হাসরাত মোহানি
হাসরাত মোহানিফাইল ছবি, সবরঙ ইন্ডিয়ার সৌজন্যে

Azadi 75: 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'-এর স্রষ্টা হাসরাত মোহানি - প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেওয়া কবি

কংগ্রেসের ৩৬তম অধিবেশনে যে দু'জন প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তাঁদের একজন হলেন মৌলানা হসরত মোহানী এবং অন্যজন স্বামী কুমারানন্দ। যারা দু'জনেই ছিলেন কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী।

স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আজ উদ্বেলিত ভারতবাসী। তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে শ্লোগান উঠেছে ‘বন্দেমাতরম’। দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে 'হর ঘর তিরঙ্গা'। যদিও ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর বর্তমানে এর পাশাপাশিই শুরু হয়েছে এক নতুন পর্ব। দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াই, বাক-স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই, সংবিধান রক্ষার লড়াই।

যদিও, এই লড়াই নতুন নয়। সাম্রাজ্যবাদী, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই লড়াই শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। ইতিহাস বলছে, ভারতের স্বাধীনতা একটি 'অর্জিত' অধিকার। যে অধিকার অর্জিত হয়েছে বহু ভারতবাসীর রক্ত, দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগের বিনিময়ে আর আজ তা রক্ষার দায়িত্ব সব ভারতবাসীর।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যাঁদের আন্দোলনের জেরে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তাঁদের অনেককেই আমরা ভুলতে বসেছি। বলা ভালো, তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি স্কুল-কলেজের ইতিহাসের পাঠ্য বইতে।

ঠিক যেমন ভাবে ইতিহাসের পাতায় ব্রাত্য হয়েছেন মাওলানা সৈয়দ ফজল-উল-হাসান। যিনি প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেন। শ্লোগান তোলেন 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। আসলে, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের স্রষ্টা হলেন হাসরাত মোহানি।

বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে হাসরাত মোহানি
বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে হাসরাত মোহানিফাইল ছবি সংগৃহীত

কে এই হাসরাত মোহানি ?

কবি, সাংবাদিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী হাসরাত মোহানি'র আসল নাম মাওলানা সৈয়দ ফজল-উল-হাসান। ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের সংযুক্ত প্রদেশের উন্নাও জেলার মোহন নামক এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

হাসরাত ছিল তাঁর 'ছদ্ম' নাম। যে নামে তিনি উর্দু কবিতা লিখেছেন। আর শেষ নাম 'মোহনি' তার জন্মস্থান মোহনকে কেন্দ্র করে। ১৯০৩ সালে আলীগড় থেকে স্নাতক হন।

১৯০৪ সালে হাসরাত মোহানি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জাতীয় আন্দোলনে শামিল হবার পর ১৯০৫ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে 'স্বদেশী আন্দোলনে' অংশ নেন। ১৯২১ সালে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬তম অধিবেশনে যে দু'জন প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তাঁদের একজন হলেন মৌলানা হসরত মোহানী এবং অন্যজন স্বামী কুমারানন্দ। যারা দু'জনেই ছিলেন কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী। যদিও সে প্রস্তাব তখন গৃহীত হয়নি। পরে সেই ধারণাকেই আন্দোলনে পরিণত করেন মহাত্মা গান্ধী। এই আমেদাবাদে অধিবেশনেই প্রচারিত হয় মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। জাতীয় কংগ্রেস সর্বপ্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে।

১৯১৯ সালের খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মোহানি। ১৯২১ সালে তিনি 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' (Inquilab Zindabad) শ্লোগান তৈরি করেন। ওই বছর কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। পরে, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' শব্দবন্ধ জনপ্রিয় করে তোলেন ভগৎ সিং।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন অধ্যাপক অজয় ​​তিওয়ারি জানিয়েছেন, '১৯২১ সালে কংগ্রেসে প্রথমবার সম্পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব দেন হাসরত মোহানি। এর বিরোধিতা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ যদিও, দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বও ছিল৷ মহাত্মা গান্ধী যখন 'খাদি আন্দোলন' শুরু করেন, মোহানি এর বিরোধিতা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এর ফলে পরোক্ষভাবে শ্রমিকরা শাস্তির মুখে পড়বেন।'

মোহানি যখন বিদেশী পণ্য বয়কটের প্রস্তাব করেন, গান্ধীজি শেষ পর্যন্ত এই ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং ১০ বছর পর স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। গান্ধী তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, মোহানির জেদের কারণে তিনি "বাধ্য" হয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলন করতে। তিনি লিখেছেন, 'অসহযোগ আন্দোলনকে স্বদেশী আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি।'

হাসরাত মোহানির নামাঙ্কিত স্ট্যাম্প
হাসরাত মোহানির নামাঙ্কিত স্ট্যাম্পছবি সংগৃহীত

'উর্দু-ই-মুয়াল্লা' (Urdu-e-Mualla) নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন মোহানি। স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে এটি প্রকাশ করতেন তিনি। এক সময়, এই সাংবাদিকতার জেরে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েন তিনি। ব্রিটিশরা তাঁকে ৩০০০ টাকা জরিমানা করে।

মোহানি যখন জরিমানা দেওয়ার জন্য তাঁর সম্পত্তির মূল্যায়ন করেন, তখন তাঁর সম্পত্তির মোট মূল্য দাঁড়ায় ৫০ টাকা। জরিমানার টাকা না দিতে পারায় তাঁকে জেলে যেতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে বারবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।

ধর্ম নির্বিশেষে মৌলবাদীদের বিরোধিতা করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক হাসরাত মোহনী। আলীগড়ে থাকাকালীন স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের চিন্তাধারার বিরোধিতা করেন তিনি।

১৯৪৬ সালে ভারতে গণপরিষদ গঠনের সময় উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত হন হাসরাত মোহানি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বিরোধিতা করেন তিনি। ১৯৫১ সালের ১৩ মে, ভারতের মাটিতে (লখনউ-এ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাসরাত মোহানি।

With inputs from IANS and Ajay Dasgupta

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in