
বিশ্বের উচ্চতম বেস ক্যাম্প এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (Everest Base Camp)। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৩৬৪ মিটার বা ১৭,৫৯৮ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সেখানে সাইকেল নিয়ে পৌঁছে গেলেন বাংলার এক যুবক। দিঘা থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প - ১,৩৪৬ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে অতিক্রম করলেন মাত্র ২৯ দিনে। রেকর্ড তৈরি করলেন ওই যুবক।
পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বাসিন্দা জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস। বয়স মাত্র ২৯ বছর। উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় থাকেন। ছোটো থেকেই পাহাড় খুব ভালোবাসতেন জ্যোতিষ্ক। তাই সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তেন অ্যাডভেঞ্চারে। আর সেই নেশাকেই পেশা করেন তিনি।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি দিঘা থেকে সাইকেল চেপে বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন জ্যোতিষ্ক। কলকাতা, মালদা, শিলিগুড়ি, নেপাল হয়ে পৌঁছে যান এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। কখনও সাইকেল চেপে আবার কখনও সাইকেল কাঁধে নিয়ে হেঁটে। মোট ১,৩৪৬ কিলোমিটারযাত্রা করেছেন। ১০ মার্চ নিজের গন্তব্যে পৌঁছান তিনি। মাত্র ২৯ দিনেই যাত্রা শেষ করে রেকর্ড গড়েছেন জ্যোতিষ্ক।
তবে এই যাত্রা জ্যোতিষ্ককে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ছ'বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সাইকেল নিয়ে পর্বতারোহণ করছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, "আমি এমন কিছু করতে চেয়েছিলাম যা আগে কোনও ভারতীয় করেননি। পাশাপাশি আমি নতুন প্রজন্মকে দেখাতে চেয়েছিলাম, সারাদিন অযথা ফোন না ঘেঁটে জীবনে অনেক কিছু করার আছে"।
এর জন্য তিনি কীভাবে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন, সেটাও জানান। জ্যোতিষ্কর মতে, এর জন্য মানসিক স্বচ্ছতা, ধৈর্য এবং স্থিতিস্থাপকতাও প্রয়োজন। ঘন্টার পর ঘন্টা সাইকেল চালানোর ছন্দ এক ধরণের গতিশীল ধ্যানের অনুভূতি প্রদান করে। সেই সময় চিন্তাভাবনা ধীর হয়ে যায়। এর জন্য মানসিক স্থিতিস্থাপকতা, ফিটনেস খুব প্রয়োজন।
জ্যোতিষ্ক জানান, নদিয়া তাঁর জন্মস্থান হলেও অরুণাচল প্রদেশ এবং উত্তরবঙ্গের মাথাভাঙ্গায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। পরে পড়াশোনার জন্য কলকাতা চলে আসেন। জ্যোতিষ্ক বলেন, “কলকাতায় আসার পর থেকেই মিস করতাম পাহাড়কে"। তবে কেবল পাহাড় নয়, জ্যোতিষ্কের প্রেম নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস। এর মধ্যে আছে ট্রেল রানিং, সাইকেলিং, ম্যারাথন, মাউন্টেনিয়ারিং।
তবে যাত্রাপথ ছিল বড়ই দুর্গম। জ্যোতিষ্ক জানান, কলকাতায় তখন শীতের স্থায়িত্ব কমে এলেও, উত্তরে ঠান্ডার দাপট বজায় ছিল। হিমবাহের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। কখনও চালিয়ে, কখনও ঠেলে, কখনও কাঁধে করে সাইকেল নিয়ে যেতে হয়েছিল। এভারেস্ট বেস্ট ক্যাম্প এলাকায় দিনের বেলা তাপমাত্রা থাকত মাইনাস ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তিনি জানান, যাত্রা পথেই পড়ে গোরখশেপ। লোবুচে থেকে গোরখশেপ হয়ে যেতে হয় এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। সেই গোরখশেপ এলাকায় রাতের তাপমাত্রা নেমে যেত প্রায় মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তার সঙ্গে রয়েছে সূর্যের ইউভি রশ্মির দাপট। যার কারণে ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
জ্যোতিষ্ক জানান, "ভারত-নেপাল সীমান্তের পরে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। নেপালের রাস্তাগুলি কিছু জায়গায় রুক্ষ এবং এমন কিছু জায়গা ছিল যেখানে কাঁধে করে সাইকেল নিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চতর উচ্চতার কাছাকাছি, যেখানে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, মনে হবে নিজের শরীরের বিরুদ্ধে লড়াই করছি"।
তাঁর মতে, "কোনও ব্যাকআপ গাড়ি নেই, আপনার সরঞ্জাম ঠিক করার জন্য কেউ নেই, চিকিৎসা সহায়তার জন্য দ্রুত অ্যাক্সেস নেই। আপনাকে নিজেই রান্না করতে হবে, সাইকেল ঠিক করতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। এই ধরণের আত্মনির্ভরতা আপনাকে এমন জিনিস শেখায় যা আপনি বইয়ে শেখেন না"।
এত কিছুর পরেও জ্যোতিষ্ক নিজের মনোবল হারাননি। তিনি বলেন, "আমি জলবায়ু সম্পর্কে, পাহাড়ের স্কুল সম্পর্কে, এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে এবং আমরা কীভাবে তাদের সংগ্রামকে উপেক্ষা করি সে সম্পর্কে কথা বলতে চেয়েছিলাম"।
মঞ্জোর কাছে সুরকে একটি ছোট স্কুলে যাত্রাবিরতির সময়, জ্যোতিষ্ক শিক্ষার্থীদের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন এবং যতটা সম্ভব তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি বই এবং দরকারি কিছু সামগ্রিও দিয়েছিলেন তিনি। জ্যোতিষ্ক জানিয়েছে, “একটা ছেলে আমাকে বলেছিল যে তার প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান, কিন্তু তাদের পাঠ্যপুস্তকগুলি পুরানো ছিল এবং তাদের ল্যাবে একটি ভাঙা মাইক্রোস্কোপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমার মনে পড়ে গেল — আমরা উন্নয়নের কথা বলি, কিন্তু যারা গল্প থেকে বাদ পড়ে তাদের ভুলে যাই"।
এই দুর্গম পথ অতিক্রম করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি জানান, "আসল চ্যালেঞ্জ হল আপনার মন। তাপ, ঠান্ডা, ক্লান্তি - সহ্য করা যেতে পারে। কিন্তু মন যদি হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে শরীর আর চাইবে না কাজ সম্পূর্ণ করতে"।
পরবর্তীতে কী করতে চায় জ্যোতিষ্ক? উত্তরে তিনি জানান, "এটা সবে শুরু। আমি স্কুলে যেতে চাই। সমস্ত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। জলবায়ু সম্পর্কে কথা বলতে চাই। আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই বিষয়গুলি সম্পর্কে আরও কথোপকথনের প্রয়োজন - শৃঙ্খলা সম্পর্কে, বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে এবং মানসিক শক্তি সম্পর্কে"।
তিনি আরও জানিয়েছেন, “আমি আরও বেশি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে চাই। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য সাইক্লিং এবং ট্রেকিং ক্যাম্প পরিচালনা করতে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কথা বলতে এবং আরও সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাই। তবে এর জন্য আমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে — তা সে সংগঠন, নীতিনির্ধারক, অথবা অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনও ব্যক্তি হোক না কেন"।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন