স্কুল আছে। ছাত্র আছে। কিন্তু মাষ্টারমশাই নেই। এই রাজ্যেই এরকম স্কুলের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। যেসব প্রাথমিক স্কুলে কোনও শিক্ষক নেই অথবা ১ জন শিক্ষক আছে। বহু ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা এইসব স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। কমছে ছাত্র ভর্তির সংখ্যা। আরও বেহাল হচ্ছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা। যে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে জেলায় জেলায় সমান্তরালভাবে গড়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল এবং যে সব স্কুলে ভর্তি হচ্ছে বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী। সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও বহু অভিভাবক এইসব স্কুলে অতিরিক্ত খরচ করে সন্তানকে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে ভয়াবহ এই তথ্য জানা গেছে। গত ৫ আগস্ট লিখিত এক সরকারি চিঠির তথ্য অনুসারে রাজ্যের মোট ২২ টি জেলায় এই ধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২,২১৫। যা এই রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার অন্ধকারময় ছবিকেই আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে। যেখানে সমস্যাটা যতটা না পরিকাঠামোগত তার চেয়ে বেশি 'সরকারি অবহেলার'। যাকে 'পরিকল্পিত অবহেলা' বলেই বিশেষিত করছে শিক্ষক সংগঠন।
রাজ্য সরকারের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের সাম্প্রতিক নির্দেশে সমস্ত জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিষদকে প্রয়োজন অনুসারে জেলার ভেতর থেকেই বদলি করে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে জানানো হয়েছে, রাইট অফ চিল্ড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯ অনুসারে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ জন পর্যন্ত ছাত্রের জন্য কমপক্ষে ২ জন শিক্ষক থাকতেই হবে। যদিও রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে আইন মোতাবেক কিছুই হয়নি। উল্টে এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়েছে রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার করুণ অবস্থা। এই নির্দেশিকা থেকে এটাও স্পষ্ট যে এখনই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সরকারের কোনও পরিকল্পনা নেই।
বেঙ্গল শিক্ষা পোর্টাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, কোনও শিক্ষক নেই অথবা ১ জন শিক্ষক আছে এরকম স্কুলের সংখ্যার শীর্ষে থাকা প্রথম পাঁচটি জেলা হল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান এবং বীরভূম। ক্রমানুসারে এই পাঁচ জেলায় এই ধরণের স্কুলের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৭২, ৩৭১, ২২৭, ১৭৮ ও ১৫৬। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় প্রাথমিক শিক্ষায় এই জেলাগুলিই সবথেকে অবহেলিত। এই তালিকায় নীচের দিকে আছে শিলিগুড়ি (১১), মালদা (১২), হাওড়া (১৩), কলকাতা (১৮) এবং আলিপুরদুয়ার (২৭)।
রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যে কীভাবে চলছে তা এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট। যদিও এটুকু পড়েই আঁতকে ওঠার মত যথেষ্ট কিছু হয়নি। কারণ বিগত দশ বারো বছর ধরে রাজ্যে ক্রমশ ক্রমশ কমেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা। স্কুলের সংখ্যা কমার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে কমেছে ছাত্র ভর্তিও। তথ্য অনুসারে ২০১২ সালে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ৭৪,৭১৭। যা ২০২২ সালের মার্চ মাসে কমে হয় ৬৭,৬৯৯। আর ২০২৫ সালের ৫ আগস্টের তথ্য অনুসারে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯,৩৬৮। অর্থাৎ ২০১২ থেকে থেকে ২০২৫-এর জুলাই মাসের মধ্যে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা কমেছে ২৫,৩৪৯।
২০১২ থেকে ২০২২-এর মার্চ মাস পর্যন্ত তথ্য অনুসারে, সবথেকে বেশি প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায়। সংখ্যার হিসেবে যা প্রায় ১,১৯২। তালিকায় এর পরেই ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নাম। ২০১২ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ঝাড়গ্রাম। যা পরবর্তী সময়ে আলাদা জেলা হয়েছে। ২০১২ সালে ঝাড়গ্রাম সহ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ৮,৪০৪। যা ২০২২-এর পরিসংখ্যান অনুসারে কমে দাঁড়িয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরে ৫,৪১১ এবং ঝাড়গ্রামে ১৯৪৬। দুয়ের যোগফল দাঁড়ায় ৭,৩৫৭। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও প্রাথমিক স্কুল কমেছে ১,০৪৭। একইভাবে ২০১২ থেকে ২০২২-এর মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরে প্রাথমিক স্কুল কমেছিল ৮৬৭টি।
রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক চিঠির তথ্য অনুসারে বর্তমানে রাজ্যে মোট প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৪৯,৩৬৮। যার মধ্যে ২,২১৫ স্কুলে শিক্ষক নেই অথবা একজন শিক্ষক। বর্তমান তালিকা অনুসারে সবথেকে বেশি প্রাথমিক স্কুল দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। ৩,৭৮৬টি। অন্যদিকে সবথেকে কম প্রাথমিক বিদ্যালয় শিলিগুড়িতে, ৩৯৩টি। জেলাওয়াড়ি যে হিসেব পাওয়া গেছে তাতে জেলা প্রতি ৩ হাজারের ওপর স্কুল আছে বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়। যদিও এই পরিসংখ্যানে ৪৯,৩৬৮ স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা মোট কত তা দেওয়া নেই। ফলে এতগুলি স্কুল সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কত শিক্ষক প্রয়োজন, বর্তমানে কতজন শিক্ষক আছে এবং শূন্যপদ ঠিক কত তাও স্পষ্ট নয়। যদিও প্রাথমিক নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনরতদের বক্তব্য অনুযায়ী রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলে শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
এই বিষয়ে রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠন এবিপিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক ধ্রুবশেখর মণ্ডল পিপলস রিপোর্টারকে জানান, “সরকার এই ব্যবস্থা করছে যাতে সামগ্রিকভাবে শিক্ষাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া যায়। সরকার খুব সচেতনভাবেই এটা করছে। সংগঠনের বহুদিনের দাবি যে প্রতিটি স্কুলে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষক দেওয়া হোক। আমরা উপলব্ধি করি যে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষক না দিলে প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং বেকারদের চাকরির দাবিকে নস্যাৎ করা, দুটো কাজই একসঙ্গে করছে সরকার। ২০২২ থেকে সরকার বলছে দ্রুত নিয়োগ করবে। ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বসে আছে। তবুও নিয়োগ হচ্ছে না।”
পিপলস রিপোর্টারের প্রশ্নের উত্তরে ধ্রুবশেখর মণ্ডল জানান, “প্রান্তিক অঞ্চলে যেখানে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া সবথেকে বেশি প্রয়োজন, সেখানে দেখা যাচ্ছে সেইসব অঞ্চলে শিক্ষাকে সবথেকে অবহেলা করা হচ্ছে। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সরে আসা উচিত। যারা শিক্ষক আছেন সেখান থেকে বদলি নয়, নতুন নিয়োগ করে এই ব্যবস্থা করা উচিত।”
২০২১-এর ২ আগস্ট লোকসভায় ভগবত মানের করা এক প্রশ্নের উত্তরে (Starred Question 195) তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছিলেন, আরটিই আইন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে ২৩.১৪ সরকারি স্কুলে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত কম এবং সরকারি পোষিত স্কুলে এই হার ৪৯.৫ শতাংশ। দেশের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ২৬.৮৮ শতাংশ এবং ৩২.৯ শতাংশ। ওই প্রশ্নের উত্তরেই মন্ত্রী জানিয়েছিলেন ২০২০-২১-এ পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিকে মোট পদের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৩৯ হাজার ২১৭ এবং কর্মরত ছিলেন ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯২২। শূন্যপদের সংখ্যা ৫৯,৯২৫।
সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে আগামী দিনে রাজ্যের বহু শিশু বঞ্চিত হবে শিক্ষার অধিকার থেকে। বিশেষ করে সেইসব প্রান্তিক অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের সন্তান সন্ততিরা। যাদের কাছে একমাত্র ভরসা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কারণ সব অভিভাবকের পক্ষে বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠানো সম্ভব নয়। তাদের সে সামর্থ্যও নেই। ফলে এক বড়ো অংশের শিশু বিদ্যালয়ের গণ্ডীর বাইরে, শিক্ষার গণ্ডীর বাইরেই থেকে যাবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন