বাঙালি শো যা, নেহি তো...

কার্টুন সংগৃহীত
কার্টুন সংগৃহীত

বাঙালি তখনও নাগরিক হতে শেখেনি। চাষার ব্যাটা চাষ করবে, জেলের ব্যাটা মাছ ধরবে, নাপিতের ব্যাটা ক্ষৌরকর্ম করবে, জমিদারের ব্যাটা জমিদারি করবে, বামুনের ব্যাটা যজমানি করবে আর তার ফাঁকে কদাচিৎ শাস্ত্র অধ্যয়ন করবে – মোটামুটি এই ছিলো তেরো চোদ্দো শতকের বাঙ্গালির গল্প। বেটিদের কথা সচেতনভাবেই বললাম না, কেননা গল্প মোটামুটিভাবে একরকম। ঋতুবতী হতে না হতে মা হতে শুরু হওয়া। গোটা সম্ভাবনাকাল জুড়েই সেই আঁতুড়গল্প চলতো। মাঝে রান্নাঘর, শোবার ঘর নিয়ে কিছু ঝগড়া বিবাদ। বৈধব্যের কর্মসূচীও মোটামুটি একই রকম।

এহেন বাংলায় তুর্কি আক্রমণ প্রথম উল্লেখযোগ্য উৎপাত। বইপত্তর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। দুর্বল মুষ্টিমেয় বাঙালি যারা পুঁথি পত্তর ছুঁয়ে দেখতেন তাঁরা কম্পিত হাতে কিছু পুঁথি দেবস্থানে লুকিয়ে ফেলেছিলেন মাত্র। কিন্তু সে অতি সামান্য। মোটমাট তুর্কিরা প্রায় বললো – বাঙালি, চুপচাপ শো যা, নেহিতো তুর্কি আ যায়েগা। বাঙালি ভয়ে চুপসে গেল।

মহারাষ্ট্র থেকে বর্গীরা এলো ঘোড়া হাঁকিয়ে। বাঙ্গালির সদরে, অন্দরে, ফসলভরা মাঠে লুঠপাট করলো। বললো – বাঙালি, চুপচাপ শো যা। নেহি তো বর্গী আ যায়েগা। বাঙালি কেঁদে কেটে ছড়া বানিয়ে ফেললো – ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল/এসেছে মোগল’। আর বাঙালি ক্রমাগতই বিবরে লুকিয়েছে। ‘এ বাঙালি শো যা, নেহি তো গব্বর আ যায়েগা’।

বাঙালি প্রথম সচেতন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো বোধহয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেখানেও তো উপেক্ষার ইতিহাস লেখা হল। সূর্য সেন বা ক্ষুদিরাম বা সুভাষচন্দ্র বসুর দৃপ্ত মুখের ছবি দিয়ে কখনও কোনো ভারতীয় মুদ্রা ছাপা হবেনা, সাভারকারের নামের আগে ‘বীর’ বিশেষণটি পাকাপোক্ত ভাবে লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু বিনয়-বাদল-দীনেশের নামের আগে নয়। দীনবন্ধু মিত্রের নাটক নীলচাষ বিরোধী আন্দোলনকে কোন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলো সে আলোচনা ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে কতবার হয়েছে? তবু, এসব আমরা মেনে নিয়েছি।

একটু সাম্প্রতিক সময়ে আসি। মহাকাব্যিক বীর রস তো বাংলা সাহিত্যে এসে শান্ত রসের স্রোতোধারা হয়ে গেছে। রাম ও তো ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র গৃহস্থ পত্নীনিষ্ঠ বাঙালি পুরুষটি। বাঙালি হিন্দুর ঠাকুরঘরে দুগগা, কালি, গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মীর পাশে যদি কদাচিৎ রঘুবীরের স্থান হয়েওছে, সে রামের জন্য লাঠি সোঁটা হাতে বাঙালিকে তো কোনোদিন রাস্তায় নামতে হয়নি!

যা সত্য, যা ঐতিহ্যবাহী তাকে নতুন করে প্রমাণ করার দরকার হয়না। সেটাই মানুষের প্রতিদিনের জীবন ধর্ম। সঠিক না ভুল – তার মূল্যায়ন করে তো একটা জাতিকে পালটে দেবার প্রেসক্রিপশন লেখা যায়না? পিঠটান দেবার চরিত্র বাঙালির জাতিগত। হঠাৎ ঢাল তলোয়ার লাঠি হাতে হইহই রইরই করে রাস্তায় কারা বেরিয়ে এলো? মাথায় হিন্দিতে জয় শ্রীরাম লেখা লাল বা কমলা পট্টি আর সোনালী ঝিলিমিলি কারা বাঁধছে? কে ট্যুইট করে বাঙালিকে ভিখারী বলছে? কোন নেতা এত নিশ্চিত হলেন যে বাঙালি আসলে কাঙালি? আবার শুনতে পাচ্ছি, ‘বাঙালি, শো যা নেহি তো গব্বর আ যায়েগা। সেই বরং ভালো। ইতিবাসের ধারা অনুযায়ী আমরা আবার ঘরে ঢুকে যাই এবং প্রকৃতির নিয়মেই আবার বাঁচবো। কিন্তু এই চোখরাঙানির সামনে যদি বা আত্মবিস্মৃত হই, যদি ভাবতে থাকি, এটাই আমাদের আসল চরিত্র, তাহলে বাঙালিকে ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। গো বলয়ের সংস্কৃতির অনুকরণে আমরা উদ্বাহু নেত্য শুরু করলে আমরা অচিরেই পিসেমশাই হয়ে যাবো সকলে ‘খোট্টা শালার বেটারা হামকো কিলায়কে কাঁঠাল পাকা দিয়া’।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in