
দীর্ঘ ১৭ বছর বিচার প্রক্রিয়া চলার পর ঘোষিত হল মালেগাঁও বিস্ফোরণ কান্ডের রায়। রায়ে অভিযুক্ত ৭ জনকেই ‘বেকসুর’ ঘোষণা করলো বিশেষ এনআইএ আদালত। বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই এই মামলার রায় ঘোষণা করেন ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (NIA) বিচারক এ কে লাহোটি। ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুম্বাই থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে মালেগাঁও-এর ভিকু চক এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে।
এই মামলায় মূল অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির নেত্রী এবং প্রাক্তন সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত সহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক। এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের এবং ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছিলেন।
সংস্থার মতে, অভিযুক্তরা অভিনব ভারত সংগঠনের অংশ ছিল। তারা ভারতকে "হিন্দু রাষ্ট্র" করার লক্ষ্যে দেশজুড়ে সন্ত্রাসী অভিযান চালানোর জন্য পুরোহিতকে নিয়োগ করেছিল বলে অভিযোগ ছিল। এই মামলায় প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর এবং লেফট্যানেন্ট কর্নেল প্রসাদ শ্রীকান্ত পুরোহিত ছাড়াও অন্যান্য অভিযুক্তরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর রমেশ উপাধ্যায়, অজয় রাহিরকর, সুধাকর দ্বিবেদী, সুধাকর চতুর্বেদী, সমীর কুলকার্নি।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনলফুল অ্যাকটিভিটিস (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (UAPA) এবং ভারতীয় দন্ডবিধির অন্যান্য ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল চক্রান্ত, হত্যা, হত্যার চেষ্টা, শত্রুতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
এক নজরে মালেগাঁও বিস্ফোরণ কান্ডের তদন্ত প্রক্রিয়া
এই মামলার দায়িত্ব প্রথম দেওয়া হয় মহারাষ্ট্র অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডকে। দায়িত্বভার ছিল হেমন্ত কারকারের ওপর। ২৬/১১ মুম্বাই হামলায় সন্ত্রাসবাদী হানায় তাঁর মৃত্যু হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এটিএস চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে ১১ জনকে অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, তারা বিশ্বাস করে যে অভিযুক্তরা "মুসলিম পুরুষদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে" এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
২০১১ সালে এই তদন্তভার যায় এনআইএ-র হাতে। ২০১৬ সালে এক সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দাখিল করে এনআইএ এবং এই ঘটনার পূর্ববর্তী তদন্তে এটিএস-এর দ্য মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (MCOCA)-এর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বিস্ফোরণস্থল থেকে পাওয়া প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মোটরসাইকেল সম্পর্কে এনআইএ জানায়, মোটরসাইকেলের মালিক প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর হলেও তা ব্যবহার করতেন রামচন্দ্র কালসাংরা। যিনি এই মামলায় অভিযুক্ত থাকলেও পলাতক ছিলেন। এনআইএ দাবি করে, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মালিকানাধীন এই মোটরসাইকেল বিস্ফোরণের দেড় বছর আগে থেকে ওই ব্যক্তির কাছে ছিল।
এনআইএ আরও জানায়, অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে যা যা তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছিল এটিএস তা ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়াও এনআইএ জানায়, এটিএস ১১ জনকে অভিযুক্ত জানালেও, তথ্যপ্রমাণ সংগৃহীত হয়েছিল মাত্র ৭ জনের বিরুদ্ধে। এরপরেই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকার কারণে ছাড়া পান শ্যামলাল সাহু, শিবনারায়ণ কালসাংরা, প্রবীণ তাকালকি।
২০১৮ সালে সাত অভিযুক্তের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় যা চলে ২০২৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত।
৩১ জুলাইয়ের রায়দান
এদিন আদালত রায় ঘোষণা করে জানিয়েছে, প্রসিকিউশন সফলভাবে প্রমাণ করেছে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) মোটরসাইকেলে বোমা লাগানো ছিল কিনা তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আদালত আরও জানায়, যদিও বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য আরডিএক্স ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল, কিন্তু লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিতের বাসভবনে আরডিএক্স মজুত ছিল এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনিই যে বোমা তৈরি করেছিলেন এমন কোনও প্রমাণও নেই।
এদিন বিশেষ এনআইএ আদালতের বিচারপতি জানান, বিস্ফোরণস্থলে পাওয়া মোটরবাইক যে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মালিকানাধীন ছিল তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিচারপ্রক্রিয়ায় ৩২৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আসামীপক্ষ আটজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করে। সাক্ষ্যপ্রমাণে ১০,৮০০ টিরও বেশি নথি পর্যালোচনা করা হয়। দুই পক্ষের লিখিত দাখিল তিনটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত ছিল, যা প্রায় ১,৩০০ পৃষ্ঠারও বেশি।
গত ৭ বছর ধরে চলা এই মামলায় বিচারকালীন সময়ে পাঁচজন বিচারক দ্বারা শুনানি হয়েছিল। বিচারক লাহোটি ২০২৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েক মাস ধরে শুনানি চলার পর ১৯ এপ্রিল চূড়ান্ত রায় দেবার কথা জানান।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন