায় তৃণমূলের তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন হুমায়ুন। দলের লাইনের বাইরে গিয়ে লাগাতার নানা বিতর্কিত মন্তব্য এবং দলবিরোধী কাজের জেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দল থেকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। আর হুমায়ুন বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী মানুষের কাছ থেকে তহবিল নিয়ে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেন, দুর্গা পূজার জন্য তহবিল দেন। পুজো কমিটিগুলিকে ১,১০,০০০ টাকা দেওয়া হয়। ১১০০ কোটি টাকা দামের একটা জায়গা, নিউটাউন রাজারহাটে একটা মন্দির তৈরির জন্য দিয়ে দিয়েছেন। মুসলমানদের মসজিদ তৈরি করতে বাধা দিচ্ছে, এদিকে সরকারি টাকায় ভুরি ভুরি মন্দির তৈরি হচ্ছে।”
এডিআর বা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফরমস এর তথ্য অনুসারে ২০১১ সালে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪ লক্ষ টাকার। ২০১৩ সালের উপনির্বাচনে তিনি জানান তাঁর সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৩৬ লক্ষ ৪৩ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৯৬ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় তা হয় ৩ কোটি ৬৩ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। ২০২১ নির্বাচনের সময় তিনি জানান তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৭ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা।
SUPPORT PEOPLE'S REPORTER
ভারতের প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুখী সাংবাদিকতা — যা আপনার সামনে সঠিক খবর পরিবেশন করে। পিপলস রিপোর্টার তার প্রতিবেদক, কলাম লেখক এবং সম্পাদকদের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আপনাদের মতো পাঠকদের সহায়তা। আপনি ভারতে থাকুন বা দেশের বাইরে — নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে একটি পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

