
এখনই যদিও সেভাবে কিছু বলার সময় আসেনি, কিন্তু তামিল অভিনেতা রাজনীতিবিদ থালাপতি বিজয় (Thalapathy Vijay) যে আগামী দিনে তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছেন তা স্পষ্ট। বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবার ২১ আগস্ট মাদুরাইতে তাঁর তামিলাগা ভেট্টরি কাজাঘাম (Tamilaga Vettri Kazhagam – TVK) দলের সমাবেশে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি রাজ্যের রাজনৈতিক মহলকে বিস্মিত করেছে সন্দেহ নেই।
এর আগে অভিনেতা কমল হাসানও তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন নিজের রাজনৈতিক দল তৈরি করে। তাঁর মাক্কাল নিধি মইয়াম (Makkal Needhi Maiam) তামিলনাড়ুর জনমানসে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ১৮৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমএনএম পেয়েছিল মাত্র ২.৬২ শতাংশ ভোট এবং কোনও আসনেই জয়ী হতে পারেনি। থালাপতি বিজয়ের ক্ষেত্রে ছবিটা ঠিক কী দাঁড়ায় তার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
রাজনীতিতে নামার আগে যে দীর্ঘদিন হোমওয়ার্ক করেছেন বিজয় এবং সে হোমওয়ার্ক যে যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়ে করেছেন তার প্রমাণ ২১ আগস্টের উপচে পড়া সমাবেশ। নিজের রাজনৈতিক দল ঘোষণার আগে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবামূলক কাজ করে চলেছেন অভিনেতা। দুঃস্থদের খাদ্যসামগ্রী বণ্টন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ বহন, গ্রন্থাগার নির্মাণ, এমনকি বিনামূল্যে বহু ছেলেমেয়েকে টিউশনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বিজয়। কোর্ট-কাছারি করতে গিয়ে টাকার অভাব পড়লে বিজয় বিনামূল্যে আইনি সহায়তার ব্যবস্থাও করে দেন।
কিছুদিন আগেও তামিলনাড়ুর সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত এবং এই সময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় তারকা থালাপতি বিজয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর রাজনৈতিক দল 'তামিঝাগা ভেত্রি কাজগম'-এর ঘোষণা করেন। সেইসময়েই তিনি অভিনয় জীবন থেকে অবসর নেবার কথাও প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন। অভিনেতা হিসেবে ৬৭টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং বিশাল ফ্যান বেস নিয়ে, বিজয় তাঁর রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতি এবং রাজনীতিতে বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর অনেকটাই সময় নিয়ে তাঁর প্রকাশ্য সমাবেশ। যে সমাবেশ ভিড়ের নিরিখে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
তামিলনাড়ুর রাজনীতি বা দ্রাবিড় রাজনীতির সঙ্গে চলচ্চিত্রের একটা যোগাযোগ বহুদিন থেকেই আছে। এই রাজ্যের বহু রাজনীতিবিদই অতীতের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তারকা। যারা পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। এই তালিকায় এম জি রামচন্দ্রন (এআইএডিএমকে), শিবাজী গণেশন, এম করুণানিধি (ডিএমকে), জে জয়ললিতা (এআইএডিএমকে), বিজয়কান্ত (ডিএমডিকে), খুশবু সুন্দর, উদয়নিধি স্ট্যালিন - অনেকেরই নাম করা যায়। থালাপতি বিজয়ও সম্ভবত সেই তালিকাতেই নাম লেখাতে চলেছেন।
রাজনৈতিক দল টিভিকে-র ঘোষণার পর থেকেই রাজনীতিতে নিজের আদর্শের কথা বলতে গিয়ে সবসময় বি আর অম্বেডকর, পেরিয়ার, কামারাজের কথা উল্লেখ করেন বিজয়। রাজনীতিতে ভাল-মন্দ দুই-ই আছে, ভালোকে গ্রহণ করে, খারাপটিকে বিসর্জন দিতে হবে বলে বার্তা দেন তিনি। যে কোনও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সরব হতে দেখা গেছে তাঁকে।
তামিলনাড়ুর রাজনীতির সঙ্গে জাতপাতের বিষয়টি ভীষণভাবে জড়িত। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজেও জাতপাতের দ্বন্দ্ব বেশ প্রবল। যা প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। থালাপতি বিজয়ও বিষয়টি ভালোভাবেই জানেন। কিছুদিন আগেই এক সভায় জাতিগত জনগণনা কেন হচ্ছে না তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর নিশানা থেকে বাদ যাননি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনও। মুখ্যমন্ত্রী কেন জাতিগত জনগণনার জন্য জোরদার দাবি তুলছেন না তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।
জাতিগতভাবে তামিলনাড়ুর রাজনীতি দলিত, ভান্নিয়ার, থেভার, গাউন্ডার এবং নাদাররা নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষমতাসীন ডিএমকে-র এই সব বর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যেই ভালোরকম প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রাভিনেতা হবার কারণে থালাপতি বিজয়েরও সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই ভালোরকম প্রভাব আছে।
২০১১-র জনগণনা অনুসারে তামিলনাড়ুর মোট জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ উচ্চবর্ণ। ২০.০১ শতাংশ তফশিলি উপজাতি এবং ১.১০ শতাংশ তফশিলি জাতি। ৬৮ শতাংশ ওবিসি। ধর্মের দিক থেকে ৮৭.৫৮ শতাংশ হিন্দু, ৬ শতাংশ খ্রিস্টান, ৫.৮৬ শতাংশ মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মমতের ০.৫৬ শতাংশ।
মাদুরাইয়ের সমাবেশ থেকে অভিনয় জগত থেকে রাজনীতির জগতে পা রাখা বিজয় জানিয়েছেন, তার দলের আদর্শগত শত্রু বিজেপি এবং ক্ষমতাসীন ডিএমকে রাজনৈতিক শত্রু। টিভিকে শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক লাভের জন্য তৈরি হয়নি বলেও দাবি বিজয়ের।
নিজের দল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওইদিন বিজয় জানিয়েছেন, তাদের লক্ষ্য মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষা। রাজ্যের কৃষক, যুব, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলবে টিভিকে সরকার। বিজয় আরও জানিয়েছেন, ২০২৬-এর তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মাদুরাই পূর্ব কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং আসন্ন নির্বাচনে ডিএমকে বা অন্য কোনও দলের সঙ্গে টিভিকে-র কোনও জোট হবেনা।
থালাপতি বিজয়ের আরও দাবি, তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে ১৯৬৭ এবং ১৯৭৭-এর ব্যাপক পরিবর্তনের পর ২০২৬-এ আবার এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাক্ষী থাকবে। গত বছরের শেষে নিজের রাজনৈতিক দল তৈরি করার পর এটাই ছিল টিভিকে-র প্রথন বড়ো জনসমাবেশ। যে সমাবেশের প্রচারে বিরাট অঙ্কের টাকা যে খরচ হয়েছে তা সমাবেশ দেখলেই বোঝা যায়। অর্থাৎ থালাপতি বিজয় যে যথেষ্ট আটঘাঁট বেঁধেই রাজনীতির ময়দানে পা রেখেছেন তা স্পষ্ট।
বিজয় খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, তিনি তামিলনাড়ুতে তৃতীয় বিকল্প ফ্রন্ট তৈরি করতে চান। যেখানে ক্ষমতাসীন ডিএমকে এবং বিরোধী এআইএডিএমকে-র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চান। এর মধ্যে মিটিং থেকেই তিনি ডিএমকে-কে ‘জনবিরোধী’ বলে জানিয়ে রাজ্যের মানুষ পরিবর্তন চায় বলে দাবি করেছেন।
তবে থালাপতি বিজয়ের এই পদক্ষেপে বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে ভোট কাটাকাটি অনেকটাই হবে তাতে সংশয় নেই। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের ভোট কতটা কাটবেন প্রশ্ন তা নিয়েই। ২০২১-এর তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে ডিএমকে (১৩৩), কংগ্রেস (১৮), ভিসিকে (৪), সিপিআই (২) এবং সিপিআইএম (২)-এর সেক্যুলার প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স পেয়েছিল মোট ১৫৯ আসন। প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৫.৩৮%। অন্যদিকে এনডিএ-র মধ্যে থাকা বিজেপি (৪), এআইএডিএমকে (৬৬), পিএমকে (৫) পেয়েছিল ৭৫ আসন এবং তাদের ভোটের হার ৩৯.৭১%। তামিলনাড়ু বিধানসভায় মোট আসন ২৩৪।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনের মধ্যে একটিতেও বিরোধীরা জয়ী হয়নি। সব আসনই গেছে ক্ষমতাসীন ইন্ডিয়া মঞ্চের ঝুলিতে। তবে কোনও আসন না পেলেও ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ৭.৫৮ শতাংশ ভোট বেড়েছিল বিজেপির এবং ১.০৭ শতাংশ ভোট বেড়েছিল এআইএডিএমকে-র। ওই নির্বাচনে আলাদা আলাদা ভাবে ২৩ আসনে ও ৩৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজেপি ও এআইএডিএমকে। অন্যদিকে সেবার ৬.৫৯ শতাংশ ভোট কমেছিল ডিএমকে-র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে থালাপতি বিজয় কার ভোট কাটবেন? তাঁর দল আগামী ভোটে বিপুল জনসমর্থন পেলে কার ভোট কেটে সেই জনসমর্থন আসবে? এআইএডিএমকে-র নড়বড়ে নেতৃত্বের কারণে এই মুহূর্তে তামিলনাড়ুর বিরোধীদের জায়গায় বেশ কিছুটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাদের ভোটের কিছু অংশ থালাপতি বিজয়ের ঝুলিতে ঢুকতে পারে।
অন্যদিকে তিনি নিজেকে 'আদর্শগতভাবে বিজেপি বিরোধী' দাবি করেছেন। ফলে বিজেপির গোঁড়া সমর্থকরা আদৌ তাঁর দিকে আসবেন কিনা তা সময় বলবে। তবে তালেগোলে তিনি যদি জনপ্রিয় তারকা হবার কারণে এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণে ডিএমকে-র ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসান সেক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর ভোটের ফলাফল সম্পূর্ণ উল্টে যাবে। এক্ষেত্রে ভোট কাটাকাটিতে লাভবান হবে এআইএডিএমকে এবং বিজেপি। ক্ষতি হবে ডিএমকে-র। তাই এখন দেখার থালাপতি বিজয় কাদের ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথ মসৃণ করেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন