৫ এপ্রিল দিল্লির রাজপথে মজদুর কিষাণ সংঘর্ষ র‍্যালি, লালঝান্ডার লহর দেখবে দেশের মানুষ

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে ফসলের দাম, বিদ্যুৎ, সেচ, ঋণমকুবের দাবিতে বড়ো বড়ো আন্দোলন হয়েছে। নেতৃত্ব দিয়েছে এআইকেএস। কিন্তু নির্বাচনগুলিতে কমিউনিস্টরা এই লড়াইয়ের ফসল তুলতে পারেনি।
ফাইল চিত্র
ফাইল চিত্র ছবি - AIKS ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট

৫ এপ্রিল দিল্লির রাজপথ আবার আন্দোলিত হবে লালঝান্ডার লহরে। পার্লামেন্ট স্ট্রিটে ওই দিন শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের সমাবেশ — মজদুর কিষান সংঘর্ষ র‍্যালি। সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ ), সারা ভারত কৃষক সভা (এআইকেএস ) এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন (এআইএডব্লিউইউ)’র যৌথ আহ্বানে এই সমাবেশ। রয়েছে চোদ্দ দফা দবি। সমাবেশের এই দাবিসনদে দেশের মেহনতি মানুষের জ্বলন্ত ইস্যুগুলিই স্থান পেয়েছে।

লোকসভা নির্বাচন এখনো একবছর বাকি। বিজেপি এবং বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী জোট কীরকম আকার নেবে সে ছবিটা এখনও পরিষ্কার নয়। এই পরিস্থিতিতে একটু আগেভাগেই দেশের মেহনতি মানুষের ইস্যুগুলিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়েই এই সমাবেশ। সিআইটিইউ, এআইকেএস এবং খেতমজুর ইউনিয়ন এই তিন বামপন্থী সংগঠন হলো দেশের শ্রমিক, কৃষক ও খেতমজুরদের অন্যতম বৃহত্তম সংগঠন। একবছর ধরে দিল্লির সীমান্তে সংযুক্ত কৃষক মের্চার নেতৃত্বে চলা কৃষক আন্দোলন সংঘটনে এই তিন সংগঠনের প্রভূত অবদান রয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সর্বভারতীয় ফেডারেশনগুলির জাতীয় মঞ্চ গড়ে উঠেছে। এই মঞ্চ কয়েকটি সাধারণ দাবিতে (সমাবেশের দাবিসনদেও রয়েছে এই দাবিগুলি) গত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করছে; সংগঠিত করেছে বেশ কয়েকটা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটও। এই মঞ্চ গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা যদি কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে থাকে, সেটা হলো সিআইটিইউ। বহু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মত হলো, সিআইটিইউ না উদ্যোগ নিলে এই মঞ্চ গড়ে উঠত না।  যদিও এই মঞ্চে অবশ্য আরএসএস'র শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ নেই। তাই সিআইটিইউ, এআইকেএস এবং খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকা এই সমাবেশকে দেশের শাসক দল উপেক্ষা করতে পারবে না। এই তিন সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে, তিন লক্ষাধিক মানুষকে সমাবেশে হাজির করানো। যদি সত্যি তারা এই লক্ষ্যপূরণে সফল হয়, তাহলে দিল্লির রাজনীতিতে বামপন্থীদের  অ্যাজেন্ডাগুলি আবার আলোচনায় আসবে। তবে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের এধরনের সমাবেশ দিল্লিতে এই প্রথম নয়। ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর,  আজ থেকে সাড়ে চার বছর আগে মজদুর কিষান সংঘর্ষ র‍্যালি প্রথমবার হয়েছিল দিল্লিতে; এই তিন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে।

৫ এপ্রিলের সমাবেশ নিয়ে গত দু-তিন মাস ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে এই তিন সংগঠন। আবার গত তিন মাসেই এই তিন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ; হয়েছে সংগঠনের সর্বস্তরের সম্মেলনগুলি। সর্বস্তরের সম্মেলনেই এই সমাবেশ নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা হয়েছে, পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক স্তরে। এই তিন সংগঠনই সমাবেশে তাদের পরিকল্পনা সফল করার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। গত কয়েকদিন সামাজিক মাধ্যমে খুবই দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক, কৃষক ও খেতমজুরদের সমাবেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার খবর। সবমিলিয়ে সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উত্তাপ চোখে পড়ছে, তাতে মনে হয়, জমায়েতের লক্ষ্যপূরণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে এই সমাবেশ।

২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিআইটিইউ, এআইকেএস এবং খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে হয় মজদুর কিষান মহাঅধিবেশন। এই অধিবেশনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৫ এপ্রিলের সমাবেশের। মহাঅধিবেশনেই চূড়ান্ত হয় দাবিসনদ। এই দাবিগুলি হলো: ন্যূনতম মজুরি প্রতিমাসে ২৬ হাজার টাকা এবং সমস্ত শ্রমিকের পেনশন ১০ হাজার টাকা সুনিশ্চিত করা; সব কৃষি উৎপাদনের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সি২+৫০% করার আইনি গ্যারান্টি সহ শষ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করা; চারটি শ্রম কোড এবং ইলেকট্রিসিটি অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২০ বাতিল; এমএনরেগায় ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরির সাথে বছরে ২০০ দিনের কাজ এবং এই প্রকল্পকে শহরাঞ্চলে সম্প্রসারিত করা; গরিব চাষি, মধ্য চাষি ও খেতমজুরদের এককালীন ঋণমকুব এবং তাঁদের ৬০ বছর বয়স হলে পেনশনের ব্যবস্থা করা; সর্বজনীন বাসস্থান। এছাড়াও দাবিসনদে রয়েছে — রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ, ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন ও নয়া শিক্ষা নীতি বাতিল, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, গণবণ্টন ব্যবস্থার সর্বজনীন করা ও এর মধ্যদিয়ে ১৪টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ, কর্পোরেট করের বৃদ্ধি, অতিধনীদের ওপর কর আরোপ এবং সম্পদ কর চালু করার মতো দাবিও।

দেশে মোদি শাসন ন'বছর হতে চলল। এই জমানায় আরএসএস'র নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী শক্তির গোরক্ষা, লভজিহাদ, ঘরওয়াপসি, বুলডোজার রাজনীতি সংখ্যালঘুদের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের 'সবক' শেখানোর হিন্দুত্ববাদী শক্তির আজ বড়ো হাতিয়ার হয়েছে মব লিঞ্চিং। এসবই দেশের সমাজজীবনে তৈরি করেছে গভীর ক্ষত। শক্তিশালী হয়েছে বিভাজনের রাজনীতি, তীব্র হয়েছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। এর ভালোই নির্বাচনী ডিভিডেন্ড পাচ্ছে বিজেপি-আরএসএস। এই নির্বাচনী ফলক ব্যবহার করেই সমস্তরকমের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ওপর চালানো হচ্ছে স্টিমরোলার। ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে দেশের সংবিধানকে। 

স্বাভাবিকভাবে এই রাজনীতিকে ওরা আরও আঁকড়ে ধরবে, আরও প্রসারিত করতে চাইবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামাজিক বিভাজনকেই শুধু চওড়া করে না, শ্রমিক আন্দোলনকেও দুর্বল করে। সমাজে যা কিছু উৎপাদন হয়, যা কিছু নির্মাণ হয়, তাতে সবচেয়ে বেশি অবদান থাকে শ্রমিক, কৃষক এবং খেতমজুরদের। মতাদর্শগতভাবে ও সাংগঠনিকভাবে সবরকমের সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে এই তিন শ্রেণিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করা যায় তা আজ দেশের মেহনতি মানুষের আন্দোলনের সামনে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। গত কয়েক বছর ধরে যৌথ কর্মসূচির ধরন দেখে মনে  হয়, দেশের মেহনতি মানুষের আন্দোলনের অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসেবে সিআইটিইউ, এআইকেএস এবং খেতমজুর ইউনিয়ন  এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। তাই ৫ এপ্রিলের  সমাবেশের সফলের ওপর দেশের মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।

রাস্তার লড়াইয়ে সফল হওয়া এবং নির্বাচনী ফলাফলে তার প্রতিফলন দুটো কখনই একরৈখিক নয়। শ্রমিকদের ডাকা সর্বভারতীয় ধর্মঘট কিংবা ক্ষেত্রওয়াড়ি ধর্মঘটে দেখা গেছে কোটি কোটি শ্রমিক, সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনগুলিতে দেখা গেছে, বেশিরভাগক্ষেত্রে এই নীতির পক্ষ থাকা দলগুলিই ভোটে জিতেছে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে ফসলের দাম, বিদ্যুৎ, সেচ, ঋণমকুবের দাবিতে বড়ো বড়ো আন্দোলন হয়েছে। নেতৃত্ব দিয়েছে এআইকেএস। কিন্তু নির্বাচনগুলিতে কমিউনিস্টরা কিংবা সহযোগী শক্তিরা এই লড়াইয়ের ফসল তুলতে পারেনি। দু-তিনটা আসন জেতার মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছৈ। অন্যদিকে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই দেখা গেছে, বামপন্থীদের শক্তি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। একইভাবে তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি কৃষক অংশ নিয়েছিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের। এই আন্দোলনের চাপে তিন কৃষি আইন ফেরাতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তবে এই আন্দোলনের অন্যান্যা দাবি যেমন, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ এবং সমস্ত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চিতিকরণের দাবি সরকার মেনে নেয়নি। কিন্তু দেখা গেল, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি বিরাটভাবে জয় পেল। স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড়ো সফল গণআন্দোলন নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারল না।

 মোদি জমানায় বৈষম্য, ক্ষুধা, সাধারণ মানুষের ওপর অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা এক অকল্পনীয় স্তরে পৌঁছেছে। চারটি শ্রমকোড চালুর মধ্যদিয়ে অবাধ শ্রমিক শোষণের আইনি ছাড়পত্র দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বামবিরোধী যেকোনো মানুষ এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, সমাবেশের দাবিসনদের মধ্যে ওই অন্যায়, অবিচার থেকে মুক্তির পথ বাতলানো আছে। তাই এই সমাবেশের মধ্যদিয়েই কাজ শেষ হয়ে যাবে না। দাবিসনদকে সমাজের সর্বঅংশের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে হবে। কেন না এই দাবিসনদেই দেশের নব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির কথা বলা আছে। এটা রাজনৈতিক কাজ, দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এতে সফল হলেই দাবি আদায়ে সফল হবে আন্দোলন। প্রভাব ফেলতে পারবে নির্বাচনী ফলেও।

ফাইল চিত্র
৩৪ বছরে রাজ্যে দাঙ্গার সংখ্যা ছিল শূন্য, আবারও বামেরা এলে বন্ধ হবে ধর্মের নামে বেয়াদপি

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in