চুয়াড়, চুয়াড় বিদ্রোহ এবং মেরুকরণ

শহুরে লেখকদের কেউ কেউ লিখে থাকেন জঙ্গলমহলে চুয়াড় বলে একটা জাতি ছিল। সেটা তো সর্বৈব মিথ্যা। ব্রিটিশরা আসার আগে থেকেই চুয়াড় শব্দটা এদেশের জঙ্গলমহলে বহুল প্রচলিত শব্দ ছিল।
চুয়াড় বিদ্রোহ
চুয়াড় বিদ্রোহছবি প্রতীকী, ছবি সংগৃহীত

চুয়াড় শব্দটি জঙ্গলমহলে ব্যবহৃত হয় তথাকথিত অসভ্য, অভদ্র, ইতর, বর্বর, নিচ্জাত, ছোটলোক ইত্যাদি ঘৃণ্য গালি অর্থে আদিম ও অন্ত্যজ জনজাতির মানুষজনদের উদ্দেশ্যে। এটি একটি অপমানজনক শব্দ। ব্রিটিশরাই প্রথম জঙ্গলমহলের জনজাতিগুলিকে চুয়াড় বলে উল্লেখ করেছে, এমনটা নয়।

মেদিনীপুরের রানী শিরোমনির কাছ থেকে কিম্বা বরাভূমের জমিদার গঙ্গানারায়ণের কাছ থেকে যারা পাইকান জমি পেয়েছিল তারা চুয়াড় ছিলো অথবা ব্রিটিশ কোম্পানি সৈন্যসামন্ত দিয়ে যাদের জমি অধিগ্রহণ করেছিলো তারা চুয়াড় ছিল, মোটেই না। ঘাটোয়াল, ভূমিজরাও চুয়াড় ছিল না। কুড়মিরাও চুয়াড় ছিল না।

শহুরে লেখকদের কেউ কেউ লিখে থাকেন জঙ্গলমহলে চুয়াড় বলে একটা জাতি ছিল। সেটা তো সর্বৈব মিথ্যা। ব্রিটিশরা আসার আগে থেকেই চুয়াড় শব্দটা এদেশের জঙ্গলমহলে বহুল প্রচলিত শব্দ ছিল। জঙ্গলমহলে এই চরম অবজ্ঞার শব্দটি ব্যবহার করতো মূলত এদেশেরই টাকা-পয়সাওয়ালা এবং তথাকথিত লেখাপড়া জানা উচ্চবর্ণীয়রা। আর এই ঘৃণ্য শব্দটি ব্যবহার করা হতো জঙ্গলমহলের অর্ধ পোশাক পরিহিত, গরীব, অশিক্ষিত জনজাতিগুলির উদ্দেশ্যেই। তারাই এই কৃষকবিদ্রোহকে ঘৃণাভরে চূয়াড় বিদ্রোহ নাম দেয়।

চুয়াড় শব্দটি মোটেই ইংরেজি শব্দ নয়। চুয়াড় শব্দটি জঙ্গলমহলেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। অতএব ব্রিটিশরাই প্রথম জঙ্গলমহলের জনজাতিগুলিকে চুয়াড় বলে উল্লেখ করে গেছে, এমনটা মোটেই নয়। ব্রিটিশরা এই জনজাতিগুলির উদ্দেশ্যে বর্বর (barbarian), নেটিভ (native), ক্রিমিনাল ট্রাইব (criminal tribe) শব্দগুলি ব্যবহার করে গেছে।

এই শব্দগুলির বাংলা তর্জমা করতে গিয়ে আমাদের দেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষেরাই জঙ্গলমহলের জনজাতিগুলিকে 'চুয়াড়' বলে উল্লেখ করে গেছেন। তাঁদের আন্দোলনকে বিদ্বেষাত্বকভাবে চুয়াড়দের বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করে গেছেন। ব্রিটিশরা এই তথাকথিত চুয়াড়দের চূড়ান্তভাবে দমন করে রাখার উদ্দেশ্যে ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে স্পেশাল ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট (Special Criminal Tribe Act 1870) পাশ করিয়ে আনে। ভারতবর্ষে সেই প্রথম আদিবাসীদের দস্যুজাতি হিসাবে  চিহ্নিত করা হয়।

জঙ্গলমহলে জনগোষ্ঠীগুলির জাতিসত্বার আন্দোলনে ইতিহাসকে নিজের নিজের পক্ষে টানতে কিছু কিছু সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা বলে থাকেন - 'আমরাই সেই চুয়াড়' কিম্বা 'আমরাই সেই চুয়াড়দের বংশধর'। এভাবে বলাটা আসলে সেই তথাকথিত অসভ্য, অভদ্র, ইতর, বর্বর, নিচজাত, ছোটলোক ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত ঘৃণ্য শব্দটিকে মেনে নেওয়া এবং স্বীকৃতি দেওয়া। অপরের ছুঁড়ে দেওয়া কাদা আরো ভালো করে গায়ে মেখে নেওয়া। যা আসলে জঙ্গলমহলের গৌরবময় সংগ্রামের ঐতিহ্যকে অপমান করারই সামিল।

জঙ্গলমহলে সেই তথাকথিত চুয়াড় (!) বিদ্রোহ কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যেখানে যে গোষ্ঠীর লোকেরা সংখ্যায় বেশি ছিল সেখানে তাদের অংশগ্রহণটা বেশি ছিল। ওই বিদ্রোহ আসলে ছিল কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির দেওয়ানী লাভের পরে জমিহারা মানুষেরা বিদ্রোহী হবে সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। সেই জমি কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর লোকেরাই হারিয়েছে, এমনটাও ছিল না। সেই সময় জঙ্গলমহলে যাদের অবস্থান ছিল, তারা সবাই কমবেশি জমি হারিয়েছে। অতএব তৎকালীন জঙ্গলমহলে সমস্ত মানুষেরাই ছিল শোষিত নির্যাতিত, কমবেশি বিদ্রোহীও ছিল।

অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষযয়ে কেউ দৃষ্টি দেয়নি তা হলো, জঙ্গলমহলে নীলচাষ। ইতিহাসে জঙ্গলমহলের ওই কৃষক বিদ্রোহ দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল নীলচাষ। জঙ্গলমহলের আনাচে-কানাচে খোঁজাখুঁজি করলেই এখনও প্রায় শতাধিক নীলকুঠির হদিস পাওয়া যায়। নীলকুঠিগুলির ভগ্নাবশেষ অনুসন্ধান করলে পরিষ্কার বোঝা যায় প্রায় প্রত্যেকটি নীলকুঠিতেই ছিলো কাছারি এবং কয়েদখানা।

স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলচাষ এবং নীলচাষে নীলকর সাহেবদের শোষণ এবং অত্যাচারের মাত্রাটা কেমন ছিল! ব্রিটিশদের ওই দীর্ঘ শোষণ এবং অত্যাচার থেকে বাঁচতে জঙ্গলমহলের কৃষকেরা দীর্ঘ সংগ্রাম করে গেছে সেটা কোনো দ্বিধা না রেখেই বলা যায়। সেই কৃষক বিদ্রোহ বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের নির্দিষ্ট কোন স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। নির্দিষ্ট কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। ওই বিদ্রোহ ছিল জঙ্গলমহলের শোষিত নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম। যা ভারতবর্ষে কৃষক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তাকে চুয়াড় আখ্যায়িত করে খাটো করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। বরং সেই ঘৃণ্য 'চুয়াড়' শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করাই শ্রেয়।

তথাকথিত চুয়াড় (!) বিদ্রোহে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিলো, কারা সেই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলো তা নিয়ে জঙ্গলমহলের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে এখন উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কের নিষ্পত্তি অবশ্যই হবে। কারণ ইতিহাস প্রমাণ ব্যতিরেকে হয় না। হুমকি, ধমকি, মিছিল, ডেপুটেশন, জন-সমাগম করলেই ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়া যায় না। বিকৃত করলেও প্রতিষ্ঠিত করা যায়না। সিলেবাসের উলট-পালট, সুবিধামতো সংযোজন বিয়োজন করলেও ঐতিহাসিক সত্যকে চেপে রাখা যায় না। বরং সেই অপচেষ্টা করা হলে তাতে প্রামান্যটা আরও জরুরী হয়ে পড়ে। আর প্রামান্য আরও বেশি বেশি করে জড়ো হলে সত্যটা আরও মজবুত হয়।

অতএব তথাকথিত চুয়াড় (!) বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে জঙ্গলমহলের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার বিতর্ক একেবারে অমূলক। কিন্তু বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁচাচ্ছে যা থেকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে জনগোষ্ঠীগুলির দীর্ঘদিনের ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। যা জঙ্গলমহলকে আরো কয়েক দশক পিছিয়ে দেবে।

সাম্প্রদায়িকতা সমাজে কী বিষ ফল দেয়, সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র কেমন হয়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে তার পরিণতিটা কি হয়, সে সম্পর্কে জঙ্গলমহলের মানুষের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। যুগ যুগ ধরে জঙ্গলমহলের মানুষ একসাথে বসবাস করে আসছে। রুটি রুজির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধতার নিদর্শন রেখেছে। কিন্তু জাতিসত্বার আন্দোলন করতে গিয়ে জঙ্গলমহলের জাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এরকম মেরুকরণ সৃষ্টি হওয়ায় জঙ্গলমহলের মানুষ এই প্রথম ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে পা বাড়াচ্ছে!

- মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

আরও পড়ুন

চুয়াড় বিদ্রোহ
৩৪ বছরে রাজ্যে দাঙ্গার সংখ্যা ছিল শূন্য, আবারও বামেরা এলে বন্ধ হবে ধর্মের নামে বেয়াদপি
চুয়াড় বিদ্রোহ
Azadi 75: স্বাধীনতা মানে কি খিদে সহ্য করে বাঁচা?

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in