প্রকৃতির তাণ্ডবে উত্তরবঙ্গে মৃত অন্তত ২৮, আটকে বহু পর্যটক, ধস-বৃষ্টিতে বিছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা

People's Reporter: দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিপর্যয়ের প্রথম ২৪ ঘণ্টা তাঁদের পাশে কেউ ছিল না।
বিধ্বস্ত মিরিক
বিধ্বস্ত মিরিকছবি সংগৃহীত
Published on

প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত গোটা উত্তরবঙ্গ। গত দু’দিনের প্রবল বর্ষণের জেরে ধস ও জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২৮ জনের (কোনও কোনও সূত্র দাবি করছে মৃতের সংখ্যা ২৩)। আহত হয়েছেন বহু মানুষ, নিখোঁজও রয়েছেন অনেকে। মিরিক থেকে একের পর এক মৃত্যু সংবাদ মিলছে। আটকে বহু পর্যটক। মৃত্যু হয়েছে গণ্ডার, হরিণ সহ বহু বন্যপ্রাণীর। ধসে ভেঙে পড়েছে সেতু, রাস্তা, উপড়ে গেছে শতাধিক গাছ। বন্ধ হয়েছে পর্যটনকেন্দ্র, থমকে গিয়েছে পাহাড়ি জীবন।

অবিরাম বৃষ্টিতে পাহাড়-ডুয়ার্সের বেশ কিছু এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং ও দার্জিলিং—চার জেলাই প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত। তোর্সা, তিস্তা, বালাসন, রায়ঢাক, হলং সহ একাধিক নদীর জল বিপদসীমার ওপরে বইছিল। তবে সোমবার বৃষ্টি থামার পর সব নদী থেকেই জল নামতে শুরু করেছে। তোর্সা নদী থেকে সোমবার সকালে লাল সতর্কতা প্রত্যাহার করা হলেও, আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়।

শিলিগুড়ি-দার্জিলিং, মিরিক, কার্শিয়ং ও ঘুমের পথে পাথর ও কাদা নেমে সড়ক বন্ধ। বিশেষত কার্শিয়ঙের গৌরিশঙ্কর চা বাগানের কাছে রোহিনী রোড এবং হুইসলখোলার কাছে ১১০ নম্বর জাতীয় সড়কে ধস নামায় যান চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। যদিও সোমবার সকাল থেকে এনএইচ-৫৫ আংশিকভাবে খুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, কিন্তু পাহাড়ি এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ এখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়।

দুর্যোগের সবচেয়ে ভয়াবহ ছবি এখন জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে। প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভেসে গেছে হলং নদীর উপর থাকা কাঠের সেতু। ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে জলদাপাড়া এলাকা। জলদাপাড়া টুরিস্ট লজে আটকে পড়েছিলেন অন্তত ২৫ জন পর্যটক। রবিবার রাত থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। সোমবার সকালে বনদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। সুরক্ষার স্বার্থে বনদপ্তর আপাতত জলদাপাড়া জঙ্গলে সব ধরনের পর্যটন কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বনকর্মীদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিরাপদ স্থানে থাকার জন্য।

প্রকৃতির এই রোষে শুধু মানুষ নয়, বন্যপ্রাণীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বনবিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, জলদাপাড়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় জলবন্দি অবস্থায় মারা গিয়েছে একাধিক গণ্ডার ও হরিণ।

মিরিকের ছবিটা আরও ভয়ঙ্কর। বৃষ্টি ও ধসে কেবল সেখানেই মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২৪ জনের, আহত হয়েছেন ৫৬ জনেরও বেশি। নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। দুধিয়া সেতু ভেঙে যাওয়ায় মিরিকের সঙ্গে আশপাশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। পানিঘাটা সেতুর নিচ দিয়ে ফুঁসছে বালাসন নদী, জলের তলায় চলে গেছে একাধিক গ্রাম।

ধসে ভেঙে পড়েছে ঘরবাড়ি। ঘরহারা মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন পানিঘাটা সেতু সংলগ্ন এলাকায়। ভয়ঙ্কর অবস্থায় রয়েছে মোবাইল টাওয়ারটিও—স্তম্ভের নিচে মাটি সরে গেছে, যেকোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পর্যটনের ভরা মরসুমে এমন বিপর্যয় আগে দেখেননি মিরিকবাসীরা। স্থানীয় হোমস্টে মালিক অর্জুন তামাং বললেন, “শারদোৎসবের সময়টায় পর্যটকেরা ভিড় জমাতেন। কিন্তু এই ধসে সবকিছু শেষ। কে জানে, কবে ফিরবে সেই দিনগুলো!”

ধস ও জলবন্দি অবস্থায় আটকে পড়েছেন শতাধিক পর্যটক। তাবাকোশি, গুরদুং, সুখিয়াপোখরি, জোড়বাংলো, সব জায়গায়ই আটকে রয়েছেন বিভিন্ন দলের পর্যটক। তাবাকোশিতে প্রায় ৭০ জন, গুরদুংয়ে ৪০ জন ও সুখিয়াপোখরিতে ২০ জন পর্যটক আটকে থাকার খবর মিলেছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সেনা ও দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী উদ্ধারকাজে নেমেছে। তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে ইতিমধ্যেই ১০টি বাস দুর্গতদের উদ্ধার করতে রওনা দিয়েছে।

এদিকে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিপর্যয়ের প্রথম ২৪ ঘণ্টা তাঁদের পাশে কেউ ছিল না। অনেক জায়গায় এখনও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। পানীয় জলের সংকট, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।

এই পরিস্থিতিতে সোমবারই উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, “জীবন বাঁচানোই এখন প্রথম অগ্রাধিকার। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে সরকার রয়েছে।”

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in