পুনরায় লাল সান্তিয়াগো - চিলের কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, পতন ও পুনরুত্থানের ইতিকথা

সমগ্র ৯০-এর দশক চিলের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সর্বাপেক্ষা খারাপ সময় ছিল। পার্লামেন্টে আসনও শূন্য হয়ে যায়। এত খারাপ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি কখনও পড়েনি।
পুনরায় লাল সান্তিয়াগো - চিলের কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, পতন ও পুনরুত্থানের ইতিকথা
গ্রাফিক্স- নিজস্ব

পৃথিবীর আর পাঁচটি রাজনৈতিক আন্দোলনের তুলনায় কমিউনিস্ট আন্দোলন ঠিক কোন জায়গায় পৃথক ? এর উত্তর অনেক ভাবে প্রদান করা যেতে পারে। তার বিশালত্বে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, তার একমুখী শৃঙ্খলায় ? এর প্রত্যেকটিই সঠিক। কিন্তু এই একই কথা কমিউনিস্ট ব্যতীত আরও রাজনৈতিক প্রকল্প আর আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু একটি বিষয়ে সম্ভবতঃ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন অন্য যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের থেকে পৃথক। অপর কোন রাজনৈতিক আন্দোলন বারংবার কল্পনাতীত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় নি।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় ব্লকের পতনের পর এ কথা মনে হয়েছিল, কমিউনিস্ট আন্দোলন আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তার আর মানবসভ্যতার জন্য দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পরবর্তী তিন দশকের অভিজ্ঞতা এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। হয়তো সোভিয়েত ধাঁচের সাম্যবাদের আর দেওয়ার কিছু নেই – কিন্তু এই চূড়ান্ত অসাম্যের দুনিয়ায় সাম্যবাদের এখনও বহুকিছু দেওয়ার আছে। মজার বিষয় হল, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য ও সংকটই মুমূর্ষুপ্রায় সাম্যবাদী আন্দোলনকে দেশে দেশে ধীরে কিন্তু স্থির ভাবে নবরূপে শক্তিশালী করছে। এই প্রবণতার নবতম সংযোজন চিলে।

চিলে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে চিরকালই সাম্যবাদী আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কমিউনিস্ট পার্টি অফ চিলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। এটি ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন ও সুশৃঙ্খল কমিউনিস্ট পার্টি, পাবলো নেরুদা, ভায়োলেটা পারা, ভিক্টর হারার পার্টি। পৃথিবীর অন্য সব কমিউনিস্ট পার্টির মতোই চিলের কমিউনিস্ট পার্টিরও জন্মলগ্ন থেকে একটা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির দমন-পীড়ন ও অত্যাচারকে এড়িয়ে নিজেদের সংগঠিত করার সংগ্রামে। প্রাথমিক ভাবে তাদের সংগঠনের লক্ষ্য ছিল চিলের শ্রমিক শ্রেণী এবং বিংশ শতকের তিনের দশকের মধ্যেই তাদের মধ্যে চিলের পার্টি গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

তিরিশের দশকের মাঝামাঝি কমিন্টার্নের সপ্তম কংগ্রেসে পপুলার ফ্রন্টের নীতি গৃহীত হয়। এই নীতি মূলতঃ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদকে রোখার কৌশল হিসেবে গৃহীত হলেও ল্যাটিন আমেরিকাতে চিলের কমিউনিস্ট পার্টি বহু ইউরোপীয় কমিউনিস্ট দলের থেকে এই নীতি সাফল্যের সঙ্গে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এই কালপর্বে প্রেসিডেন্ট আলেসান্দ্রির এমার্জেন্সি শাসনের বিরুদ্ধে নবগঠিত ‘Confederation of Chilean Workers’ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আলেসান্দ্রির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যালিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলিকে পপুলার ফ্রন্টের মাধ্যমে একজায়গায় আনতে সক্ষম হয়। এতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন বৃদ্ধি পায়, একই সাথে শ্রমিক শ্রেণীর বাইরেও দেশের এক বিপুল অংশের মানুষের কাছে নিজেদের নীতি, বার্তা ও বিকল্প মডেল পৌঁছে দিতে তাঁরা সক্ষম হন এবং একই সঙ্গে হিটলারের অনুপ্রেরণায় চিলেতে যে নাৎসি মতাদর্শের বিকাশ ঘটছিল তাকেও তাঁরা রুখে দেন। ১৯৩৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কমিউনিস্টদের ও পপুলার ফ্রন্টের সমর্থিত প্রার্থী পেড্রো অ্যাগুয়েরা সের্দা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয় লাভ করেন। এর পর থেকে ১৯৪৭ সাল অবধি প্রথমে পপুলার ফ্রন্ট ও পরে ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স নামে চিলের সরকারের নীতি নির্ধারনে কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রকেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে।

কিন্তু ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে। এই ফলাফল ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষিতে দেশের শাসক শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট শঙ্কার জন্ম দেয়। প্রবল দক্ষিণপন্থী চাপে রাষ্ট্রপতি ভিদেলা কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর থেকে ১৯৫৮ সাল অবধি কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতে সংগঠনের খুব ক্ষতি হয় নি। কারণ সোশ্যালিস্ট পার্টির মতো সম-মনোভাবাপন্ন দলের মধ্যে কমিউনিস্ট কর্মীরা তাঁদের কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ষাটের দশকে সোশ্যালিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা হিসেবে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে যিনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তিনি হলেন সালভাদোর আয়ান্দে। আয়ান্দের আমলে ষাটের দশকে সোশ্যালিস্ট-কমিউনিস্ট জোট আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি বৃহত্তর বাম ঐক্যের জন্য ধর্ম বিষয়ে তার কঠোর অবস্থান থেকেও অনেক স্থানে সরে আসে ও খ্রিস্টান সোশ্যালিস্টদের তাঁদের দিকে টেনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই বাম ঐক্যের ফলেই ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আয়ান্দে জয়লাভ করে ও চিলেতে বামপন্থী ‘পপুলার ইউনিটি’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু অভূতপূর্ব পদক্ষেপ ও বৈপ্লবিক নীতি নিলেও এই সরকার কিন্তু বেশিদিন চলতে সক্ষম হয় নি। কিউবার পর ল্যাটিন আমেরিকায় দ্বিতীয় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে মেনে নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজি ছিল না। CIA-এর সহায়তায় একটি সামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর সালভাদোর আয়ান্দের সরকারকে ফেলে দেওয়া হয়। চিলের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

জেনারেল আগস্টো পিনোচের সামরিক শাসনে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি চূড়ান্ত অত্যাচারের ও রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের সম্মুখীন হয়। ভিক্টর হারার মতো প্রখ্যাত আইকন, যিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও গায়ক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন – কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে তাঁকেও অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে পার্টির মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা দেয়। একদিকে নরমপন্থীরা মনে করেন জনসমর্থনের ভিত্তি আরও দৃঢ় না করে, আরও সংস্কারমুখী অবস্থান না নিয়ে দ্রুত বিপ্লবী কর্মসূচী পালন করার ফলেই এই বিপর্যয় হয়েছে আর অপরদিকে চরমপন্থীরা মনে করেন যথেষ্ট পরিমাণ বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করা হয়নি বলেই এই অবস্থা। প্রথম পক্ষ তখনও গোপনে সংগঠন গড়ে তোলার, শক্তিসঞ্চয় করার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে সামিল হওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন – দ্বিতীয় পক্ষ সশস্ত্র বিপ্লবকে একমাত্র পন্থা বলে মনে করেছিলেন। দ্বিতীয় পক্ষের এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে FPMR নামক গেরিলা সংগঠনের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে। প্রাথমিক ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলেও, অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায় FPMR-এর উপর কমিউনিস্ট নেতাদের আর নিয়ন্ত্রণ নেই। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে FPMR সেনাশাসক পিনোচেকে হত্যার এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা করে – কিন্তু ব্যর্থ হয়। এই সংগঠন আর চিলের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে দুই সংগঠনের মধ্যে সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে সকল দলের সঙ্গে একত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফেরত আনার জন্য গণআন্দোলনের পথে যাওয়াই সঠিক মনে করে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে নিজের শাসন ১৯৯৭ সাল অবধি বজায় রাখার জন্য পিনোচে আন্তর্জাতিক চাপে এক গণভোটের আয়োজন করে। আশা করা হয়েছিল তিনি সহজেই জয়ী হবেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে, চিলের মানুষ সাহসের সঙ্গে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেয় ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে পাওয়ার স্বপক্ষে মতদান করে।

সেনাশাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসনে চিলে ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু আপাত ভাবে গণতন্ত্র জয়ী হলেও, পিনোচের এত সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কারণ ছিল পৃথক। রাজনৈতিক দল, ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি পুনরায় স্বীকৃত হলেও পিনোচের প্রণীত ১৯৮০-সালের সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামোতে কোন হাত পড়েনি। রাষ্ট্রের চাবি কাঠি তাঁর নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের হাতেই ছিল, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ছিল চূড়ান্ত নব্য-উদারনৈতিক যা দেশে গভীর অসাম্যের সৃষ্টি করে চলেছিল। এমতাবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাধনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যায়। পূর্বের তুলনায় তাদের পক্ষে এই কাজ অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টি তার পূর্বের মার্কসীয় অবস্থান ত্যাগ করে ও একটি মধ্য-বাম দলে পরিণত হয় – দেশের বাকি সকল বামপন্থী দলও তাদের অবস্থান আরও দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে যায় ও পিনোচের রেখে যাওয়া কাঠামোর সঙ্গে আপোষ করে নেয়।

সমগ্র ৯০-এর দশক চিলের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সর্বাপেক্ষা খারাপ সময় ছিল, নির্বাচনী রাজনীতিতেও একদা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দলের ব্যপক ভরাডুবি হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো রাজনৈতিক জোট সঙ্গীরাও তাঁদের প্রতি আর সদয় ছিলেন না। পার্লামেন্টে আসনও শূন্য হয়ে যায়। এত খারাপ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি কখনও পড়েনি।

১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি তার শোচনীয় অবস্থার সমাধানের উদ্দেশ্যে দুটি কৌশল গ্রহণ করে। একদিকে তারা ছোট ছোট বামদলগুলিকে একছাতার নীচে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায় – অন্যদিকে তারা একের পর এক গণআন্দোলন করে যেতে থাকে। ২০০৬ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা থাকলেও ও তাদের সরকারকে তারা স্বাগত জানালেও এই গণআন্দোলনের কাজ তারা ছাড়েনি।

২০০৬-এর ছাত্র আন্দোলন, ২০০৮ সালের দেশ ব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টির নতুন প্রজন্মকে তৈরি করে। ২০১১-১৩-এর ছাত্র আন্দোলনের সময় এই নতুন প্রজন্মের বহু তরুণ মুখ, যেমন চিলের ছাত্র সংগঠন FECh-এর প্রেসিডেন্ট ক্যামেলিয়া ভালেহো, গণআন্দোলনে তাঁদের দক্ষতার পরিচয় রাখেন। রাষ্ট্রীয় ভাষ্যকে কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশঃ আরও বাম দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকারে এর মধ্যে অংশগ্রহণ করলেও কমিউনিস্ট পার্টির পাখির চোখ ছিল একটিই – তা হল ১৯৮০ সালের পিনোচে সংবিধানের অবসান। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেও তারা জনমত গড়ে তুলতে থাকে। ২০১৯ সাল তাদের সামনে ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দেয়।

সান্তিয়াগোতে প্রাথমিক বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল মেট্রো ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে। স্বতঃস্ফূর্ত এই গণবিক্ষোভ ক্রমশ সামগ্রিক নব্য-উদারনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধেই ঘুরে যায়। এইরকম সুযোগ অনেক দেশে আগেও আমরা দেখেছি। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘Occupy Wall Street’ – আন্দোলনের সময় এইপ্রকার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কোন সংগঠিত পার্টির উপস্থিতির অভাবে সেই পরিস্থিতি থেকে কোন সুবিধা অর্জন করা সম্ভবপর হয় নি। কিন্তু এক্ষেত্রে চিলের কমিউনিস্ট পার্টি গণ-আন্দোলনের ইঞ্জিন হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করল ও অসংগঠিত গণ ক্ষোভকে সংবিধান উচ্ছেদ করার একটি বিশেষ লক্ষ্যে চালিত করতে সক্ষম হল। প্রবল গণ-আন্দোলনের চাপে ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী ‘চিলে ভামোস’ জোটের রাষ্ট্রপতি পিনেরা সরকার বাধ্য হল আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান বিষয়ে মতামত নিতে।

২০২০-এর গণভোটে প্রায় ৭৮% চিলের জনতা মতপ্রদান করলেন সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য দাঁড়ালো দ্বি-মুখী। নবগঠিত সংবিধান সভায় বাম সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও একই সঙ্গে দক্ষিণপন্থীরা যাতে এক-তৃতীয়াংশ আসনও না পায় তা সুনিশ্চিত করা, কারণ তাহলেই তাদের কাছে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা চলে আসবে। এই সময়েই সোশ্যালিস্ট পার্টির ‘নিউ মেজরিটি’ জোট এবং ন্যাশনাল রিনিউয়াল পার্টির ‘চিলে ভামোস’-এর বাইরেও কমিউনিস্ট পার্টি গত দু-দশক যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেই সব ছোটো র‍্যাডিক্যাল বামপন্থী দলের ঐক্য ও তৃতীয় একটি বিকল্প ‘ব্রড ফ্রন্ট’ নামক জোটের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

এই নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের অগ্নিপরীক্ষা ছিল গত ১৫ ও ১৬-ই মে-এর সংবিধান সভার নির্বাচন। ফলাফল ঘোষিত হতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, কমিউনিস্টরা তাঁদের সব উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রায় ১৮% ভোট এবং ২৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে তাঁরা সংবিধান সভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় স্থানে ১৬% ভোট পেয়ে বামপন্থী স্বাধীন প্রার্থীদের ২৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন যাঁদের ভাবনা, প্রস্তাব ও কার্যক্রমের সঙ্গে বাম জোটের বিশেষ ফারাক নেই। ২০% ভোট ও ৩৭-টি আসন পেয়ে সংবিধান সভায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও দক্ষিণপন্থী জোট এক-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করতে সক্ষম হয় নি, ফলে তাদের পক্ষে নতুন সংবিধানের বিভিন্ন প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ কার্যত অসম্ভব হয়ে গেল। সর্বোপরি ১৪.৫% ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন মধ্য-বামেদের চলে যাওয়া প্রমাণ করে দিল চিলের বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় পার্টির অবস্থান আর তাদের নেই। এই নির্বাচনের ফলাফল পিনোচের সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোর অবসানের অন্তিম ঘণ্টা বাজিয়ে দিল – আর তার সঙ্গে এটও স্পষ্ট করে দিল তার শবাধারে শেষ পেরেক ঠুকতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করবে সেই চিলের কমিউনিস্ট পার্টি যাকে ধ্বংস করতে হেন কাজ নেই যা পিনোচে ও তাঁর রক্ষাকর্তা এবং পরামর্শদাতা CIA করেনি।

সংবিধান সভার নির্বাচনের পাশাপাশি কিছু অঞ্চলে স্থানীয় নির্বাচনও ছিল চিলেতে। সেখানেও কমিউনিস্ট ও বামেরা চমকপ্রদ ফল করেছে। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রাজধানী সান্তিয়াগোর মেয়রপদে কমিউনিস্ট প্রার্থী ইরাসি হাসলারের বিজয়। পিনোচের শাসনব্যবস্থার হৃদয় ছিল যে শহর সেখানেই পুনরায় কাস্তে-হাতুড়ি খচিত রক্ত পতাকা তুলে ধরেছেন বছর তিরিশের পেশায় প্রকৌশলী ইরাসি। আরও চমকপ্রদ বিজয় এসেছে রিকোলেতা তে মেয়র পদপ্রার্থী কমিউনিস্ট নেতা ড্যানিয়েল হাউয়ের তরফ থেকে। তিনি প্রায় ৬৬% ভোট পেয়ে জয় লাভ করেছেন। এই বিজয় আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বছরের নভেম্বরে যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে, তাতে তিনি বামপন্থীদের তরফ থেকে পদপ্রার্থী ও বিভিন্ন ওপিনিয়ন পোল অনুসারে তাঁর বিজয়ের উচ্চ সম্ভবনা রয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টি ও চিলের সামগ্রিক বামপন্থী আন্দোলনের যে ইতিবাচক পরিস্থিতি – তাতে এই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত হওয়ার উচ্চ সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু তা যদি নাও হয়, চিলের কমিউনিস্টরা আবার অপেক্ষা করবেন, নিজেদের সংগঠিত করবেন, গণ আন্দোলনের পথে যাবেন সমাজতন্ত্রকে পাখির চোখ করে। কারণ প্রায় শত বছরের পুরনো এই পার্টির স্মৃতির পাতা থেকে মোছেনি প্রায় শত বছর আগে রচিত জার্মান কমিউনিস্ট বিপ্লবী কার্ল লিবনিখটের আগুনরাঙা অক্ষর - ‘And whether we will still be alive when it is reached – our programme will live; it will rule the world of humanity redeemed. In spite of everything!’ তাঁদের নিজেদের দলের ইতিহাসের শিক্ষা - ‘A people united, shall never be defeated’ – তাঁরা এখনও ভোলেননি।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in