
সোমবার আচমকাই স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন জগদীপ ধনখড়। যদিও সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর দিন তিনি ৬২ মিনিট ধরে রাজ্যসভার কাজ পরিচালনা করেছেন। তখনও একবারের জন্যও তাঁর ইস্তফার বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু এরপরেই রাতের দিকে তিনি হঠাৎ করেই ইস্তফা ঘোষণা করেন। মাননীয় উপরাষ্ট্রপতির এক্স হ্যান্ডেল অনুসারে তিনি রাত ৯টা ২৫ মিনিটে তাঁর ইস্তফাপত্র প্রকাশ করেছেন সমাজমাধ্যমে।
যদিও সোমবার বিকাল ৩:৫৩ মিনিটে, প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (PIB) জানিয়েছিল, উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় ২৩শে জুলাই একদিনের জয়পুর সফরে যাবেন এবং যেখানে তিনি রামবাগ প্যালেসে কনফেডারেশন অফ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (CREDAI) এর নবনির্বাচিত কমিটির সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করবেন।
স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে ইস্তফা দিলেও তাঁর পদত্যাগের পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। একাধিক বিরোধী দলনেতা সরাসরিই জানিয়েছেন, জগদীপ ধনখড়ের ইস্তফা শুধুমাত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে নয়। বরং অন্য কোনও গূঢ় কারণ এর পেছনে অবশ্যই আছে।
মঙ্গলবার ২২ জুলাই দুপুর ১টায় তাঁর নির্ধারিত কর্মসূচী ছিল। এদিন রাজ্যসভার বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটির সঙ্গে তাঁর বৈঠক পূর্বনির্ধারিত ছিল। ছিল আরও একাধিক কর্মসূচি। সোমবারও তিনি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে একাধিক বৈঠক করেছেন, অধিবেশন পরিচালনা করেছেন। তারপর বিকেল পাঁচটার পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে ইস্তফাপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু কেন সংসদের বাদল অধিবেশনের শুরুর দিনটিকেই তিনি ইস্তফার জন্য বেছে নিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।
গতকাল জগদীপ ধনখড়ের ইস্তফার পর কংগ্রেস সাংসদ ও রাজ্যসভায় কংগ্রেসের মুখ্য সচেতক জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত। যদিও তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়টিই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু স্বাস্থ্য ছাড়াও তাঁর আকস্মিক ইস্তফার পেছনে অবশ্যই অন্য কোনও কারণ আছে বলেই মনে হয়। এ নিয়ে কোনও অনুমান করা যদিও ঠিক নয়।
জয়রাম রমেশ ছাড়াও অন্যান্য বিরোধী নেতৃত্বও জগদীপ ধনখড়ের নাটকীয় ইস্তফায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের একাংশের মতে, সোমবার তাঁকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের কারণে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শেখর যাদবের ইম্পিচমেন্ট নোটিশ দেয় বিরোধীরা। এর আগে এলাহাবাদ হাইকোর্টের অন্য বিচারপতি যশবন্ত ভার্মার বিরুদ্ধেও ইমপিচমেন্ট নোটিশ দেয় বিরোধীরা। এই দুই ইম্পিচমেন্ট নোটিশের প্রভাব সরকারের ওপর পড়তে পারে বলেই তিনি তড়িঘড়ি ইস্তফা দিয়েছেন।
জগদীপ ধনখড়ের ইস্তফা নিয়ে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ যা বলেছেন তাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। রমেশের জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজনেস অ্যাডভাইসারি কমিটি (BAC) জগদীপ ধনখড়ের সভাপতিত্বে বৈঠক করেন। কমিটি মন্ত্রী জে পি নাড্ডা এবং কিরেন রিজিজুর জন্য অপেক্ষা করলেও, তাঁরা উপস্থিত হননি। ধনখড়কেও তাঁদের অনুপস্থিতির বিষয়ে জানানো হয়নি। এই অপ্রত্যাশিত অনুপস্থিতির কারণে তিনি মঙ্গলবার দুপুর ১টায় পরবর্তী বিএসি বৈঠকের সময়সূচী পুনর্নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে জয়রাম রমেশের দাবি, দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪:৩০টার মধ্যে এমন কিছু গুরুতর ঘটেছে যা জে পি নাড্ডা এবং কিরেন রিজিজুর ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতির কারণ। তিনি আরও জানিয়েছেন, জগদীপ ধনখড়ের পদত্যাগ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং অবশ্যই এর সম্ভাব্য কোনও প্রভাব রয়েছে।
সোমবার নিজের এক্স হ্যান্ডেলে রমেশ আরও জানিয়েছেন, "উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আকস্মিক পদত্যাগ যতটা মর্মান্তিক, ততটাই ব্যাখ্যাতীত। আজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমি আরও কয়েকজন সাংসদের সাথে তার সাথে ছিলাম এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতেও তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি।”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সাংসদ পি সন্তোষ কুমার জগদীপ ধনখড়ের ইস্তফা প্রসঙ্গে বলেন, এই ঘটনাটি বেশ অপ্রত্যাশিত এবং “এর প্রকৃত কারণ কী তা আমরা জানি না।” তিনি আরও বলেন, "আমি মনে করি না যে ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর ইস্তফা গ্রহণ করবেন। কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ইস্তফা হয়তো তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। হয়তো কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শিবসেনা (ইউবিটি) নেতা আনন্দ দুবে তাঁর ইস্তফা প্রসঙ্গে বলেন, "স্বাস্থ্যগত কারণে উপরাষ্ট্রপতির পদত্যাগের খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা আন্তরিকভাবে তার সুস্থতা প্রার্থনা করি। তবে, বর্ষাকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনে আকস্মিকভাবে তাঁর ইস্তফা অবশ্যই প্রশ্ন তোলে। তিনি আরও বলেন, “এই সরকারে কী চলছে? এই সিদ্ধান্ত যথাযথ পরামর্শ বা আলোচনা ছাড়াই নেওয়া হয়েছে। যদি স্বাস্থ্যের বিষয়টি উদ্বেগের একমাত্র বিষয় হত, সেক্ষেত্রে অধিবেশনের কয়েক দিন আগে বা তার পরেও পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া যেত।”
একনজরে জগদীপ ধনখড়
২০২২ সালের আগস্ট মাসে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জগদীপ ধনখড়। ২০২৭ সাল পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ ছিল। নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস সহ সম্মিলিত বিরোধীদের প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে পরাজিত করেন। নির্বাচনে এনডিএ শিবিরের প্রার্থী জগদীপ ধনখড় পান ৫২৮ (৭৪.৩৭%) ভোট এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মার্গারেট আলভা পান ১৮২ (২৫.৬৩%) ভোট। অতি সম্প্রতি দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সস-এ তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়।
২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর ইন্ডিয়া মঞ্চের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন (No Confidence Motion) করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ এবং সরকার পক্ষের তথা বিজেপির হয়ে সভা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও এই অনাস্থা শেষ পর্যন্ত আনা যায়নি।
১৯৭৯ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিল অফ রাজস্থানে নাম নথিভুক্ত করেন। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। দেশের নবম লোকসভা নির্বাচনে তিনি জনতা দলের প্রার্থী হিসেবে রাজস্থানের ঝুনুঝুনু লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৯১-এর লোকসভা নির্বাচনে আজমীড় কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও তিনি পরাজিত হন। এরপর ১৯৯৩ সালে রাজস্থান বিধানসভায় কিষাণগড় কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে আবারও ঝুনুঝুনু লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি তৃতীয় স্থান পান।
২০০৩ সালে বিজেপিতে যোগদান করেন জগদীপ ধনখড়। ২০১৬ সালে তিনি বিজেপি আইন সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান হন। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন ধনখড়। শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সংঘাত বাধে। উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর নাম মনোনীত হবার পর ১৭ জুলাই ২০২২ সালে তিনি রাজ্যপাল পদ থেকে ইস্তফা দেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন