CPIM: পঞ্চায়েত ভোটকে লক্ষ্য রেখেই বিজেপি তৃণমূলের বাইনারি উস্কে দেওয়া হচ্ছে - মহম্মদ সেলিম

মহম্মদ সেলিম বলেন, আজকে মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন যারা আরএসএসে আছেন তাদের তৃণমূলে ঢোকাবেন। যারা বিজেপির এমপি এমএলএ আছেন তাঁদের তৃণমূলের এমপি এমএলএ করবেন। মানুষের ভরসা উঠে যাচ্ছে।
শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম
শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম নিজস্ব চিত্র

প্রথম থেকে সিপিআইএম বলেছে, সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক বলেছেন যে, যারা এই উস্কানি দিল, যেখান থেকে সূত্রপাত, তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস করে গ্রেপ্তার করার কথা। কেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি? শনিবার আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে দলের রাজ্য সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা জানান সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।

এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে সেলিম বলেন, কিছু লোকজন বলেছিল মমতা ব্যানার্জি বিজেপিকে আটকাবে, আরএসএসকে আটকাবে। গত পরশুদিন দেখলাম, সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্লজ্জের মতো বলছেন নবান্ন থেকে। উনি নাকি গোটা রাজ্য দেখেন। দূরবীন দিয়ে সিপিআইএমকে খোঁজেন! এখানে একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলে রাস্তায় নামলে পুলিশ ধরে নিয়ে চলে যাবে। যা উত্তরপ্রদেশে হয়েছে। ঘর ভেঙে দেবে। বুলডোজার চালিয়ে দেবে। আর এখন মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন যারা আরএসএসে আছেন তাদের তৃণমূলে ঢোকাবেন। যারা বিজেপির এমপি এমএলএ আছেন তাঁদের তৃণমূলের এমপি এমএলএ করবেন। মানুষের ভরসা উঠে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করে এদিন সেলিম বলেন, নরেন্দ্র মোদী যেদিন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেদিন পুনেতে মব লিঞ্চিং হয় মহসিন সিদ্দিকির। প্রধানমন্ত্রী চুপ ছিলেন। আমাদের রাজ্যে হাতে গোণা মানুষ ছাড়া কেউ কিন্তু প্রতিবাদ করেননি। কারণ এখানে মমতা ব্যানার্জী ট্যুইট করলে তবেই প্রতিবাদ হয়। তাঁর ইশারায় প্রতিবাদ হয়। যারা মাঝে মধ্যে কিছু হলে রাস্তায় নেমে পড়ে ক্যা ক্যা ছিছি করেন। আজকে যারা দোষ দিচ্ছে কেন প্রতিবাদ করছে মিছিল কেন করছে, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, ১৫ দিন ধরে সিভিল সোসাইটি কী করল? এ যা হচ্ছে তা দেশের মুখ পুড়ছে। পিনারাই বিজয়ন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রতিবাদ করতে পারেন। তাহলে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন করতে পারেন না। আর নির্লজ্জের মতো বলছেন আমি ইমাম ভাতা দি। তাহলে এইসব করার জন্যই ভাতা দেন, যাতে তাঁরা মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে থাকবে? এটাতো আমাদের রাজ্যে যারা ইমাম আছেন, ধর্মগুরু আছেন, তাঁদের অসম্মান। পার্ক সার্কাস থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যে যা হচ্ছে তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য পোস্টার দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের মন্ত্রী সাংসদ বিধায়কদের। তাহলে তারা মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনছেন না। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তাকে লক্ষ্য রেখে বিজেপি আর তৃণমূলের বাইনারি উস্কে দেওয়া হচ্ছে।

সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক এদিন বলেন, আমরা কেউ হিংসাকে সমর্থন করিনা। কিন্তু মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। অন্যায় হলে মানুষ প্রতিবাদ করবেই। আমরা বামপন্থীরা বলি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, না শুধুমাত্র আমি নামব। আর কেউ নামবে না। তাহলে উনি নায়ক নায়িকা গায়ক গায়িকা সেলেবদের নিয়ে কেন নামলেন না। ভোট নেই বলে। তাহলে একটা প্রতিবাদ হত। সেখানে তিনি আরও উস্কানিমূলক কথা বলে বলছেন দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদ কর। এখানে হিন্দি উর্দুভাষীরা কিছু করলে বলেন বহিরাগত। আর দিল্লিতে বাঙালীরা প্রতিবাদ করলে বলে বাংলাদেশী রোহিঙ্গা। তাহলে উনি কি বিজেপি আর তৃণমূলের কেস সাজাচ্ছেন নাকি। মানুষের প্রতিবাদ করার সংবিধানগত অধিকার আছে। যে যেখানে থাকে, সে সেখানে প্রতিবাদ করে। আমাদের দেশে কিছু অন্যায় হলে লন্ডনে ইউকে-তে প্রতিবাদ হয়। যারা ভারতবাসীরা আছে তারা প্রতিবাদ করে। আর যিনি বলছেন দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদ কর তাহলে তিনি করলেন না কেন? যখন এফডিআই, আন্না হাজারের অ্যান্টিকোরাপশন চলছিল, যখন নোটবন্দী হল তখন তিনি দিল্লিতে গিয়ে নাটক করেছিলেন। তাহলে এখন প্রতিবাদ করলেন না কেন? আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কেন দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদ করবে? ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যদি বলতে হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে থেকে বলতে পারব না আমরা? কিছুদিন আগে যখন স্ট্রাইক হয়েছে তিনি তখন আপত্তি করেছেন। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে স্ট্রাইক করা যাবে না?

তৃণমূল ও বিজেপির সেটিং-এর অভিযোগ করে সেলিম বলেন, গত ৭ বছরে বিজেপি আরএসএস এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে যত ঘৃণা ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে তার বিরুদ্ধে একটাও ব্যবস্থা নেয়নি মমতা ব্যানার্জী। এই জন্যই আমরা বলি বিজেপি তৃণমূলের সেটিং আছে। ভাইপোকে পিসিকে গাল দিলে রোদ্দুর রায়কে গোয়া থেকে গ্রেপ্তার করা যায়, কিন্তু বসিরহাটে, আসানসোলে, ধূলাগড়ে দাঙ্গা করলে পুরষ্কার দেওয়া হয়। যে কটা দাঙ্গা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে একটার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যারা মাদ্রাসার টিচারকে মেরেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তখন মানুষ বাধ্য হয় রাস্তায় নামতে।

এদিন সেলিম বলেন, সিএএ এনআরসির সময় মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। উনি ভেস্তে দিয়েছিলেন মোদীকে স্বাগত জানিয়ে আর ধর্ণার নামে নাটক করে, আর যারা গ্রামে প্রতিবাদ করেছে তাদেরকে জেলে পুরে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে। এখন যারা গ্রাম বাংলায় প্রতিবাদ করছে তাদের প্রতিবাদের অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। আবার যারা প্রতিবাদ করছেন যাতে মানুষের সম্প্রীতি হিংসার বলি না হয় সেটাও তাদেরকে দেখতে হবে। আর সেই দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি তৃণমূলের। কারণ মমতা ব্যানার্জী বলছেন উনি ইমাম ভাতা দেন। তাহলে নিজের দলের লোকজনকে আগে নিয়ন্ত্রণ করুন। যাতে ধর্মের নামে বিজেপি যে ফসল চাষ করতে চাইছে যাতে মমতা ব্যানার্জী প্রতিদিন সার দিচ্ছেন জল দিচ্ছেন সেটা দেওয়া বন্ধ করুন। দিল্লি পুলিশ নূপুর শর্মা ও অন্যের নামে চালাকি করে এফআইআর করেছে। ৩০ জনের নামে এফআইআর করেছে। তার সাথে এক সাংবাদিকের নামও যুক্ত আছে যার সাথে ঘটনার কোনো যোগাযোগ নেই। আমাদের দাবি অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করতে হবে। এই যে বড় সংবাদ গোষ্ঠীর মালিক তাদেরও একটা কর্তব্য আছে। তারা নিজেদের চ্যানেলে এটি (নূপুর শর্মার বক্তব্য) ব্যবহার করতে দিয়েছে কেন? এডিটোরিয়াল লিখেও তারা আপত্তি জানাতে পারে।

এদিন মহম্মদ সেলিম খুব স্পষ্টভাবে জানান, পরিষ্কার কথা হচ্ছে মানুষের অধিকার আছে প্রতিবাদ করার। কিন্তু সেখানে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হোক, হিংসার পরিবেশ তৈরি হোক, বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক সেটা কাম্য নয়। যে সংগঠন প্রতিবাদ করে এটা তাদের দায় এবং দায়িত্ব। সরকারেরও দায়িত্ব। শাসক দলেরও দায়িত্ব। হাওড়ায় কেন হল? অন্য জায়গায় কেন হল না এমন ঘটনা? হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ আনিস খানকে খুন করার পরে তার পোলিশিং-এর মরাল অথরিটি নষ্ট হয়েছে। পুলিশ খুন করেছে প্রতিবাদী যুবককে। আর মুখ্যমন্ত্রী সেই পুলিশকে আশকারা দিয়েছেন। সিট গঠনের নাম করে বাঁচিয়েছেন। কোর্টে গিয়ে কেস লড়ছেন টাকা খরচা করে যাতে সত্য না বেরোয়। সেই পুলিশকে দিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা রাখতে পারবেন? আর যখন নবান্নের দিকে মিছিল চলে এসেছে, অবরোধের লাইন চলে এসেছে তখন তার টনক নড়েছে। এই তিনি রাজ্যের খবর রাখেন।

রাজ্যের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি টেনে এনে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, আমরা দেখলাম প্রথমে উত্তরপ্রদেশে স্বাভাবিকভাবে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের নামে কেউ যদি ঘৃণা উদ্বেগ প্রকাশ করে তখন রাস্তায় নেমে মানুষ প্রতিবাদ করলে ধরপাকড় করল। আজও তা অব্যাহত। আমরা সেদিনও প্রতিবাদ করেছি উত্তরপ্রদেশের কানপুরে। গতকাল রাতে এলাহাবাদে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে গেল। রাত ১২ টার সময় পরিবারের মহিলা সদস্য বৌ ও মেয়েকে নিয়ে গেল। ভোররাতে পুলিশ এসে ঘর খালি করে বাকি তিন মেয়েকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। না কোনো ওয়ারেন্ট, না কোনো অভিযোগ। সুপ্রিম কোর্টের কোনো নির্দেশ আছে? পুলিশের কতগুলো নিজস্ব প্রোটোকল আছে। কয়েকদিন আগে আমরা বুলডোজার দেখেছি। তার আগে দেখেছি ধর্মীয় গুরুর নাম করে আরএসএসের লোকজন গণহত্যার আহ্বান জানাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক, দিল্লিতে আছে ব্যাঙ্গালোরে আছে, তাদের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ধৈর্যের একটা সীমা আছে মানুষের। সরকারকে মানুষ নির্বাচিত করে। কারণ সরকার মানুষের নিরাপত্তা দেবে, শান্তি দেবে। এখন সরকারে থেকে সরকারি দল মানুষের মধ্যে হিংসা ঘৃণা ছড়াচ্ছে।

এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, স্বাধীনতার জন্য জয় গান গেয়েছেন এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী পন্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিলের আজ ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যে লড়াই হয়েছিল। আশফাকুল্লা, রামপ্রসাদ বিসমিল, ঠাকুর রসুল সিং, রাজেন লাহিড়ি - আলাদা ধর্ম, আলাদা ভাষা, আলাদা জনগোষ্ঠী-জাতির মানুষ কিন্তু একসাথে লড়াই করেছিলেন। আর আজকে আমরা কী দেখছি? স্বাধীনতার যখন ৭৫ বছর। গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ঐতিহ্য তাকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। ইতিহাসকে মুছে ফেলা হচ্ছে। বিকৃত করা হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে জাতির নামে ভাষার নামে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্ত। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি দ্বিতীয় দফায় যখন সরকারে এল তারপর থেকে আরও হইচই করে হিংসার রাজনীতিকে প্রতিদিন একটা বড় অংশের প্রচার মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিষ ঢালা হচ্ছে। বিজেপি মুখপাত্র যেভাবে হিংসা ছড়ানোর জন্য একটা প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যমে বসে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন যাতে আরও বেশি ঘৃণার চাষ হয়। তারপরে গত একপক্ষকাল প্রতিদিন দেশি বিদেশি মৌলবাদী ঘৃণার রাজনীতি করে, দাঙ্গা লাগাতে পারে সেইসব প্রতিনিধিদের নিয়ে আগুনে হাওয়া দেওয়ার জন্য জাতীয় টেলিভিশনগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী চুপ, মুখ্যমন্ত্রী চুপ।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in