মধ্যপ্রদেশের নিমুচ জেলার মনসা তহসিলের অধীন একট আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম, ঢাকাদখেদির ১৩৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত একটি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল একমাত্র আশার আলো। যে স্কুলে ৬৩ জন ছাত্রী এবং ৭৩ জন ছাত্র। মহামারী চলাকালীন এই ১৩৬ জন ছাত্র-ছাত্রীর কাছে শিক্ষার কোনওরকম ব্যবস্থা ছিলো না। লকডাউনের সময় যখন স্কুলগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অনলাইন ক্লাসগুলি নতুন আদর্শ হয়ে ওঠে সেইসময় এই ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
৭৮৪ জনসংখ্যার এই গ্রামে ১৬০টি পরিবারের বাস। এই গ্রামের নিকটবর্তী শহর এবং তহসিল সদর দপ্তর মনসা ৪২ কিমি দূরে। একটি পাকা রাস্তা কানজরদা গ্রাম হয়ে মনসা থেকে ঢাকাদখেদিকে সংযুক্ত করেছে। এখানে, কৃষিই প্রধান জীবিকা এবং স্থানীয়দের অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক যারা দৈনিক সামান্য ১৫০ টাকার মজুরিতে বেঁচে থাকে।
এই অঞ্চলে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও, আদিবাসী কল্যাণ দপ্তর দ্বারা পরিচালিত একটি ছাত্র হোস্টেল আশেপাশের গ্রামের ২৬ জন শিশুর শিক্ষায় সহায়তা করে।
ঢাকাদখেদির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রহ্লাদ সোলাঙ্কি জানিয়েছেন, "যদিও বাবা-মায়েরা তাদের ছোট বাচ্চাদের হোস্টেলে ভর্তি করানো নিয়ে শঙ্কিত, তবুও তাঁরা আশা করেন এর ফলে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে ভালো হবে।"
শিক্ষার অকার্যকর মডেল
মধ্যপ্রদেশ সরকার আদিবাসী শিশুদের ডিজিটাল বিভাজন দূর করার জন্য তিনটি শিক্ষা মডেল নিয়ে এসেছিল — DigiLEP, দূরদর্শন এবং মহল্লা ক্লাস। যদিও ঢাকাদখেদির জন্য এগুলোর কোনোটিই বিশেষভাবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে 'লার্নিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম' হিসাবে DigiLEP চালু করেছিলেন। যার লক্ষ্য ছিল রাজ্যে অনলাইন শিক্ষার প্রচার করা। তিনি জানিয়েছিলেন, এই অ্যাপ্লিকেশনটি হবে এক ধরনের প্ল্যাটফর্ম, যা ক্লাস ১ থেকে ৮ পর্যন্ত শিক্ষক এবং ছাত্রদের ক্লাস্টারকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে সংযুক্ত করবে। যার মাধ্যমে তাদের পাঠ্যপুস্তক-ভিত্তিক ভিডিওগুলি দেওয়া হবে।
চৌহান জানিয়েছিলেন, "ডিজিএলইপি – আপ কী স্টাডিজ, আপকে ঘর এই উদ্দেশ্যে তৈরি একটি অ্যাপ।" যদিও এই অ্যাপ ধাকাদখেদির উপজাতি ছাত্রদের কাছে পৌঁছায়নি। যার বড়ো কারণ, স্থানীয়দের অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থা। যা এই অনলাইন শিক্ষা মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ঢাকাদখেদির সরকারি স্কুলে অধ্যয়নরত ৬৩ জন ছাত্রীর মধ্যে মাত্র পাঁচজনের বাড়িতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে, যা ডিজিএলইপি অ্যাপ অ্যাক্সেস করার জন্য সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয়তা। অতি অল্প সংখ্যক যাদের কাছে স্মার্টফোন আছে তাঁদের অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য নিয়মিত রিচার্জের খরচ বহন করতে পারে না।
কানজর্দায় নিকটতম বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন, বা সেল টাওয়ার সহ, ঢাকাদখেদি এবং আশেপাশের প্রায় ছ’টি গ্রামে উপযুক্ত মোবাইল সংযোগের অভাব আছে। যা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। নেটওয়ার্ক পাবার আশায় একেক জনকে গ্রামের উপরের দিকে যেতে হয়। যদিও তারপরেও, খুব কম ক্ষেত্রেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
সোলাঙ্কি ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন: "ডিজিএলইপি এখানে কার্যকর হতে পারেনি কারণ মানুষের কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না, এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কগুলিও বিচ্ছিন্ন ছিল। আমরা ছাত্রদের, বিশেষ করে মেয়েদের উন্নত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং এই স্থানীয় সমস্যাগুলো জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেছি। "
দ্বিতীয় শিক্ষার মডেল হিসাবে, রাজ্যের স্কুল শিক্ষা বিভাগ ঘোষণা করেছিল যে দূরদর্শন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে শ্রেণিভিত্তিক পাঠ সম্প্রচার করবে। যদিও এখানকার বেশির ভাগ বাড়িতে টেলিভিশন সেট এবং রেডিও না থাকার কারণে এই মাধ্যমটি ঢাকাদখেদিতেও ব্যর্থ হয়েছে।
সমতাপূর্ণ শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি সরকারি উদ্যোগ, সমগ্র শিক্ষা অভিযানের ডিস্ট্রিক্ট প্রোজেক্ট কোঅরডিনেটর পি এস গোয়াল বলেন, এই গ্রাম সম্পর্কে শিক্ষকরা যে সমস্ত সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন তা ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, "অন্তর্বর্তী সময়ে, এই শূন্যতা পূরণের জন্য মহল্লা ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলো জেলা শিক্ষা কেন্দ্র।" "শিক্ষকরা এই কঠিন পরিস্থিতিতেও শিশুদের শেখানোর জন্য এবং শিশুরা যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য।"
এই মহল্লা ক্লাসগুলি ছিল তৃতীয় মডেল, যা রাজ্য সরকার নিয়ে এসেছিল। এই পদ্ধতিকে গ্রামীণ মধ্যপ্রদেশের জন্য সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল বলে মনে হয়েছিল। এই পদ্ধতির অধীনে, শিক্ষকদের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুটি ভিন্ন চৌপালে বা গ্রামের জমায়েত স্থানে স্কুলের বাচ্চাদের 'ক্লাস নিতে' হতো। যদিও বাস্তবে প্রত্যন্ত এই গ্রামের মহল্লা ক্লাসে গড়ে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
যার বড়ো কারণ, মহল্লা ক্লাসে সমস্ত শিশু, তারা যে ক্লাসেই পড়ুক না কেন, একসাথে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর তাদের পড়ার সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হত। কারণ নিয়োগকৃত শিক্ষক প্রতিটি ছাত্রের সাথে আলাদাভাবে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। অনিয়মিত সময়সূচী এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন ভাবে পাঠদানের এই প্রক্রিয়ায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন না। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও শেখার এই পদ্ধতিতে উৎসাহী হয়নি।
মিড-ডে মিল না থাকা, খেলাধুলা এবং অন্যান্য নিয়মিত স্কুল কার্যক্রমের অভাব অভিভাবকদের এবং তাদের শিশুদের এই সরকারী উদ্যোগের উপর নির্ভর করতে আরও নিরুৎসাহিত করেছে।
এই ধরণের পরিস্থিতিতে পিতামাতা এবং শিশুদের মধ্যে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। নন্দলাল তাওয়াদ, ঢাকাদখেদির এমনই এক অভিভাবক জানিয়েছেন, আয় কম হওয়ায় তাঁর সন্তানদের জন্য তাঁর একটি স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। ফলস্বরূপ, মহামারী চলাকালীন তাঁর সন্তানরা ক্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মোবাইল সংযোগের অভাব তাঁর সন্তানদের মানসম্পন্ন শিক্ষার স্বপ্ন দেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লিঙ্গ বৈষম্য
সোলাঙ্কি জানিয়েছেন, ঢাকাদখেদিতে "মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থী মহল্লার ক্লাস থেকে উপকৃত হয়েছিল, তাও বেশিরভাগই ছেলেরা এবং মেয়েদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল"।
রাইট টু এডুকেশন ফোরামের এক সমীক্ষা অনুসারে, পারিবারিক আয়ের নিম্নগামীতা এবং ডিজিটাল অ্যাক্সেস না থাকার মত মহামারীজনিত কারণে প্রায় ১০ মিলিয়ন ছাত্রীর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও, অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট (ASER) ২০১৬ অনুসারে, প্রাক-মহামারীর সময়েও মধ্যপ্রদেশ শীর্ষ তিনটি রাজ্যের মধ্যে ড্রপআউটে স্থান পেয়েছে। যেখানে ৮ শতাংশেরও বেশি ছাত্রী 'স্কুলের বাইরে' (ড্রপআউট এবং সেইসাথে যারা কখনও স্কুলে যায়নি)।
স্মার্ট ডিভাইসের প্রয়োজন এবং সঠিক নেটওয়ার্ক-এর অভাব ঢাকাদখেদিতে শিক্ষার বাধাকে বহুগুণে যুক্ত করেছে। আশেপাশের দানথালাই, খেদাবরাজি, কুন্ডালিয়া খুর্দ, কুন্ডলিয়া বুজুর্গ, মাকোদি মোদি, গোথরা এবং নয়াগাঁও গ্রামগুলিও ভাল ছিল না।
প্রথাগত লিঙ্গ বৈষম্য স্কুল ড্রপআউটদের গৃহস্থালির কাজে এবং অবশেষে বিবাহের দিকে ঠেলে দেয়। ASER পরামর্শ অনুসারে, ছাত্রীদের স্কুল থেকে ড্রপআউটের প্রধান কারণ পারিবারিক সীমাবদ্ধতা এবং এই ছাত্রীদের আবার স্কুলে ভর্তি করা একটি বড়ো সমস্যা।
মনসার এক সমাজকর্মী দীনেশ পদয়পতি জানিয়েছেন: "আমরা চেয়েছিলাম এই মেয়েরা পড়াশোনা করুক। এঁদের জন্য সঠিক মোবাইল নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করার পাশাপাশি, সরকারের উচিত ছিল এই এলাকার মেয়েদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন দেওয়া, যাতে তারা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "বাল্যবিবাহের বিপদ সম্পর্কে গ্রামীণ জনগণকে শিক্ষিত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টাও চালানো হচ্ছে। যা প্রাথমিকভাবে শিক্ষার অভাবের কারণেও ঘটে।" "আমাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বাল্যবিবাহ চলতেই থাকে এবং যার ফলে একটি মেয়ের পড়াশোনা করার সুযোগ আরও নষ্ট হয়ে যায়।
(লেখক বিজিত রাও মহাদিক নিমুচ-ভিত্তিক এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং ১০১ রিপোর্টার্সের সদস্য, যা তৃণমূল স্তরের রিপোর্টারদের একটি প্যান-ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক।)
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।