সিলিকোসিস সহ সমস্ত পেশাগত রোগীদের দাবি আদায়ে অবস্থান বিক্ষোভের ডাক

বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “একজন মানুষ জানেন তিনি মারা যাবেন। জীবিকার জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন। সিলিকোসিস ক্যান্সারের থেকেও ভয়ংকর, সেটা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।"
সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটির প্রেস কনফারেন্স
সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটির প্রেস কনফারেন্সনিজস্ব ছবি

রাজ্যের বিভিন্ন সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, পাথর খাদান, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেসকল শ্রমিকরা কাজ করছেন, তাঁদের ফুসফুসে বাসা বাঁধছে মারণ রোগ সিলিকোসিস। নানারকম গুঁড়ো নাকে ঢুকে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে তাঁদের। প্রাণ হারাচ্ছেন তাঁরা। শুক্রবার সিলিকোসিস নিয়ে আম জনতার মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে একটি প্রেস কনফারেন্স করে সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি।

কলকাতা প্রেস ক্লাবে হওয়া এই সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআইএম সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “একজন মানুষ জানেন তিনি মারা যাবেন। জীবিকার জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন। আমরা অনেকে জানিই না সিলিকোসিস কী? সিলিকোসিস যে ক্যান্সারের থেকেও ভয়ংকর রোগ এবং সেটা নিয়ে জনমানসে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার, সেটা আগে বুঝতে হবে। আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।”

সিটু নেতা আসাদুল্লা গায়েন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “অসহায় মানুষদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অনেক জায়গাতেই নিস্ক্রিয়। আমাদের শ্রমিকরা পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন। সরকার কোনো দায়িত্বপালন করছে না। এর বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে হবে।”

পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে ডাঃ ফুয়াদ হালিম বলেন, "আগামী দিনে সিলিকোসিস ভয়ংকর হতে চলেছে। পেশাগতভাবে যে সব রোগ হয় তা চিহ্নিত করার যে ব্যবস্থা তা রাজ্যস্তরে খুবই দুর্বল। অধিকাংশ সময়েই প্রপার ডায়গোনিসিস করা যাচ্ছে না। ফলে সঠিক চিকিৎসাও পাচ্ছে না। সিলিকোসিস শরীরে নিয়ে যারা লড়াই করছেন তারা কার্যত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দাবি, সরকারকে সিলিকোসিস রোগীদের দায়িত্ব নিতে হবে।” 

সংগঠকদের বক্তব্য অনুসারে, এই মুহূর্তে রাজ্যের বুকে সিলিকোসিস একটা বড়ো সমস্যা হলেও তা নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেশ কয়েক হাজার সিলিকোসিস আক্রান্ত রোগী থাকলেও, না আছে তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা, না আছে তাঁদের জন্য কোনো পুনর্বাসন প্রকল্প। শ্রমজীবী মানুষের পেশাগত রোগ একটি বহু উপেক্ষিত বিষয়। বিশেষতঃ আমাদের মতো দেশে যেখানে পুরো শ্রমশক্তির ৯০%-র বেশী অসংগঠিত ক্ষেত্রে ন্যূনতম শ্রমিক অধিকার ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হন।

অসংগঠিত শ্রমিকদের বেতন-মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে যদিও বা কখনো সখনো কিছু আন্দোলন সংগঠিত হয়, পেশার কারণে অসুস্থতা-মৃত্যু এবং তার ফল হিসেবে অজস্র পরিবারের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুব কমই আলোচিত হয়। ক্রমাগত আন্দোলনের চাপে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজ্য সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যে সিলিকোসিস রোগীদের জন্য একটি পুনর্বাসন পলিসি করা হবে, যার মাধ্যমে সরকারীভাবে সম্ভাব্য শ্রমিকের রোগনির্ণয়, নিশ্চিত হলে ক্ষতিপূরণ, মাসিক পেনশন, চিকিৎসার সমস্ত খরচ ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যাবে।

এই পলিসি প্রকাশিত হয় ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ২০২২ সালে। এর প্রায় ১০ মাসে বাদে আক্রান্ত শ্রমিকদের পলিসির জন্য আবেদন করার ফর্ম প্রকাশ করা হয় এবং আজ পর্যন্ত শ্রমিকরা এই ফর্ম কোথায় জমা দেওয়া হবে তা জানতে পারেননি!

রাজ্য সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তা ও অমানবিক মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সহ অন্যান্য ৫ দফা দাবিতে আগামী ২৪শে মে মৌলালি থেকে মিছিল করে এসে ধর্মতলায় সারাদিনব্যাপী অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচী নিয়েছে সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি। যে দাবির মধ্যে আছে সমস্ত বেআইনি খাদান-ক্রাশারকে আইনের আওতায় এনে শ্রম আইন মানতে বাধ্য করতে হবে ও শ্রমিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে এবং সমীক্ষা করে রাজ্যের সমস্ত জেলায় কতজন এইরকম পেশাগত অসুখের সম্ভাব্য রোগী আছে তাঁদের নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। Coordination Committee against Silicosis and other Occupational Diseases (CCSOD)-র ডাকে এই বিক্ষোভে SASSC ছাড়াও সামিল হবে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, CITU, NTUI, IFTU, AWBSRU, AICCTU, TUCI, AITUC, UTUC, TUCC, INTUC, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, পিপলস রিলিফ কমিটির, AHSD, HRA।

পশ্চিমবঙ্গে সিলিকোসিস নিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে উঠেছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার ঘরে ফেরা আক্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের হাত ধরে। মিনাখাঁ, দেগঙ্গা, সন্দেশখালি, বসিরহাট, ক্যানিং, ভাঙ্গরের মানুষ গত ৫-৭ বছর ধরে জোট বেঁধে দাবী জানিয়ে আসছেন সুবিচারের। বেশকিছু গণসংগঠন পাশে দাঁড়িয়েছে, যাওয়া হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে। আইনজীবীরা লড়াই করেছেন মহামান্য আদালতের সামনে এই মানুষগুলোর অধিকারের জন্য, আর একের পর এক মিছিল, বিক্ষোভ, ডেপুটেশন আছড়ে পড়েছে দুই ২৪ পরগণার নানা প্রশাসনিক দপ্তরে। এই লড়াইকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় ১০টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন, ৪টি স্বাস্থ্য সংগঠন, এবং আরো কিছু গণসংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জন্য গড়ে তোলা হল ‘Coordination Committee against Silicosis and other Occupational Diseases’।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পাঁচ দশক এই নিয়ে কোন আলোচনা না থাকলেও গত ২৫ বছর এই বিষয়টি অনেকেরই নজরে এসেছে, গড়ে উঠেছে প্রতিবাদ আন্দোলন, আইনি লড়াই, যদিও শ্রমিক সংগঠনের বদলে অনেক ক্ষেত্রেই ভূমিকা নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও NGO সংগঠন। গত ২-৩ বছরে হরিয়ানা ও রাজস্থানের সরকার সিলিকোসিস আক্রান্তদের জন্য ঘোষণা করেছেন পুনর্বাসন প্রকল্প, নিয়ম না মানা শিল্পক্ষেত্রের ওপরও চাপ বেড়েছে।

ভারত সরকারের কোন সদিচ্ছা না থাকার কারণে কত শ্রমজীবী মানুষ এই বিপদের মধ্যে আছেন তার কোন নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সংসদে পেশ করা ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র সংগঠিত শিল্প ও নির্মাণশিল্প মিলিয়েই ১ কোটির বেশী মানুষ এই বিপদের আওতায় আছেন। সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্র ধরে হিসেব করলে আসল সংখ্যা বেশ কয়েক কোটিই হয়তো হতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গেও পশ্চিমাঞ্চলের বিরাট পাথুরে এলাকা জুড়ে রমরমা এক শিল্প চলছে গত কয়েক দশক ধরেই। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই শিল্পের প্রায় পুরোটাই থেকেছে আইনের আওতার বাইরে। এর ফলে নিয়ম, আইন, ও শ্রমিক সুরক্ষার প্রশ্নগুলোই অবান্তর থেকে গেছে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকার তার প্রাপ্য রাজস্ব হারিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে সারা রাজ্য থেকে এখানে কাজ করতে আসা অগুন্তি পরিযায়ী শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছেন, সবার অজান্তে সিলিকোসিসে প্রাণ হারিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, সমস্ত ধরনের পেশাগত রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশী এবং বিপজ্জনক হল ফুসফুসের রোগ, যার সাধারণ নাম হল নিউমোকোনিওসিস (Pneumoconiosis), যাকে সহজ করে বললে বলা যায় যে কর্মক্ষেত্র অনুযায়ী নানা ধরনের ধুলো নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে ফুসফুসে জমা হয়ে ফুসফুসের অচল হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে অল্প বয়সেই প্রায় নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। ধুলোর রকমফের অনুযায়ী রোগের আবার আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়, যেমন সিলিকার (পাথর, বালি, সিমেন্ট, রাস্তার ধুলো, ইটভাটার মাটি) গুঁড়ো হলে তাকে বলা হয় সিলিকোসিস, কয়লা বা কার্বন গুঁড়ো হলে তাকে বলি অ্যান্থ্রাকোসিস, পাট, তুলো বা পশমের রোঁয়া থেকে হলে বলা হয় বিসিনোসিস, বা অ্যাসবেস্টস শিল্প থেকে হলে বলা হয় অ্যাসবেস্টোসিস, ইত্যাদি।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in