ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলার ৬৪টি উপজেলা। এরমধ্যে পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট ও হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোণা জেলায়। এই বন্যায় ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ৯০ শতাংশ এলাকা, সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলার ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গত দুই দিনে চার ফুট করে আট ফুট জল বেড়েছে এসব এলাকায়। বর্তমানে ৪০ লাখ মানুষ জলবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী একসঙ্গে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। তবে এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেই হিসাব জানা যায়নি।
এছাড়াও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর জেলায়ও বন্যা পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে যাচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। কারণ সেসব এলাকায় বন্যার তীব্রতা বাড়ছে, নদীর জল আরও বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে আশঙ্কাজনকভাবে যমুনা নদীর জল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যমুনার চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার শঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপাড়ের মানুষের।
এছাড়াও তিস্তা নদীর জল বিপদসীমার সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর সবগুলোরই জল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি নদীর ১৮ পয়েন্টের জল বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, সুরমা, কুশিয়ারা, ঘাঘট এবং সোমেশ্বরী নদীর ১৮ পয়েন্টের জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। বন্যা পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আর নতুন করে প্লাবিত হতে পারে টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চল।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের স্থানসমূহে মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সকল প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এই সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারেও বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। একই সময়ে তিস্তা নদীর জল সমতল বিপদসীমার কাছাকাছি অথবা উপরে অবস্থান করতে পারে।
বন্যার্তদের পাশে সরকার ও সাধারণ মানুষ:
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও নীলফামারী এই ৬ জেলায় বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ৮০ লাখ টাকা এবং ২৬ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্যাকেটে চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনিসহ যে খাদ্য সামগ্রী রয়েছে, তা পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের এক সপ্তাহ চলবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে নগদ টাকা এবং চালও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও সিলেট জেলার জন্য ২০০ টন চাল, ৩০ লাখ টাকা এবং ৮ হাজার প্যাকেট খাবার, সুনামগঞ্জ জেলার জন্য ৩০ লাখ টাকা এবং ৮ হাজার প্যাকেট খাবার, নেত্রকোনার জন্য ১০০ টন চাল, ১০ লাখ টাকা এবং ৩ হাজার প্যাকেট খাবার, কুড়িগ্রামের জন্য ১০ লাখ টাকা এবং ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়া রংপুর ও নীলফামারী জেলার জন্য ৩ হাজার প্যাকেট করে ছয় হাজার প্যাকেট খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সরকারি এসব তৎপরতার বাইরেও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, যুব সংগঠন, এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকেই ত্রাণসহ নানা ধরনের সহযোগিতা নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সেলিব্রেটিরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছে। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকেই তহবিল গঠন করে ত্রাণসহ অন্যান্য সহযোগিতার কাজ করছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও ত্রাণ সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে এই ভয়াবহ বন্যার পেছনের কারণ কী?
বাংলাদেশে এই ভয়াবহ বন্যার জন্য বেশ কিছু কারণ দেখছেন গবেষকরা। নদী গবেষকরা বলছেন, এবারের এই রকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে।
১. নদীর জল বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া
মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত জল নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত জল বের হতে না পারেনি। এর জন্য দায়ী হচ্ছে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নদী গবেষক মুমিনুল হক সরকার বলেছেন, প্রতি বছর উজান থেকে জলের সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর জল বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি জল আসলে তা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।
দেশের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও জল ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম।
ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এই গবেষকরা।
গবেষকরা মনে করছেন এসব কারণে মেঘালয় বা আসামে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই সিলেট বা কুড়িগ্রাম এলাকায় বন্যার তৈরি হচ্ছে।
২. অপরিকল্পিত উন্নয়ন
অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণ রয়েছে। সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যে রকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার জল এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার জল থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।'
অধ্যাপক সাইফুল আরো জানান, ‘'হাওরে বিভিন্ন জায়গায় আমরা রাস্তা করে ফেলেছি। ফলে জল প্রবাহে বাধা তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে জল আর মাটিতে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।’
এমনই এক দৃষ্টি নন্দন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন হাওড়ে। যা ইটনা-মিঠামইন সড়ক নামে পরিচিত। বন্যার পর থেকে এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকে সিলেটে অঞ্চলের বারবার বন্যার জন্য ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন। এর আগেও এই সড়ক নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা হয়েছে।
গত জানুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যাতে হাওরে এখন থেকে এলিভেটেড বা উড়াল সড়ক করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই এখনো ‘অল সিজন’ বা ‘সাবমার্সিবল’ সড়ক।
৩. যথাযথ বাঁধ না থাকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোন কারণে হাওরে বা নদীতে জল বাড়তে শুরু করলে তার খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। এছাড়াও খুলনা বিভাগের বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে বন্যার অন্যতম কারণ যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণ না করা। এবারও নেত্রকোনা ও সিলেট অঞ্চলে আগাম বন্যার অন্যতম কারণ ছিল প্রয়োজনীয় বাঁধ না থাকা। যার ফলে উজানের ঢলের পানি খুব সহজেই হাওড়ের ধানে জমিতে ঢুকে পরে ও ব্যুরো ধানে ক্ষতি করে।
বুয়েটের বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, ‘হাওরে এসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। সেটা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে।’
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।