মেষপালক থেকে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার! কেমন ছিল লুকা মড্রিচের লড়াকু জীবন?

বুকে অদম্য সাহস, পায়ে ফুটবল আর একপাল মেষ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ভেলেবিট পর্বতের দক্ষিণ ঢালে। যার আনাচে কানাচে বেছানো থাকতো মাইন।
লুকা মড্রিচ
লুকা মড্রিচগ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

১৯৯১ সাল। যুগোস্লাভিয়ার বলকান অঞ্চলে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। সার্বিয়ান বিদ্রোহীদের বোমা-বারুদের আঘাতে তছনছ হয়ে যাচ্ছে আজকের ক্রোয়েশিয়া। ছোট্টো লুকার বয়স তখন মাত্র ছয়। ১৯৮৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত ক্রোয়েশিয়া সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জাদারে জন্মগ্রহণ করেন আজকের বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিডফিল্ডার লুকা মড্রিচ। বাবা স্ত্রিপে মড্রিচ এবং মা রাদোইকা দোপুদ নিটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

বলকান যুদ্ধের আঁচ তখন পৌঁছে গিয়েছে জাদারেও। বালক লুকাকে জানিয়ে দেওয়া হতো বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেনো না যায়। আর্থিক অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা মড্রিচ মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই মেষ প্রতিপালকের কাজ করতেন। তাই তাঁকে বেরোতেই হতো। কিন্তু গোলা গুলির আওয়াজ দমাতে পারতো না জেদি ছেলেটাকে। বুকে অদম্য সাহস, পায়ে ফুটবল আর একপাল মেষ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ভেলেবিট পর্বতের দক্ষিণ ঢালে। যার আনাচে কানাচে বেছানো থাকতো মাইন।

তবে যুদ্ধের বিষাক্ত বাতাস পিছু ছাড়লো না মড্রিচকে। তাঁর দাদুকে গুলি করে হত্যা করে সার্ব বিদ্রোহীরা। বাধ্য হয়েই রাতারাতি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় মড্রিচের পরিবার। গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ি। মড্রিচ ও তাঁর পরিবার জাডারের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের এক হোটেলে আশ্রয় নেয়। সেখানেও ছিল গ্রেনেড আর বুলেটের ভয়। হোটেলে বসেই দিন রাত গোলা গুলির আওয়াজ শুনতেন ছ'বছরের বাচ্চা ছেলেটি। তবে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা তাঁর নষ্ট হয়নি। বরং লুকা জানান, 'এই যুদ্ধই আমাকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করে তুলেছে।'

ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ক্রোয়েশিয়া। নতুন করে ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ফেডারেশন। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রাখে দেশটি। আর প্রথমবারেই টুর্নামেন্টের তৃতীয় হয়ে নিজেদের ফুটবল শক্তির জানান দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। মড্রিচের বয়স তখন ১৩। যার দু চোখ জুড়ে শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল। গোলা-বারুদ নয়। ফুটবল পায়ে বিশ্বজয় করা।

আর পাঁচটা প্রতিভাবান ফুটবলারের মতো মড্রিচের শুরুটা খুব একটা সহজ ছিলো না। অত্যন্ত লাজুক এবং ঠুনকো চেহারার মদ্রিচকে কোচদের পছন্দই ছিলো না। মড্রিচ হাল ছাড়েননি। অবশেষে তাঁকে নেয় জাদারের ক্লাব হাজডুক স্লিট। সেই দলের কোচ টমিস্লেভ বেসিচের সৌজন্যে সেখান থেকে ডায়নামো জাগ্রেবের ট্রায়ালে যান, তাদেরও মনে ধরে যায় মড্রিচকে। সেখান থেকে টটেনহ্যাম তারপর এখন রিয়াল মাদ্রিদের মহাতারকা।

১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর রাশিয়া বিশ্বকাপে ফের একবার ক্রোয়েশিয়া জায়গা করে নেয় নক আউট পর্বে। সেবার ৪৫ লক্ষ মানুষের দেশটি খেলে ফাইনাল। দেশটির ইতিহাসে এর থেকে বড় সাফল্য আগে কখনো আসেনি। রাশিয়া বিশ্বকাপের সেই রূপকথার দৌড় কাতার বিশ্বকাপেও রয়েছে জারি। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া। আর তাদের নায়ক লুকা মড্রিচ। জীবনকে বাজি রেখে ফুটবলার হওয়ায় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা সেই লুকা এখন বিশ্ব ফুটবলের আইকন। রাজধানীর জাগ্রেবের রাস্তায় মিছিল উল্লাস হয় তাঁর ছবি নিয়ে। উদ্বাস্তু শিবিরে বেড়ে ওঠা লুকার হাতে ফুটবল বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ সম্মানটি গোটা ক্রোয়েশিয়া দেখতে আগ্রহী।

লুকা মড্রিচ
FIFA World Cup 22: রাশিয়া বিশ্বকাপে ৩-০ গোলে জিতেছিল ক্রোয়েশিয়া, আর্জেন্টিনা কি পারবে বদলা নিতে?

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in