পশ্চিমবঙ্গে আট দফার বিধানসভার ভোট চলছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোট হয়েছে গত ২৭শে মার্চ ও ১লা এপ্রিল। আজ ৬ই এপ্রিল, মঙ্গলবার হয়ে গেল তৃতীয় দফার ভোট। এর পরও বাকী থাকছে পাঁচ দফা। সেগুলো যথাক্রমে আগামী ১০ই এপ্রিল (চতুর্থ দফা), ১৭ই এপ্রিল (পঞ্চমদফা), ২২ই এপ্রিল (ষষ্ঠ দফা), ২৬ই এপ্রিল (সপ্তম দফা) এবং ২৯ই এপ্রিল (অষ্টম দফা) হবে। ফলাফল প্রকাশ হবে ২ মে। ২০২১র এই নির্বাচনে রাজ্যের মোট ২৩টি জেলায় বিধানসভার আসনসংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে ৬৮টি আসন তফশিলি জাতি ও ১৮টি আসন তফশিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত।
প্রথম দফায় পাঁচ জেলায় ভোট হয়েছে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। খুব কম কেন্দ্রের পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন বিরোধীরা। পশ্চিম মেদিনীপুর (পার্ট- ওয়ান), পূর্ব মেদিনীপুর (পার্ট- টু), বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়ায় ভোট হয়েছে ঐ ২৭শে মার্চ, শনিবার । ওইদিন মোট ৩০টি আসনে ভোট হয়েছে। বিধানসভার কেন্দ্রগুলি হলঃ- পটাশপুর, কাঁথি উত্তর, ভগবানপুর, খেজুরি, কাঁথি দক্ষিণ, রামনগর, এগরা, দাঁতন, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, কেশিয়াড়ি, খড়গপুর, গড়বেতা, শালবনি, মেদিনীপুর, বিনপুর, বান্দোয়ান, বলরামপুর, বাঘমুন্ডি, জয়পুর, পুরুলিয়া, মানবাজার, কাশীপুর, পারা, রঘুনাথপুর, শালতোড়া, ছাতনা, রানিবাঁধ এবং রাইপুর।
প্রথম পর্যায়ে হওয়া এই তিরিশটি আসনের বেশীটাই পূর্বে ছিল বামেদের দখলে। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জঙ্গলমহল সহ পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলে “আরএসএসের দুর্গা”র নেতৃত্বে এই অঞ্চলকে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। শাসক বামের ভুলের পথ গোলে কাজে লাগানো হয় জন-অসন্তোষ। ২০০৬ সালের পর থেকে র্যাডিক্যাল বামদের সশস্ত্র কার্যকলাপ এখানে বাড়তে থাকে। মূলত, মাওবাদী মতাদর্শের নামে বনপার্টি পরিচয়ে বিবেচিত কার্যকলাপ, এই অঞ্চলে হত্যা রাজনীতির প্রচলন করে। হিংসা ও আতঙ্কের সেই পরিবেশে এলাকার গরীব ও স্বল্পশিক্ষিত যুবসম্প্রদায় যুক্ত হন। সেই আঞ্চলিক স্রোতে মাওবাদে মিশে যায় আরএসএস ও তৃণমূল। সিপিআই (মাওবাদী) নেতা কিষেণ বাবু ওরফে মাল্লেজুলা কোটেশ্বর রাও ঘোষণা দেনঃ “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা দেখতে চান।” সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়। ২০১১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। ক্ষমতা দখলের তিন মাসের মধ্যেই কিষেণ বাবুরা বুঝে যান যে তাদের রাজনৈতিক রণকৌশলে একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। ফল যা হওয়ার তাই হয়। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর ঝাড়গ্রামের বুড়িশোল জঙ্গলে কিষেণজি নিহত হন।
২০১২ সালের পর থেকেই দেখা যায় যে গোটা জঙ্গল মহল এলাকা জুড়ে গেরুয়া পতাকা বেশী করে উড়তে থাকে। সেই বিকাশের চূড়ান্ত প্রতিফলন এবারের ভোটে দেখা যাবে। প্রথম দফায় হয়ে যাওয়া ৩০টি আসনের বেশিরভাগ অংশে বিজেপি তার বিজয় দেখতে পাবে। যতই লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ভোটারদের প্রবণতা আলাদা থাকুক, তবুও এই সকল আসনে সরকার বিরোধী ভোটকে বামেরা খুব বেশী তাদের দিকে আনতে এখনই সফল হয়েছেন বলে মনে হয় না। গণতান্ত্রিক লড়াই-আন্দোলন করে বেঁচে থাকা মানুষ যেহেতু অতীতের অভিজ্ঞতায় বর্তমানকে দেখছেন, তাই আবেগে না ভাসলে এই ভোট নীরব বিপ্লবে বামেদের সফল করতে পারে। তবে ছত্রধর ঠিক কার হয়ে কাজ করতে কয়েকদিন জেলের বাইরে থাকতে পারলেন সে বিশ্লেষণ কয়েকদিন পরই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় পর্যায়েও ৩০ টি আসনে নির্বাচন হয়েছে। গত ১লা এপ্রিল, বৃহস্পতিবার হয়ে যাওয়া এই দ্বিতীয় দফার ভোট ছিল চার জেলায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা (পার্ট ওয়ান), পশ্চিম মেদিনীপুর (পার্ট ২), বাঁকুড়া (পার্ট ২) ও পূর্ব মেদিনীপুরে ভোট নেওয়া হয়েছে। এই দফায় যে কেন্দ্রগুলিতে ভোট ছিলঃ- গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, পাঁশকুড়া পশ্চিম, ময়না, নন্দকুমার, মহিষাদল, হলদিয়া, নন্দীগ্রাম, চণ্ডীপুর, খড়্গপুর সদর, নারায়ণগড়, সবং, পিংলা, ডেবরা, দাসপুর, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, কেশপুর, তালডাংরা, বাঁকুড়া, বড়জোড়া, ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতলপুর, ইন্দাস, সোনামুখী। এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে পূর্ব-মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আসনে সারা রাজ্য সহ দেশের ও দেশের বাইরের মিডিয়ার চোখ ছিল। কারণ এখানেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে লড়াই একদা তারই দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীর। যিনি কয়েকদিন আগেই তৃণমূল সরকারে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিও এবং আধিপত্য ত্যাগ করে হঠাৎ করেই বিজেপিতে চলে আসেন এবং দলের অনেক গোপন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। তৃণমূলের কাছে তিনি “দলবদলু গদ্দার”। আজকের দফা ধরে পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত তিনটি দফায় মোট ৯১টি আসনে বিধানসভার নির্বাচন সম্পূর্ণ হল। ভোটারদের অবস্থান ক্রমশই সরকার বিরোধী হয়ে উঠছে।
আজকের এই তৃতীয় দফায় যে ৩১ টি কেন্দ্রে ভোট হল তা হাওড়া, হুগলি ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রয়েছে। এই তৃতীয় দফার কেন্দ্রগুলি হলঃ- কুলতলি, কুলপি, রায়দিঘি, মন্দিরবাজার, জয়নগর, বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, ক্যানিং পশ্চিম, ক্যানিং পূর্ব, মগরাহাট পূর্ব, মগরাহাট পশ্চিম, ডায়মন্ডহারবার, ফলতা, সাঁতরাগাছি, বিষ্ণুপুর, উলুবেড়িয়া উত্তর, উলুবেড়িয়া দক্ষিণ, শ্যামপুর, বাগনান, আমতা, উদয়নারায়ণপুর, জগৎবল্লভপুর, জঙ্গিপাড়া, হরিপাল, ধনেখালি, তারকেশ্বর, পুরশুরা, আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুল। এই ভোটে কান্তি বাবুর মতো প্রবীণ মানুষ আছেন, যিনি ঝড়ের আগেই মানুষের কাছে পৌঁছে যান, তেমনি আছেন প্রতিকুর রহমানের মতো নবীন বাম প্রার্থী।
যাইহোক আমাদের আলোচনার বিষয় হল নন্দীগ্রামের ভোট রসায়ন। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আগামী পাঁচ দফা ভোটের ফিরিস্তি একটু দেওয়া যেতে পারে। ১০ এপ্রিল, শনিবার চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ হবে হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলির দু’একটি অংশে এবং সেই সঙ্গে সমগ্র আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার ভোটগ্রহণও ওইদিনই সম্পন্ন হবে। মোট ৪৪টি আসনে হবে এই ভোট। চতুর্থ দফায় এই ভোট কেন্দ্রগুলি হলঃ- সোনারপুর দক্ষিণ, ভাঙড়, কসবা, যাদবপুর, সোনারপুর উত্তর, টালিগঞ্জ, বেহালা পূর্ব, বেহালা পশ্চিম, মহেশতলা, বজবজ, মেটিয়াবুরুজ, বালি, হাওড়া উত্তর, হাওড়া মধ্য, শিবপুর, হাওড়া দক্ষিণ, সাঁকরাইল, পাঁচলা, উলুবেড়িয়া পূর্ব, ডোমজুর, উত্তরপাড়া, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, সিঙ্গুর, চন্দননগর, চুঁচুড়া, বলাগড়, পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, চণ্ডীতলা, মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙা, কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, শীতলকুচি, সিতাই, দিনহাটা, নাটাবাড়ি, তুফানগঞ্জ, কুমারগ্রাম, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, মাদারিহাট।
১৭ এপ্রিল, শনিবার পঞ্চম দফার ভোট হবে মোট ৪৫টি বিধানসভা কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রগুলি ছড়িয়ে রয়েছে নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও বর্ধমানের একটি করে অংশে এবং দার্জিলিং ও জলপাইগুড়িতে। পঞ্চম দফার ভোটে এই কেন্দ্রগুলি হলঃ- ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, মাল, নাগরাকাটা, কালিম্পং, দার্জিলিং, কার্শিয়ং, মাটিগাড়া-নক্সালবাড়ি, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া, শান্তিপুর, রানাঘাট উত্তর পশ্চিম, কৃষ্ণগঞ্জ, রানাঘাট উত্তর পূর্ব, রানাঘাট দক্ষিণ, চাকদা, কল্যাণী, হরিণঘাটা, পানিহাটি, কামারহাটি, বরানগর, দমদম, রাজারহাট নিউ টাউন, বিধাননগর, রাজারহাট গোপালপুর, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, দেগঙ্গা, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, বসিরহাট দক্ষিণ, বসিরহাট উত্তর, হিঙ্গলগঞ্জ, খণ্ডঘোষ, বর্ধমান দক্ষিণ, রায়না, জামালপুর, মন্তেশ্বর, কালনা, মেমারি, বর্ধমান উত্তর।
২২ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার ষষ্ঠ দফার ভোট হবে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি করে অংশে এবং সঙ্গে থাকছে গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলা। ৪৩ টি বিধানসভার প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ এই দিনে নির্ধারিত হবে। ষষ্ঠ দফার ভোট কেন্দ্রগুলি হলঃ- চোপড়া, ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করণদিঘি, হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ, ইটাহার, করিমপুর, তেহট্ট, পলাশীপাড়া, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, চাপড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর দক্ষিণ, বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, হাবরা, অশোকনগর, আমডাঙা, বিজপুর, নৈহাটি, ভাটপাড়া, জগদ্দল, নোয়াপাড়া, ব্যারাকপুর, খড়দা, দমদম উত্তর, ভাতার, পূর্বস্থলী দক্ষিণ, পূর্বস্থলী উত্তর, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউশগ্রাম, গলসি।
২৬ এপ্রিল, সোমবার সপ্তম দফা ভোটগ্রহণ পর্ব বিস্তৃত থাকবে পাঁচ জেলায়। দক্ষিণ দিনাজপুর, কলকাতা দক্ষিণ, মালদার একাংশ, মুর্শিদাবাদের একাংশ ও পশ্চিম বর্ধমানে ভোট নেওয়া হবে এই পর্যায়ে। ভোট হবে মোট ৩৬টি বিধানসভা আসনে। এই দফার ভোট কেন্দ্রগুলি হলঃ- কুশমন্ডি, কুমারগঞ্জ, বালুরঘাট, তপন, গঙ্গারামপুর, হরিরামপুর, হবিবপুর, গাজোল, চাঁচল, হরিশ্চন্দ্রপুর, মালতিপুর, রতুয়া, ফরাক্কা, সামসেরগঞ্জ, সুতি, জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, সাগরদিঘি, লালগোলা, ভগবানগোলা, রানিনগর, মুর্শিদাবাদ, নবগ্রাম, কলকাতা বন্দর, ভবানীপুর, রাসবিহারী, বালিগঞ্জ, পাণ্ডবেশ্বর, দুর্গাপুর পূর্ব, দুর্গাপুর পশ্চিম, রানিগঞ্জ, জামুরিয়া, আসানসোল দক্ষিণ, আসানসোল উত্তর, কুলটি, বরাবনি।
অষ্টম তথা শেষ দফার ভোট ২৯ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। মালদার একাংশ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও কলকাতা -এই চার জেলার মোট ৩৫টি আসনের জন্য এই দিন হবে ভোটগ্রহণ। দফার ভোট কেন্দ্রগুলি হলঃ- মানিকচক, মালদা, ইংরেজবাজার, মোথাবাড়ি, সুজাপুর, বৈষ্ণবনগর, খড়গ্রাম, বর্ধমান, কান্দি, ভরতপুর, রেজিনগর, বেলডাঙা, বহরমপুর, হরিহরপাড়া, নওদা, ডোমকল, জলঙ্গি, চৌরঙ্গি, এন্টালি, বেলেঘাটা, জোড়াসাঁকো, শ্যামপুকুর, মানিকতলা, কাশীপুর-বেলগাছিয়া, দুবরাজপুর, সিউরি, বোলপুর, নানুর, লাভপুর, সাঁইথিয়া, ময়ুরেশ্বর, রামপুরহাট, হাসন, নলহাটি, মুরারই। ২রা মে ফল ঘোষণা করা হবে। তার আগে নানা হিসাব-নিকাশ, নানা সংখ্যাতত্ত্বের বিশ্লেষণ চলবে।
তৃতীয় পর্যায়ের আজকের ভোট একটা অভিমুখকে যে ক্রমশ স্পষ্ট করছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপিকে সাহায্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন। বিজেপি উস্কানি দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন চুপ। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এতটা খারাপ নির্বাচন কখনও দেখিনি।” কে বলছেন কথাটা? স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই অভিযোগ করতে হচ্ছে, যিনি রাজ্যের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে একেবারে অবাধ (!) ও স্বচ্ছ (!) নির্বাচনের উপমায় বাংলার মানুষের সামনে হাজির করতে সফল হয়েছিলেন। নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী হয়ে তিনি যখন টের পাচ্ছেন যে সবটাই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে তার দিকে, সব বুথে এজেন্ট বসাতে আজ তিনি অকৃতকার্য হচ্ছেন, নিজেও প্রায় ঘন্টা দুয়েক অবরুদ্ধ থাকছেন, তখন প্রকাশ পাচ্ছে হতাশার কথা। রাজ্যপালকে ফোন করছেন, বাধ্য হয়ে। তবে তিনি যে আর কোথাও দাঁড়াবেন না বলেছেন, সেটা তৃণমূল কর্মীদের মনোবলে অক্সিজেন দিয়েছে। ২০০৯-এর পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের পর বাম কর্মীদের মতোই এখন তৃণমূল কর্মীদের মনোবল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে যে একটা পরিকল্পিত ধ্বংসকাণ্ড চলেছে, বামেদের সেই কথা যেমন তখন কেউ মানছিল না, ঠিক তেমন আজ তৃণমূলের ভালো কাজ দুর্নীতি ও স্বজনতোষণে ঢাকা পড়ে যায়। দলের অভ্যন্তরে গদ্দার, আরএসএসের এজেন্ট দেখতে শুরু করেছেন তিনি। দলের অভ্যন্তর থেকে অভ্যুত্থান, ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ তিনি ২০১৬ থেকেই দেখে আসছেন। আজ যেন বিপর্যয়ের চূড়ান্ত দামামা শুনছেন। ভীতি তাকে ভুল বকতে সাহায্য করছে। এই ভয় তিনি নন্দীগ্রামে পেয়েছেন। যে কোন সময় যা কিছু ঘটতে পারে, তা তিনি দেখেছেন। মানুষের থেকে প্রশাসনকে বেশী আস্থার বলে মনে হয়েছে তার। ভোটের রাজনীতিতে এটা যে বড় ভুল, তা তিনি খুব ভালো জানেন। তবুও কিছু করার নেই। কারণ দলের ভেতরেই তো গদ্দার। এই অনিশ্চয়তা উত্তেজনা বাড়ায়। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এই অনিশ্চয়তার মাঝে দাঁড়িয়ে মমতার জিতে যাওয়ার কথা অনেকেই বলছেন। সেই সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তির বিন্যাসক্রম আমরা দেখছি। সেখানে বহু ধরনের কারণকে তারা চিহ্নিত করছেন। মমতা ও নন্দীগ্রামের সংযোগ-সূত্রটিকে তারা সবচেয়ে আগে রাখছেন। তাতে অবশ্য অধিকারী পরিবারের ‘ভূমিপুত্র’ প্রচারের পাল্টা আবেগকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা যায়।
এছাড়াও আছে মহিলা হিসেবে মমতার গণমোহিনী চরিত্র, মমতার পরাক্রমশালী বৈশিষ্ট্য, মুসলিম ভোটারের ত্রাতা বিবেচনা করা, ইত্যাদি। কিন্তু সংকটে থাকা মানুষটার কাছে এই বিমূর্ত বৈশিষ্ট্যগুলো কি সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ হয়? না, হয় না। সেই কারণেই ভোটের ফলাফল কেন্দ্র অনুসারে বদলে যায়। ঠিক যেমন নন্দীগ্রামে শুভেন্দু প্রার্থী হওয়ায় অনেক কিছু বদলে গেছে। অন্য কেউ প্রার্থী হলে মমতার নির্বাচনী সভার বক্তব্য যা হতে পারতো, শুভেন্দু হওয়ায় সেটা বদলে যায়। “নন্দীগ্রাম গণহত্যা” প্রচারের পিছনে ষড়যন্ত্রের যে কথা আজ দশ বছর ধরে বামেরা বলে আসছিল, মৃতের পিঠে গুলি লাগা সহ চটি পুলিশের যে ধোঁয়াশার কথা তারা আগেই জানিয়েছিল, আজ মমতাকে নির্বাচনী সভায় সেই রক্ত-হোলির তদন্ত রিপোর্ট ফাঁস করতে হয়। সেই বাধ্যতায় শুনতেও হয় যে সেই “হাড়হিম করা” সন্ত্রাসের তিনিও ছিলেন একজন ষড়যন্ত্রী। না হলে “সেই সব অফিসার, আমলার পদোন্নতি তিনি গত দশ বছরে ঘটান কেন?” বামেদের কাছে নন্দীগ্রাম তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ভাঙার লড়াই। সেই লড়াইয়ে বামপক্ষের সংযুক্ত মোর্চা জয়ী হয়েছে। ১০০% বুথে মোর্চার কর্মী হাজির ছিল। কোন অসুবিধে হয়নি এবং রিগিং-এর অভিযোগও নেই। ইভিএমের কারসাজি অস্বীকার করলে, মানুষের ভোটেই কেউ একজন জয়যুক্ত হবেন। সেখানে ২০১৯র লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে সামনে রেখে অনেকেই দেখছি মীনাক্ষীকে তৃতীয় স্থানে রেখে মমতা ও শুভেন্দুর মধ্যে কে জিতবেন তা নিয়ে দুই ধরনের কথা বলছেন। একদল বলছেন ফল “এবিএম” হবে, তো আর একদল বলছেন “বিএএম” হবে। তবে কি “এমবিএ” হতে পারে না? ঐ দুই দলের ভোটার বলবেন, ‘পাগলের প্রলাপ।”
২০১৯র লোকসভা ভোটের সেই পরিস্থিতি আজ নেই। বিজেপিতে শক্তিধর অংশ এখন তৃণমূল। তারাই বিভিন্ন কেন্দ্রে লড়ছেন। নন্দীগ্রাম আজ সেই উদাহরণের এপিসেন্টার। যে শুভেন্দু নারদাখ্যাত, যে শুভেন্দু দল ভাঙানোর সেনাপতি, যে শুভেন্দু তার পারিবারিক ক্ষমতায় ২০১১ থেকেই মেদিনীপুরের পঞ্চায়েত, পুরসভা নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন আর কে জিতে পদে বসবেন সেই নির্দেশে মমতার মতামতকে তোয়াক্কা করেনি, সে আজ প্রতিপক্ষ। মমতার পক্ষে থাকা সহানুভূতির তৃণমূলী ভোটারকে সে ক্ষমতার বলে বিজেপিতে আনতে সক্ষম। তবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের গলাকাটা দামের সঙ্গে ব্যাঙ্কের সুদের নিম্নগতি ও দুর্নীতি শুভেন্দুকে প্রতিহত করে। নীরব সন্ত্রাস তৃণমূল সমর্থককে ৩১র রাতে ১৪কে মনে করায়। নন্দীগ্রামে ভোট না দিতে যাওয়া অংশে তাই এবার পাড়ায় তৃণমূলের ভিড় বেশী। অধিকারী পরিবারের নেতৃত্বে চলা তৃণমূল নন্দীগ্রামে ৬০ শতাংশ। ২০১১ সালের প্রবল বাম-বিরোধী হাওয়ায় নন্দীগ্রামের মুখ, আন্দোলনের আইকন ফিরোজা বিবি ৪৩,৬৪০ ভোটের মার্জিনে জেতেন। তৃণমূলের বাস্কে ছিল ৬০.১৭ শতাংশ ভোট, আর বামেরা পায় ৩৪.৭৫ শতাংশ ভোট। গুলি চালানোর ঘটনায় তখন নন্দীগ্রাম সহ সারা রাজ্যের মাটি তপ্ত। সেই আগুনের মুখোমুখি হয়ে ৩৪ শতাংশের বেশী নিয়ে ৩৪ বছরের শাসন ক্ষমতাচ্যুত হয়। ফিরোজা বিবিকে সামনে রেখে শুরু হয় নতুন অত্যাচার। বাড়ি ছাড়া, ভিটে-মাটি ছাড়া হওয়ার পরও ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম ২২.২৮ শতাংশ ভোট পায় এই বিধানসভা অঞ্চলে। তৃণমূল পায় ৬৮.১৫ শতাংশ। ৮% ভোট বাম থেকে তৃণমূলে যায় (ছাপ্পার প্রসঙ্গ বাদ দিলে)। কিন্তু ঠিক তার ২ বছরের মাথায়, ২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনে বাম ভোট দাঁড়ায় ২৬.৪৯%। অর্থাৎ ৪% বৃদ্ধি। তৃণমূলের ক্ষয় হয় ২%-এর মতো এবং সেটা কমার পরে হয় ৬৬.৭৯%। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে নন্দীগ্রামে বিজেপি ৫%। ২০১১র বিধানসভা, ২০১৪র লোকসভা এবং ২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট যথাক্রমে ৩.৩৯%, ৫.৬৯% এবং ৫.৩২%। বাকী ৯৫ শতাংশের মধ্যে তৃণমূল ৬০.১৭%, আর বাম ৩৪.৭৫%। নোটা সহ অন্যান্য দল মিলিয়ে ০.০৮%-এর মতো। কিন্তু ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল ৬০.১৭%, আর বাম ৩৪.৭৫%। নোটা সহ অন্যান্য দল মিলিয়ে ০.০৮%-এর মতো। কিন্তু ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল যে লাগামহীন অত্যাচার, দুর্নীতি করে তার প্রতিরোধে বাম নেতৃত্ব ব্যর্থ হন। আক্রান্তের পাশে সব জায়গায় দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। ততদিনে দুটো বিষয় আবার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এক, নব্য তৃণমূলের বিপক্ষে বিজেপি রূপে আদি তৃণমূলের উত্থান এবং দুই, “আগে রাম তারপর বাম”- আরএসএসের এই প্রচার। ফলে সারা রাজ্যের মতো এই বিধানসভায় ২০১৯র লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে অদ্ভুত অদলবদল দেখা যায়। তৃণমূল এখানে পায় ৬২.৭৭ শতাংশ, এবং বামেদের জামানত জব্দ হয় ৪.৯৯ শতাংশে। কিন্তু বিজেপি এখানে ২৯.৯২ শতাংশ ভোট পায়, যার ২১ শতাংশ বাম, ৪% বিক্ষুব্ধ তৃণমূল এবং বাকী ৫ শতাংশ তার নিজের স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক। নন্দীগ্রাম হল বিজেপির ৫%-এর গড়। সেই গড়ে তৃণমূল নেতা “শিশির বাবুর ছেলেটা” জেতার স্বপ্ন দেখেন নিশ্চয়ই ঐ বামেদের দেওয়া শিক্ষামূলক ২১ শতাংশ ভোট ধরে রাখার জন্য নয়। “কলমা বিবি”র ব্যাঙ্কের হদিশ সহ তার দুর্নীতির কথা ফাঁস করা শুভেন্দু বামেদের একটু স্তুতি গাননি যে তা নয়, কিন্তু তার লড়াই ছিল নন্দীগ্রাম-১ ও নন্দীগ্রাম-২ ব্লক মিলিয়ে থাকা তৃণমূলের ৪৭.৭৪% হিন্দু ভোট। সে জানে তৃণমূলের অন্দরে থাকা মুসলিম ভোটের ২-৫% শতাংশও সে নাও পেতে পারে। কিন্তু ঐ হিন্দু ভোটের ৩০% যদি সে নিজের দখলে আনতে পারে তবে তার জয় নিশ্চিত।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে গোটা বাংলা জুড়েই ভাগ হচ্ছে তৃণমূলের ভোট। নন্দীগ্রামেও তা স্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন যে নন্দীগ্রামে ভয়ানক পোলারাইজড ভোট হয়েছে। তারা যুক্তিতে মূলত দুটো কারণকে নির্দেশ করছেন। এক, এই আসনে জয়-পরাজয় দুই প্রার্থীর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এটাকে অনেকটা ইগোর লড়াই বিবেচনায় সেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ পরিস্থিতিটাকে মিডিয়ার বাইনারিতে - দিদি না দাদা - ভোটের মেরুকৃত ন্যারেটিভে দেখছেন। দুই, নন্দীগ্রামের দুটি ব্লকে থাকা মুসলিম ভোট। মেরুকৃত ন্যারেটিভের মাজা ভেঙ্গেছে ২৮এর ব্রিগেড। তরুণদের এগিয়ে আসা, ভোটের প্রকৃত ইস্যুগুলোকে সামনে আনা, টুপি-চিহ্ন, “এবং ইত্যাদি” কারণেও সেটা গুরুত্বহীন হয়েছে। তাই সেই এক নম্বর কারণের যুক্তিতে থাকা বাইনারির করনারি ধরে টান দেওয়ার আর প্রয়োজন আমি দেখছি না। এখন বাংলার ভোটে যদি “হিন্দু ভোট”, “মুসলিম ভোট” শব্দবন্ধনীকে বাইনারির পোলারাইজেশনে নন্দীগ্রামকে দেখি তবে নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলে যে নন্দীগ্রাম-১ ও নন্দীগ্রাম-২ ব্লকে সেটা যথাক্রমে ৬৫.৯৬ ও ৩৪.০৪ এবং ৮৭.৮৮ ও ১.২.১২ শতাংশ। শুভেন্দুর কাছে নন্দীগ্রাম-১ ব্লকে মমতাকে দুর্বল করাটাই ছিল আসল কাজ। সেই কাজে শুভেন্দু কতটা সফল তা ২ তারিখ দেখা গেলেও তার দাবি অনুসারে সাচার কমিটির রিপোর্ট ভুলে মানুষ এখন আব্বাস বুঝছেন। মুসলিম ভাইয়েরা তাদের “কলমা বিবিকে” এখন চিনে গেছে। মমতার দল দুর্বল হয়েছে অনেক কারণে। শুধু বিজেপির সাপ্লাই-লাইন হয়ে নয়, মমতার গ্রহণ যোগ্যতাও কমেছে সেই সব কারণে। নির্বাচনে তৃণমূল ভোট দিতে না দেওয়া, ছাত্র সংসদ সহ প্রতিটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের ভোট আটকে রাখা, প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করা, রাজ্যেটাকে শিল্প শুন্য করে শিল্পীপূর্ণ করে ফুর্তির উৎসবে মেতে থাকা, পরিকল্পনাহীন প্রকল্প রচনা, গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে চুরমার করে দেওয়া, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সাফল্য, শিক্ষান্তে বেকারত্বকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলা, সাংবিধানিক অধিকার হরণ, দৈনন্দিন জীবনে, এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ও চুরিকে শিল্পে পরিণত করা, কাটমানিকে অনিবার্য করে তোলা, ইত্যাদি কারণ এই বারের নির্বাচনে মমতার জনসমর্থনকে দুর্বল করেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিচিতি রাজনীতির খেলায় চোখ বুজে সাফল্য পাওয়া মমতার সামনে যতিচিহ্ন হিসাবে আব্বাসের হাজিরা। একজন পীরজাদা যখন প্রকাশ্যে বলেন - "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ হল উনি বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ভাগ করে দিয়েছেন। মুসলিম তোষণ করে হিন্দু ভাইদের মনে মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপতা তৈরি করেছেন। বাংলায় এসব ছিল না আগে। উনি আজ কলমা পড়ছেন, কাল মোনাজতের ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন, ইফতার করছেন। আরে বাবা, কলমা পড়া, বা আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করার জন্য তো ধর্মগুরুরা আছেন। উনি চাকরি, শিক্ষা, শিল্প, ... এগুলো নিশ্চিত করুন।" তখন মুসলিম ভাইয়ের রক্তে কাঁপন আসে দাফন হওয়ার আগে। ফলে ২৩.০৮ শতাংশ “মুসলিম ভোট” পুষ্টি জোগানোতে আর একমাত্রিক থাকে না। মুসলিম ভাইয়ের মতো একই কাঁপন বেকার শহুরে যুবকের বুকেও লাগে, তাই তার বাড়ির লোকেরা মমতাকে ভোট দিলেও সে ও তার বন্ধুরা মীনাক্ষীর পাশে চলে আসে। মনে রাখতে হবে নন্দীগ্রাম-১ অঞ্চলে মাত্র ২.৭৯ শতাংশ নগর জনসংখ্যা রয়েছে এবং বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী এখনও গ্রামে এবং উন্নয়ন থেকে দূরে থাকেন। যেখানে নন্দীগ্রাম-২ শহুরে জনসংখ্যা ৪.২৮%। নন্দীগ্রামের সচেতন ভোটার আজ জেনেছেন যে তালপাটির খালের জলে শিশুদের পা চিরে ফেলার হার্মাদ কাহিনীটা ছিল একটা জলজ্যান্ত মিথ্যে। শত-সহস্র মহিলার স্তন কেটে নেওয়ার খবরটা ছিল আদতে একটা গুজব। বুদ্ধিজীবীরা সেদিন তাদের নিজেদের ধান্দায় নন্দীগ্রামে এসে এই সব গুজব ছড়ানোতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন, এবং পরে সরকারী “হল থেকে পদ” দখলে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করেন। ফলে অনুতপ্ত তৃণমূলী ভোটার আজকের দাদা-দিদির লড়াইকে তার নিজের বলে ভাবতে পারেন না। এটা তৃণমূলের দুর্বলতা শুধু নয়, এটা আদি-বিজেপি সমর্থকদের সমস্যা। তাই এই “এপ্রিল ফুল”-এর দিনে আর বোকা সাজতে চান না। নোটা ভোটারের সংখ্যা এই বারের নির্বাচনে তাই বাড়বে। কিছু ভোট সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জির ঝুলিতেও চলে আসে। আদি-বিজেপির অনেকেই যেমন শুভেন্দুর প্রার্থী হওয়াটা মেনে নিতে পারেন না। নন্দীগ্রাম বিধানসভায় এবারের ভোটে নতুন ভোটারের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো। পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারও এখানে কম নেই। প্রায় আড়াই লক্ষের বেশী ভোটারের এই কেন্দ্রে এবারে প্রায় দুই লক্ষের বেশী ভোট পড়েছে। যে প্রার্থীর ঝুলিতে ৩৪ শতাংশের বেশী ভোট থাকবে তিনিই জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হবেন। সেই বিচারে মীনাক্ষী কতটা সফল হতে পারেন? নিশ্চিতভাবেই পারেন।
২০১১ সালেও ৩৪.৭৫ শতাংশ ভোট নন্দীগ্রামে বামেদের ছিল। ফলে সবটা উদ্ধার হলে কাজটা সহজ হয়। শুভেন্দু বিজেপির প্রার্থী হওয়ার কারণে সেটার বেশী অংশ ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকছেই। তার ওপর এটা বিধানসভার নির্বাচন। লোকসভায় বিজেপিতে চলে যাওয়া ২২%-এর মধ্যে ২০% ফিরে এলেও মীনাক্ষীর হাতে থাকা ৫% বেড়ে হয় ২৫ শতাংশ। এনআরসি সহ কৃষিবিলে তৃণমূলের আসল রূপ দেখে চোখ খুলে যাওয়া সংখ্যালঘু মোট ভোটারের ৩০ শতাংশ যদি লড়াকু তরুণ নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে দোয়ার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলেই মীনাক্ষীর মোট ৩২% ভোট নিশ্চিত হয়। ২৩-এর মধ্যে ৭% স্যুইং খুবই স্বাভাবিক। তখনও এই স্পষ্ট বক্তা মীনাক্ষীর হাতে থাকে তরুণ অংশের ভোটারের ৫ শতাংশ। সম্ভাবনার এই হিসেবে নন্দীগ্রামে মমতা হেরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সরকারটা পড়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই হল একুশের বিধানসভা নির্বাচনের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসর ও তার বাস্তবতা। বিশেষ করে বাংলার যুব-সমাজ যখন জীবন থেকে চলে যাওয়া ১০টা বছর ফিরে পাওয়ার জবাব চাইছে।
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।