আবারও বামদিকে লাতিন আমেরিকা - পেড্রো কাস্তিলো হতে চলেছেন পেরুর প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি

একদা ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল পেরুর রাজনৈতিক সমীকরণে কাস্তিলো যে বৈপ্লবিক বদল আনতে পেরেছেন – তাতে সন্দেহের কোন অবকাশই আর নেই।
পেড্রো কাস্তিলো
পেড্রো কাস্তিলোগ্রাফিক্স- নিজস্ব
Published on

গত ১১ এপ্রিল পেরুতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ফলাফল অনেকের কাছেই ছিল অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত। ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি প্রতিবেশী চিলির মতোই নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। কোন কোন ভাবে, পেরুর বামপন্থী রাজনীতির পরিস্থিতি চিলির তুলনায়ও নেতিবাচক , কারণ চিলির ক্ষেত্রে পিনোশে শাসনের চূড়ান্ত অত্যাচারের মধ্যেও বামশক্তি গোপনে সংগঠিত হয়েছে এবং পিনোশের পতন পরবর্তী কালে চিলির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

উল্টোদিকে পেরুর বাম রাজনীতি ৮০-এর দশকে হঠকারী অতি-বাম সশস্ত্র আন্দোলনের পথে যায়, মূলতঃ 'শাইনিং পাথ'-এর হাত ধরে এবং রাষ্ট্রশক্তির চূড়ান্ত দমন-পীড়নে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই প্রেক্ষিত মাথায় রেখেই, এইবার পেরুর নির্বাচনে প্রতিবারের মতোই বামপন্থী শক্তিগুলিকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনি। তাই পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরে যখন দেখা গেল বিখ্যাত মার্কসবাদী চিন্তক হোসে কার্লোস মারিয়াতেগির চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত পার্টি 'পেরু লিব্রে'-এর স্বল্পপরিচিত প্রার্থী এক গ্রামের স্কুল শিক্ষক পেড্রো কাস্তিলো ১৯.১% ভোট লাভ করে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন, তখন স্বভাবতঃই তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

পেড্রো কাস্তিলো স্বল্পপরিচিত হলেও রাজনীতিতে নতুন নন। তিনি ২০১৭ সালে দেশব্যাপী সফল শিক্ষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিচিত তাঁর তেমন ছিল না। তাই বিভিন্ন মিডিয়া পোলিং-এ তাঁকে ৫-৬%-এর বেশি ভোট কেউই দেন নি। কিন্তু ফলাফলেই স্পষ্ট তাঁর অর্থনৈতিক বৈষম্য-এর বিরোধিতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে নজর দেওয়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণের বার্তা বহু মানুষের কাছে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণে বসবাসকারী আদিবাসী জনজাতির মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অতি স্বল্প সময়ে উল্কা গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। 'ধনী দেশে আর গরিব মানুষ না', তাঁর এই স্লোগান মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

দ্বিতীয় রাউন্ডে কাস্তিলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ১৩.৩% ভোট পেয়ে উঠে এসেছিলেন প্রাক্তন অতি-দক্ষিণপন্থী স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরির কন্যা কেইকো ফুজিমোরি। তাঁর নামে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ আছে এবং তাঁর বাবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসের কালো দাগও এখনও ওঠেনি। তাছাড়া পেরু দীর্ঘদিন দক্ষিণপন্থী শাসন দেখে বীতশ্রদ্ধ এবং দেশের দক্ষিণপন্থার ঝোঁক আলবার্তোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই আপাতভাবে ভাষ্যের লড়াই কাস্তিলোর জন্য অনেকটাই সহজ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

ধারণা করা হচ্ছে কাস্তিলো পেরুর সাধারণভাবে শহর কেন্দ্রিক রাজনৈতিক লড়াইকে গ্রামকেন্দ্রিক করে এবং এতদিন যে আদিবাসী সমাজের কন্ঠ চাপা ছিল, যাদের কোন প্রতিনিধি ছিল না, তাদেরকে রাজনৈতিক যুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে এসেই কিস্তিমাত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এই গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কৌশল যদি তিনি দ্বিতীয় রাউন্ডেও বজায় রাখতে পারেন - তাহলে তাঁর জয় প্রায় নিশ্চিত। প্রাথমিক ভাবে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় রাউন্ডের আগে বিভিন্ন অপিনিয়ন পোলে অনেকটাই পিছিয়ে যান কাস্তিলো।

পন্টিফিক্যাল ক্যাথোলিক ইউনিভার্সিটি অফ পেরুর অধ্যাপক ও পেরু বিশেষজ্ঞ ফারিদ কাহাতের মতে পেরুর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণপন্থী প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনই মনে প্রাণে কাস্তিলোকে মানতে পারেনি। চার্চ, সেনাবাহিনী, ব্যাবসায়ী সংস্থা – সকলেই কাস্তিলোর বিরুদ্ধে ফুজিমোরিকে সমর্থন করতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করেছিল। দেশের বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপ ‘এল কমার্সিও’ তাদের নিয়ন্ত্রিত সকল সংবাদপত্র ও সর্বাধিক প্রচারিত দুটি চ্যানেলের মাধ্যমে ফুজিমোরিকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তার স্বপক্ষে ও কাস্তিলোর বিপক্ষে খোলাখুলি প্রচার করে সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতার যে আবরণ রেখে থাকে তাও রাখেনি। ফুজিমোরি নিজে কাস্তিলোকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ‘দেশদ্রোহী’ থেকে অতি-বাম ‘শাইনিং পাথ’-এর সঙ্গে তার যোগ আছে সব রকম ব্যক্তি আক্রমণও করে গেছেন। এর ফলে ভোট যত এগিয়েছে ক্রমে তার দূরত্ব কমছে কাস্তিলোর সঙ্গে।

কাস্তিলোও বসে ছিলেন না। তিনি 'হুন্তোস পর এল পেরু' নামক অপর বামপন্থী জোট, যার প্রথম রাউন্ডে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ছিলেন ভেরোনিকা মেন্ডোজা, তাঁদের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য একদিকে যেমন নির্বাচনী বোঝাপড়া করেছেন, অন্যদিকে সামাজিক বিষয়ে, বিশেষ করে সমকামিতার মতো বিষয়ে তাঁর রক্ষণশীল অবস্থানও সংশোধন করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর স্বপক্ষে সমর্থন এসেছে প্রতিবেশী দেশ বলিভিয়ার প্রখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ও তাঁর সঙ্গে যার তুলনা করা হয় সেই ইভো মোরালেসের পক্ষ থেকে। গ্রামীণ শিক্ষক ও কৃষকদের তরফ থেকে তাঁর পক্ষে গভীর সমর্থন আগেই ছিল, কাস্তিলো দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে খনি শ্রমিকদেরও তাঁর পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। এছাড়া ‘শাইনিং পাথ’-এর কমিউনিস্টদেরও তিনি তীব্র নিন্দা করেছেন এবং দেশের প্রকৃত সমাজতন্ত্রী শক্তিগুলির এই অতি-বাম সশস্ত্র দল সমূহ যে চূড়ান্ত ক্ষতি সাধন করেছে তা স্মরণ করিয়ে দিতেও তিনি ভোলেননি।

৬-ই জুন দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের পর, ৭ই-জুন ভোট গণনা শুরু হলে প্রাথমিক ভাবে দেখা গিয়েছিল কেইকো ফুজিমোরি কাস্তিলোর থেকে কয়েক লক্ষ ভোটে এগিয়ে আছেন। কিন্তু বেলা যত বেড়েছে কাস্তিলো দূরত্ব কমিয়েছেন এবং অবশেষে কেইকো ফুজিমোরিকে অতিক্রম করে গেছেন। ৯৯% ভোট গণনার পর কাস্তিলো এখন প্রায় আশি হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন। খুব অঘটন না ঘটলে তিনিই এই নির্বাচন জিততে চলেছেন।

এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, তিনি দুইভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। একদিকে তিনিই হবেন দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি, অপরদিকে তাঁর বিজয়ে দেশের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র স্প্যানিশ শাসনের সূচনার পর প্রথমবার কঙ্কিস্তোদোরদের প্রতিষ্ঠিত লিমা থেকে পুনরায় আন্দিয়ান আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানান্তরিত হবে। একদা ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল পেরুর রাজনৈতিক সমীকরণে কাস্তিলো যে বৈপ্লবিক বদল আনতে পেরেছেন – তাতে সন্দেহের কোন অবকাশই আর নেই।

SUPPORT PEOPLE'S REPORTER

ভারতের প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুখী সাংবাদিকতা — যা আপনার সামনে সঠিক খবর পরিবেশন করে। পিপলস রিপোর্টার তার প্রতিবেদক, কলাম লেখক এবং সম্পাদকদের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আপনাদের মতো পাঠকদের সহায়তা। আপনি ভারতে থাকুন বা দেশের বাইরে — নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে একটি পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in