নিষিদ্ধ বস্তুর সম্বন্ধে আসক্তি বাড়ে - 'The Kerala Story'-র নিষেধাজ্ঞায় রাজ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। বাঙলা বিভাগের এক ছাত্র স্পষ্টই জানিয়েছেন, এই চলচ্চিত্রে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যা একদমই অপ্রয়োজনীয়।
"দ্য কেরালা স্টোরি"র পোস্টার
"দ্য কেরালা স্টোরি"র পোস্টারছবি সংগৃহীত

তিন দিন আগে সোমবার পশ্চিমবঙ্গে ব্যান হয়েছে দ্য কেরালা স্টোরি। গত ৫ মে মুক্তি পাবার তিন দিনের মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের এক উচ্চ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, যিনি কোনোদিন সিনেমা হলের ধার মাড়াননি, চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহও নেই। কিন্তু কেরালা স্টোরি ব্যান হবার পর রাতারাতি মোবাইলে সেই সিনেমা ডাউনলোড করে দেখে ফেলেছেন। এটা হয়তো একটা উদাহরণ। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, শেষ দু’দিনে এই ঘটনা রাজ্যের বুকে লাখে লাখে ঘটেছে এবং সেটা ঘটেছে এই চলচ্চিত্র ব্যান করার পরেই।

দ্য কেরালা স্টোরি নিয়ে রাজ্যের মানুষের আগ্রহ একদম ছিলোনা এরকমটা একদমই নয়। যেহেতু প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র, তাই এর পক্ষে এবং বিপক্ষে প্রথম থেকেই বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। বিতর্ক ছিল সংখ্যা নিয়েও। পরিচালক সুদীপ্ত সেন যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ৩২ হাজার থেকে সংখ্যা কমিয়ে ৩-এ নিয়ে আসেন তখন সেই বিতর্ক আরও দানা বাঁধে। এই পরিস্থিতিতে আগ বাড়িয়ে দেশের প্রথম রাজ্য হিসেবে এই চলচ্চিত্র ব্যান করে দেওয়ায় বিতর্ক আরও বেড়েছে। সরাসরি পক্ষে এবং বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েছে দুই দল।

চলচ্চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত, যার ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’ প্রদর্শনে এর আগে বাধা দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক তরফে, তিনি এই ব্যান প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমে বলেন, নির্বাচন চলে এসেছে। সুতরাং এই সময়ে মানুষকে পোলারাইজ করার যে সম্ভাবনা তাকে ছাড়বে কেন? এটা আগুনে ঘি ঢালার মতন বিষয়।

অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন বলেন, "প্রতিটি শিল্পীর স্বাধীনতা থাকা দরকার। এই চলচ্চিত্র বন্ধ করা খুব একটা বিচক্ষণতার কাজ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ছবিটা দেখে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয়না।" তিনি আরও বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত কোনও রাজনৈতিক সুবিধা দেবে না। বরং নিষিদ্ধ করে ছবিটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হল।”

নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘‘কোনও ছবি বা নাটকে যদি মনে হয় ভুল কথা বলা হয়েছে, তবে তার পাল্টা নতুন কিছু করতে হয়। সেটার উপরে নিষেধাজ্ঞার কোনও অর্থ হয় না। আমি যেটুকু শুনেছি, তাতে ছবিটা তেমন কিছু হয়নি। মানুষ এমনিতেই গ্রহণ করতেন না। তবে এখন নিষেধাজ্ঞা কৌতূহল বাড়িয়ে দেবে। অনেকেই দেখবেন।”

আবার চলচ্চিত্র ব্যানের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন অভিনেতা পরিচালক কৌশিক সেন। তিনি সংবাদমাধ্যমে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘‘এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আমার কাছে ব্যাপারটা দুঃখজনক মনে হয়নি। আমরা যখন ইতিহাসের কথা বলি, তখন মনে রাখতে হবে আমাদের চারপাশটা কত বদলে গিয়েছে। আগে যেটা বুঝতে পারিনি বা বিশ্বাস করিনি কিন্তু এখন বুঝি যে, আমাদের অনেকের মনের গভীরে সাম্প্রদায়িকতা বাস করে।”

কৌশিক সেন আরও বলেন, গরিব মানুষ এই ছবিগুলো দেখতে যাবেন না। কিন্তু গোষ্ঠীসংঘাত হলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যাঁরা এই ছবি দেখবেন, সেই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজটাই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক। সব ধর্মেই। তাঁরা সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়াবেন। কিন্তু গোলমাল হলে তাঁদের গায়ে আঁচ লাগে না। ভোগেন গরিবরা।”

যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। বাঙলা বিভাগের এক ছাত্র স্পষ্টই জানালেন, এই চলচ্চিত্রে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যা আমার মতে একদমই অপ্রয়োজনীয়। অন্য এক ছাত্র বলেন, একটা নেগেটিভ আইডিয়াকে প্রোপাগেড করার জন্য এই চলচ্চিত্র। অন্য এক ছাত্র বলেন, এখন যে জিনিস ব্যান করা হয় তা আরও বেশি করে জনপ্রিয় হয়। কাজেই এই ব্যান সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় বলেই আমি মনে করি।

সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জনৈক দেবরাজ ব্যানার্জি লিখেছেন, কাশ্মীর ফাইলস পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ হয়নি। কেরালা স্টোরি ও নিষিদ্ধ করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। মানুষকে বুদ্ধিহীন ভাবা উচিত নয়... মানুষ দেখত এবং বিচার করতো। নিষিদ্ধ বস্তুর সম্বন্ধে আসক্তি বাড়ে। আসলে কি বিষয়টাকে উসকে দেওয়া হল?

চিত্রপরিচালক শারণ দত্ত তাঁর ফেসবুক পোষ্টে লিখেছেন, "কেরালায় হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের সংখ্যা ৩২,০০০ থেকে ৩ হয়ে যাওয়া থেকেই তো বোঝা গেছে এটা ঢপ বাজি। কিন্তু কোনো ছবি না দেখে, কোনো কবিতা না পড়ে, কোনো গান না শুনে কি করে তার গুণ বিচার হচ্ছে? আবারও বলছি, দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক প্রচারকে হাওয়া দেওয়ার জন্যই এই ব্যানের নাটক হচ্ছে। বিজেপি যার এই রাজ্যে বলার মত আর কিছু নেই, তাকে কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।"

অন্যদিকে রাজ্য সরকার নিষিদ্ধ করার পরেও বেলুড়ে এক সিনেমা হলে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ দেখানো নিয়ে মঙ্গলবার ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বাধে দর্শকদের। জানা গেছে, বেলুড়ের একটি মাল্টিপ্লেক্সে দেখানো হচ্ছিল এই ছবি। কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারিভাবে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রর্দশন বন্ধ করার কোনও নির্দেশ তাদের কাছে আসেনি।

অন্যদিকে, একাধিক জায়গায় এই ছবি দেখানোর দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আমজনতা। সিনেমা হলগুলিতে ফের এই সিনেমা ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিজেপি কর্মীরা।

"দ্য কেরালা স্টোরি"র পোস্টার
কেরালা স্টোরির মাঝেই সামনে এলো গুজরাট স্টোরি, মোদী-শাহের রাজ্য থেকে নিখোঁজ ৪১ হাজার মহিলা

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in