বৈষম্যের তাপে জ্বলছে আমেরিকা, উঠে আসছে অ্যান্টিফা

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

বৈষম্যের নগ্ন আঁচে আমেরিকার নাগরিক জীবন জ্বলছে। বিশ্বের সবথেকে উন্নত সমরাস্ত্রে বলীয়ান, এবং উত্তরাধুনিক সংস্কৃতিতে পুষ্ট গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ঘটনাকে সকলেই ঘৃণার চোখে দেখছেন। ছিঃ ছিঃ করছে সারা পৃথিবীর মানুষ। নিন্দার ঝড় উঠেছে। তাকে চাপা দিতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়ক ট্রাম্পের গলায় উঠে আসছে অ্যান্টিফার নাম।

কুড়ি ডলারের মৃত্যু

জর্জ ফ্লয়েড। কালো চামড়ার জর্জ ফ্লয়েড। ৪৬ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর দোষ? তিনি একটা নকল কুড়ি ডলারের বিনিময়ে মুদির দোকান থেকে জিনিস নিয়েছিলেন, যা দোকানের কর্মচারীরা প্রথমে বোঝেননি। পরে পুলিশকে তারা ফোন করে নকলের বিষয়টা জানান। ঘটনার ১৭ মিনিট পর রাস্তায় পুলিশ ফ্লয়েডকে আটক করে।

প্রতিরোধ না করলেও পুলিশ অফিসার তাঁকে রাস্তায় ফেলে তাঁর গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে। দম বন্ধ হয়ে আসা ফ্লয়েড হাঁসফাঁস করতে থাকেন। তবুও তিনি প্রতিরোধ করেননি। অনুরোধ করেছিলেন। বাঁচার আর্তি ছিল তাঁর গলায়। বলেছিলেন, “অফিসার আমার দম আটকে আসছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ... আমি মরে যাবো।”

সেই কাতর আবেদনে সাড়া দেননি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চৌভিন। “প্লিজ অফিসার পা সরান, আমায় মেরে ফেলবেন না”, এই অনুনয়ে শ্বেতাঙ্গ চৌভিনের হাটু তাঁর গলায় আরও গেড়ে বসেছিল। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড পর দম ফুরিয়ে আসে কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের। নিশ্চিত হয় কুড়ি ডলারের মৃত্যু। অনিবার্য হয় সাদার গোপন রাগে কালোর হত্যা।

একটা প্রাণের চিহ্ন মুছে ফেলা এই ঘটনার পরের অংশটা আমরা জানি। সেটা ফলাফল। লাখো মানুষের ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকে আমেরিকা। প্রাণের ভয়ে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রনায়ক লুকিয়ে পড়েন গোপন বাঙ্কারে।

সমাজের কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়

জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার এই ঘটনাটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারি। আমরা ভাবতে পারি যে একটা ছোট ঘটনা কীভাবে সমগ্র মার্কিন মুলুককে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হল? সামান্য একজনের মৃত্যুতে কেন সাড়া বিশ্ব তোলপাড় হচ্ছে? কেন হাজার হাজার নারীপুরুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন? কেন সর্বশক্তিমান ট্রাম্পকে ভয়ে মাটির নীচে গর্তে (আধুনিক পরিভাষায় যাকে বাঙ্কার বলা হয়) লুকোতে হচ্ছে?

এই কয়েকটি প্রশ্নের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন আমাদের সকলের মাথায় আসতেই পারে। আমরা ভেবে দেখতে পারি সেইসব প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক জবাব কোন ধরণের বয়ানে গঠিত হতে পারে। সেই প্রসঙ্গে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আর তখনই আমরা তা দেখতে পাবো যে সমাজের কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। এই সুবাদেই আমরা দেখবো যে গত ২৫ মে ২০২০র আপাত বিচ্ছিন্ন সামাজিক ঘটনাটাও ইতিহাসের গভীরে শেকড় ছড়িয়ে আছে।

আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনেয়াপোলিস শহরে ঘটে যাওয়া এই নারকীয় ঘটনাটি বর্বরতার এক নিদর্শন। তার উৎসের পরিসরটাও সমাজের গভীরে প্রোথিত। কারণ এই সমাজে সাদা চামড়ার মানুষ অনেক গুরুতর দোষ করলেও লঘু শাস্তি পান, ঠিক তখনই লঘু দোষে গুরু শাস্তি কালোর জন্য নির্ধারিত থাকে। তবুও গণতন্ত্র, সাম্য ও মৈত্রীর ধ্বজা সেই বৈষম্যের পীঠভূমিতে উড়ে। কর্পোরেট মিডিয়ায় সেটা আবার ফলাও করে প্রচার করা হয়।

সেই বৈষম্যের ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, ঘেটো জীবন সেই ধারাকে প্রচলিত করে এবং সযত্নে লালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সাদা চামড়ার অনতিক্রমনীয়তা ক্রমে বাড়তে থাকে। চরম আত্ম-অহঙ্কার, দম্ভ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা ক্রমে শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের পথকে নিয়মনিষ্ঠ ও নীতিনিষ্ঠ করে তোলে। শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের জাহির প্রতিনিয়ত কৃষ্ণাঙ্গের গলা চিপে ধরে। সেই শ্বাসরোধী বারুদস্তুপী সামাজিক অবস্থায় এই হত্যার ঘটনা স্ফুলিঙ্গের কাজ করে।

কালো মানুষের শ্বাসরোধী দীনতায় মরিয়া প্রতিরোধ

এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সেই বর্ণপ্রথার ইতিহাস। আমেরিকার সমাজজীবনে সেই বর্ণবৈষম্য নতুন কিছু নয়। ইতিহাসকাল ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের এই বৈষম্যমূলক আচরণ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রকাশ পেত। শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের হীন চোখে দেখতো এবং তাদের সঙ্গে মিশত না। একসঙ্গে বসে রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়ার কোন প্রশ্নই সেখানে ছিল না। ছিল না কোন ভোট দেওয়ার অধিকার। এমনকি, শ্রেণীকক্ষে কৃষ্ণাঙ্গ শিশু কখনই সামনের সারিতে বসতে পারতো না, যেমন শ্বেতাঙ্গ মানুষ বাসে উঠলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সিট ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের দূরবস্থা ছিল আরও অবর্ণনীয়। যেকোনো দোষের শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নেও বর্ণবৈষম্য ছিল বেশ প্রকট।

আমেরিকার সামাজিক ইতিহাসের পাতায় বর্ণবাদী সহিংসতার বহু নজির লেখা আছে। কারণ তখন সমাজ জীবনে, কর্মস্থলে, এমনকি শিক্ষালয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা মানুষের পরিচয় পেত না। দাস জীবনের মতো তাদের ঘেটোতে বাস করতে হতো। জনসেবামূলক কোন কাজে যুক্ত হওয়ার অধিকার তাদের ছিল না। ছিল না কোন নাগরিক অধিকার। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে সেই ক্ষোভে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয় এমনই এক ছোট ঘটনা। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামে এক আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলাকে যখন বাসে এক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান সহযাত্রীকে নিজের আসন না ছেড়ে দেওয়ার অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তখনই জ্বলে উঠে প্রতিবাদের আগুন।

আমরা জানি নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সেই লড়াইয়ে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। আমরা জানি তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গের সমাবেশে তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তব্যের কথাও আমরা জানি। “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম” নামে পরিচিত সেই ভাষণে সেই দিনই তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দাবি সহ সকল ক্ষেত্রে নাগরিক সমানাধিকারের দাবি তোলেন। এবং সেটা এক্ষুণি আইনিভাবে কার্যকরী করতে হবে, সেই দাবিও তিনি সেখানে তোলেন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত সেদিন নড়ে যায়।

সেই সমাবেশ ছিল আমেরিকার ইতিহাসে কালো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। সকল কৃষ্ণাঙ্গের মানুষ পরিচিতি প্রতিষ্ঠার, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পক্ষে সেটা ছিল এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক ভাষণ। “জন্মসূত্রে আমরা সকলেই মানুষ” এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা “সকলেই সমান” – সেই আপ্তবাক্য নির্যাতিত কালো মানুষকে জাগিয়ে তোলে। ফলস্বরূপ ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন কার্যকরী হয়।

সামাজিক পরিসরে বৈষম্যের বিভেদ কিছুটা কমে। কিন্তু তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় না। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মার্টিনের হত্যা, সেই আন্দোলনকে কিছুটা স্তিমিত করে দেয়। স্বল্প কিছু সুযোগসুবিধা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেই বিদ্রোহের আগুনে ছাই চাপা দেওয়া হয়। যে ছাইয়ে মিশে ছিল তুষ।

বৈষম্য বিরোধী চলমান বিক্ষোভ

কিছু অধিকার আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের জাহিরে দীপ্ত সামাজিক পরিসরের প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কৌশলে কালোকে অবদমিত করে রাখতে চায়। সাদারা কোনভাবেই কালোদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমানাধিকার বজায় রেখে চলতে বাধ্য করা আইনগুলোকে মেনে চলতে চায় না। আইনের কানাগলিতে শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের নিষ্ঠুরতায় পদদলিত হয় কৃষ্ণাঙ্গ মানবতা। সীমায়িত স্বাধীনতায় বেঁচে থাকে কৃষ্ণাঙ্গের জনসম্প্রদায় জীবন।

পরিস্থিতি ১৯৬৬ সালের পর থেকেই অন্য দিকে বাঁক নেয়। সেই সময় প্রতিষ্ঠিত শ্বেতাঙ্গদের গোপন সন্ত্রাসী দল কু ক্লাক্স ক্লান (কেকেকে) কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নতুন করে নিপীড়ন শুরু করে। শুরু হয় খুন, ধর্ষণ, হামলা, শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা, যা মার্টিনকে হত্যার পর বেড়ে যায়। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে বিশ্বাসী এই সন্ত্রাসী সংগঠন কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার কর্মী, কমিউনিস্ট ও আফ্রিকান-আমেরিকানদের হত্যায় মেতে ওঠে। আজও কেকেকের নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। সারা আমেরিকা জুড়ে তাদের গোপন সমিতি এখনও বেশ সক্রিয়। কালো মানুষকে অবদমিত রাখার মধ্যেই ধ্বনিত হয় তাদের জয়োল্লাস।

এই চলমান অবদমনের মধ্যেই আজ এসেছে করোনাভাইরাস। সেই অতিমারিতে বেসামাল আজকের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। কোভিড-১৯-এ মৃতের সংখ্যা সেখানে এখন লাখের গন্ডি পেরিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাও প্রায় ১৯ লাখের কাছাকাছি। কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও প্রায় ৬৩ লাখের কাছাকাছি। রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ভূমিকা ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যখন রাষ্ট্রের দমনমূলক হাজিরা হয়ে উঠছে অনাবৃত।

এমনই এক পরিস্থিতিতে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে, এবং হচ্ছে। কারণ কাজ হারানো মানুষদের মধ্যে এবং মৃত মানুষের তালিকায় সাদার তুলনায় কালো মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেশী হয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারী সুবিধা নগণ্য হওয়ায় নাগরিক অসাম্য প্রকট হচ্ছে। পুঁজির আগ্রাসন এবং শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের নিষ্ঠুরতা, সাঁড়াশি আক্রমণে কালো মানুষের জীবন করে তুলছে দুর্বিষহ।

মুক্তিকামী মানুষের সমারোহে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যাকশন বা অ্যান্টিফার হাজিরা

তেমনই এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ট্রাম্প নামক ফ্যাসিস্তসুলভ শাসককে সমাজের একটা বড়ো অংশ মেনে নিতে পারছেন না। প্রথম থেকেই তারা তা পারছিলেন না। বিপুল সংখ্যক আমেরিকাবাসী চাননি যে তাদের শাসনকর্তা হয়ে উঠুক ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক হুমকির ভয়াবহতম নজিরগুলোর একটি। ফ্যসিস্ট মুখটা তারা দেখতে চাননি। ট্রাম্পের অভিষেক সমাবেশের সেই ছবিই প্রমাণ রেখেছিল যে সকল মার্কিন নাগরিক (সাদা-কালো নির্বিশেষে) এই ফ্যাসিবাদী শক্তির মসনদ দখলের বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না।

ট্রাম্প নিজেও তা জানেন, এবং মানেন। মানতে তিনি বাধ্য। কারণ তাঁর জয়লাভের পর থেকেই দেশজুড়ে "নো ট্রাম্প, নো কেকেকে, নো ফ্যাসিস্ট ইউএসএ" স্লোগানে প্রতিদিন র‍্যালি হয়েছে। তিনি খবর নিয়ে দেখেছেন। প্রতিটা গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে বাম-গণতান্ত্রিক দলের শক্তি বৃদ্ধির কথা। তাই তিনি দেশের অভ্যন্তরে বেড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদ বিরোধী গোষ্ঠীর ভূত দেখছেন। তাই তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলনের মধ্যেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ খুঁজছেন।

প্রসঙ্গত, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বেড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী প্রশাসনিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথিকৃৎ হল র‍্যাডিকেল বামপন্থীরা। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের পিছনেও তারা ছিল। কালের নিয়মেই দেখা গেছে যে যেখানেই ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে, সেখানেই কমিউনিস্টদের উন্মেষ ঘটেছে। আজকের মার্কিন মুলুকও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১৬র পর থেকে আমেরিকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে র‍্যাডিকেল বামপন্থীদের সংগঠন অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যাকশন (অ্যান্টিফা) ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে।

তাদের জনপ্রিয়তা ২০১৭র পর দ্রুত বেড়ে যায়। ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী প্রশাসনিক কায়দা সেই জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মার্ক ব্রে তাঁর অ্যান্টিফা : দি অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট হ্যান্ডবুক বইটিতে সেই সব কথা লিখেছেন। ১৯৪৫ পরবর্তী বিশ্ব রাজনৈতিক পরিসরের ইতিহাসবেত্তা বিশ্লেষণের বাইরে আমেরিকাকে তিনি অ্যান্টিফার নিরিখে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যের বিরোধ থেকেই এখানে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যাকশনের কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, যা সংগঠনটির এই শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ট্রাম্পের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং তাঁর অপশাসন শুধু কালো মানুষের মধ্যে নয়, সাদা চামড়ার শিক্ষিত অংশের মধ্যেও বিরুদ্ধতার বীজ বোনে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা জানেন বলেই টুইটার বার্তায় অ্যান্টিফাকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার কথা জানিয়েছেন, এবং জনরোষ থেকে পালিয়ে বাঁচতে বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী না হয়ে এইভাবে পালিয়ে তিনি কি বাঁচতে পারবেন? আপাতভাবে সফল হলেও তা কতদিন? ইতিহাস যে বড়ো নির্মম! হিটলারের পরিণতি তবে কি ট্রাম্পের ভবিতব্য?

শেষের কথা

ফিরে আসা যাক জর্জ ফ্লয়েডকে পায়ে পিষে হত্যা করার দিনটিতে। সেই দিন বিকেল থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মৃত্যু ভয়কে অস্বীকার করে, লকডাউন ও কার্ফুর সকল বাধাকে চুরমার করে, মাস্ক-গ্লাভসের রক্ষা কবচ খুলে ফেলে, দৈহিক দূরত্ববিধিকে দূরে সরিয়ে রেখে, এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ঝলকানি দেখার ভয়কে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, জীবনের মূল্যকে তুচ্ছ করে পথে নেমে আসা লাখো মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর যে সংশোধনী বার্তা ট্রাম্প প্রশাসনকে শুনিয়েছেন, তা নিছক কোন একজন মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদের জন্যে নয়, বরং তা ছিল ফ্যাসিবাদী কুশাসনের বিরুদ্ধাচার।

স্বজন হারানো সেই শোকের মধ্যে থাকা জ্বালা, অপমান, বঞ্চনা ও রাষ্ট্রীয় পীড়ন প্রতিরোধের অভ্যন্তরে নিহিত থাকা অদম্য শক্তি যৌথভাবে বোনে সাম্য প্রতিষ্ঠার বীজ। স্লোগানে দীপ্ত মানুষের মিছিল, সচেতনে দেখে স্বাধীনতার স্বপ্ন। সারা বিশ্বের শাসককুল যদি না তা দেখতে সক্ষম হন, তবে সকলের কাছেই আগামী এমন ক্ষণকেই নিশ্চিত করবে। যেখানে তিষ্ঠোবার কোন সুযোগ তখন বিভাজনের রাজনৈতিক হাতিয়ার চালনায় সিদ্ধ শাসককুল কোনভাবেই পাবেন না।

শেষের সেই দিন যে আসন্ন।

ড. কৌশিক চট্টোপাধায়,
অধ্যাপক, ফারাক্কা এস এন এইচ কলেজ

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in