পরিবেশ ভাবনায় কার্ল মার্কস: ২০৬তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

‘তরুণ’ মার্কস, কী ‘প্রবীণ’ মার্কস, উভয়েই পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদনের ধরনকে মানবকেন্দ্রিক এবং পরিবেশ শোষণের একটি প্রক্রিয়ায় দেখেছেন। তাঁর ধারণায় পরিবেশের ক্ষয় নিশ্চিত করেই পুঁজিবাদকে বেঁচে থাকতে হয়।
কার্ল মার্কস
কার্ল মার্কসফাইল ছবি, হিস্ট্রি ডট কম-এর সৌজন্যে

রাজনৈতিক বাস্তুশাস্ত্র এবং পরিবেশগত অর্থনীতি সম্পর্কিত আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে সামাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আগ্রহের কারণ হয়েছে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের পর থেকে যখন মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত ধারায় গ্রহণীয় হতে শুরু করে, তখন পরিবেশীয় সমাজতত্ত্বের ধ্রুপদী চিন্তাধারার পরিসরে মার্কসীয় ভাবনায় চোখ ফেরানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। দেখা যায়, ‘তরুণ’ মার্কস, কী ‘প্রবীণ’ মার্কস, উভয়েই পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদনের ধরনকে মানবকেন্দ্রিক এবং পরিবেশ শোষণের একটি প্রক্রিয়ায় দেখেছেন। তাঁর ধারণায় পরিবেশের ক্ষয় নিশ্চিত করেই পুঁজিবাদকে বেঁচে থাকতে হয়। মুনাফার লোভে, প্রাণীকুলে, মানব প্রজাতির একটা মুষ্টিমেয় অংশ প্রকৃতির ক্ষয় নিশ্চিত করে।    

প্রাণী হয়েও মানুষ প্রাণীকুলে অনন্য। মানব প্রকৃতির অভ্যন্তরে সেই দ্বান্দ্বিক বৈশিষ্ট্য রোপণ করে সংস্কৃতি। পুঁজিবাদে সেই সংস্কৃতিই মানুষকে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসকারী সংগঠনের একজন করে তোলে। পুঁজিবাদী মতাদর্শগত গোঁড়ামি আবার মানুষকে পরিবেশ থেকে আলাদা কিছু হিসেবে দেখে থাকে, যা কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস মানতেন না। বরং তাঁরা পরিবেশ এবং মানুষকে দ্বান্দ্বিকভাবে পরস্পরের সংযুক্ত হিসেবেই বিবেচনা করেছিলেন। প্রকৃতি এবং মানবতার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক প্রসঙ্গে মার্কস লিখছেন, “প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের অজৈব দেহ, অর্থাৎ প্রকৃতি যতদূর পর্যন্ত এটি মানবদেহ নয়।” [মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যায় এমন আলোচনা প্রসঙ্গে দেখুন, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, (২০২২)। একুশ শতকে মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব। কলকাতাঃ নবজাতক প্রকাশন। পাতা, ২২৫-২৩০।]

গ্রুণ্ডিস-এ মার্কস আরও লিখছেন, “এটি প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বিপাকীয় বিনিময়ের প্রাকৃতিক, কিম্বা অজৈব অবস্থার সঙ্গে জীবিত এবং সক্রিয় মানবতার একতা নয়, এবং তাই তাদের প্রকৃতির প্রয়োগ, যার ব্যাখ্যা প্রয়োজন, অথবা যা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল, বরং এটা মানব অস্তিত্বের অজৈব অবস্থাগুলির এবং তার সক্রিয় অস্তিত্বর মধ্যে পার্থক্য করে, একটি বিচ্ছেদ যা সম্পূর্ণভাবে শুধুমাত্র মজুরি শ্রম এবং মূলধনের সম্পর্কের মধ্যেই রয়েছে।” [দেখুন, Karl Marx, (1973 [1857-8]). Grundrisse: Foundations of the Critique of Political Economy. London: Penguin Books. P. 489.] সমাজ-প্রকৃতি সম্পর্ককে মার্কসীয় বিশ্লেষণ দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রস্তাবনা গঠন করে এবং প্রকৃতির উপর সমাজের কর্তৃত্বকে স্বীকার করে। মার্কস এবং এঙ্গেলস এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাঁদের পরিবেশগত অবস্থান হল পুঁজিবাদের খুব বিপরীতে যত্ন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু তা উদাসীনতার অধিকারী নয়, বরং সেটা প্রকৃতি এবং সমাজের জন্য পরিকল্পিত।

মানুষের অস্তিত্ব এবং সেই অস্তিত্বে সক্রিয়তা একটি বিচ্ছেদ, যা সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র মজুরি শ্রম এবং পুঁজির সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান করে। প্রকৃতি হল প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ, যা মানুষের অস্তিত্বের সমগ্র কাঠামোটিকে সম্ভব করে তোলে। মার্কস মানুষকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রধান ‘এজেন্ট’ হিসেবে দেখেন। মানুষ তার প্রকৃতির অবস্থান বিরূপ দেখেন, যা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সংকট। প্রকৃতির শাশ্বত উর্বরতার স্থায়ী এবং স্বাভাবিক শর্তগুলিকে বাধা দেয় পুঁজিবাদ। উপজাতি জীবনে “বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপাদনের বিভিন্ন উপায় এবং জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন উপায় খুঁজে পায়।” কিন্তু পুঁজিবাদ প্রকৃতির সঙ্গে উৎপাদনকে একটি ভ্যাম্পায়ার-সদৃশ সম্পর্কে জাগিয়ে তোলে, যা এক ধরনের জীবন্ত মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করে, প্রকৃতির ক্ষয়ে নিজেকে রক্ষা করে। [শ্রমিক শ্রেণীর আয়ু চুষে নেওয়া থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের নির্বিচার স্বাধীনতাকে বোঝাতে মার্কস যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন সেটি হল- Aprés moi le déluge! এই প্রসঙ্গে দেখুন, Karl Marx, (1976[1867]). Capital: A Critique of Political Economy. Volume-I. London: Penguin Books. P. 381.]

পুঁজিবাদ শুধু শ্রমিকের শ্রম শোষণেই ক্ষান্ত থাকে না, তা পরিবেশের ক্ষয়কেও অনিবার্য করে তোলে। গোথা কর্মসূচির সমালোচনার শুরুতেই মার্কস বলেছিলেন যে শ্রম সব সম্পদের উৎস নয়। প্রকৃতি ঠিক তেমনি ব্যবহারিক মূল্যের উৎস (এবং এটা নিশ্চিতভাবে যেমন বস্তুগত সম্পদ ধারণ করে!) যেমন শ্রম, যা নিজেই একটি প্রাকৃতিক শক্তি, মানুষের শ্রমশক্তির প্রকাশ মাত্র। ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতির জনক উইলিয়াম পেটির ধারণা উদ্ধৃত করে মার্কস বলেছিলেন, “শ্রম বস্তুগত সম্পদের জনক, পৃথিবী তার মা।” [দেখুন, Karl Marx, (1938[1891]). Critique of the Gotha Programme. New York: International Publishers. P. 3.] মার্কস জোর দিয়েছিলেন সেই বিষয়টির ওপর যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি, উভয়েই সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুটি মূল মাধ্যম, যারা পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। মূল্যমানের হিসেব-নিকেশে প্রকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যর্থতা পুঁজিবাদের রয়েছে, এবং সম্পদের সঙ্গে মূল্যকে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতাও সেখানে আছে, যা পুঁজির শাসন ব্যবস্থার মৌলিক দ্বন্দ্ব। পল বার্কেট তাই লিখেছেন, “যারা প্রকৃতির মূল্য না দেওয়ার জন্য মার্কসকে দোষারোপ করেন, তাদের উচিত নিজেদের সমালোচনাকে পুঁজিবাদের দিকে পরিচালিত করা।” [দেখুন, Paul Burkett, (1999). Marx and Nature. New York : St. Martin’s Press. P. 99.]

পুঁজিবাদ উপনিবেশবাদের পথ ধরে সাম্রাজ্যবাদকে বাস্তব সত্যে পরিণত করে। উপনিবেশী শাসন হল উন্নতি সম্পর্কে সেই ভ্রম, যা লুন্ঠন সম্পর্কিত সত্যের বীজ বহন করে। মার্কসের ধারণায় তাই উপনিবেশবাদই পুঁজিবাদের সত্য প্রকাশ করেছিল। “বুর্জোয়া সভ্যতার গভীর ভণ্ডামি এবং অন্তর্নিহিত বর্বরতা আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে, তার নিজের দেশ থেকে, যেখানে এটি সম্মানজনক রূপ ধারণ করে, উপনিবেশগুলিতে, যেখানে এটি নগ্ন হয়ে যায়।” [দেখুন, Karl Marx, (1973). Surveys from Exile: Political Writings, Vol. 2, translated by Ben Fowkes and Paul Jackson. Harmondsworth: Penguin Books Ltd. P. 324.]

মার্কস পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশে উপনিবেশগুলির ভূমিকা, অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির প্রসঙ্গে আয়ারল্যান্ড, ভারত এবং চীনের উপনিবেশিক সম্প্রসারণের বিষয়গুলিকে শুধুমাত্র আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেননি, বিষয়গুলির ওপর তিনি সমসাময়িক ঘটনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বার্মা, মিশর, তিউনিসিয়া এবং পারস্যের ওপরও লিখেছেন। তাঁর ধারণায় রাজনৈতিক-অর্থনীতির জৈবিক নিয়ম, বুর্জোয়া যুগকে, নতুন বিশ্বের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করে। একদিকে মানবজাতির পারস্পরিক নির্ভরতার উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বজনীন মিলন, এবং সেই মিলনের উপায়; অন্যদিকে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতার বিকাশ এবং প্রাকৃতিক সংস্থার বৈজ্ঞানিক আধিপত্যে বস্তুগত উৎপাদনের রূপান্তর। [দেখুন, Karl Marx and Friedrich Engels, (1968). On Colonialism, 4th edn. Moscow: Progress Publishers. P. 89.] ঔপনিবেশিক শাসন এই দুটো ঘটনাকে একসঙ্গে ঘটায়। প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন ঔপনিবেশিক আইনে বৈধতা পায়। [ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা কীভাবে ঔপনিবেশিক অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে সেখানকার স্থায়ী বাস্তুতন্ত্রের ও জলবায়ুগত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই জৈবিক দখলের মার্কসীয় ব্যাখ্যায় দেখুন, Alfred W. Crosby, (1986). Ecological Imperialism: The Biological Expansion of Europe, 900-1900. Cambridge: Cambridge University Press.]

এঙ্গেলস তাঁর যুক্তিবাদী ধারণায় সকল কিছুর উৎসের হাজিরায় প্রকৃতির পরেই শ্রমকে বসান। প্রকৃতির এই মৌলিক উপস্থিতি তাঁকে ভাবায়। প্রকৃতির সেই বাস্তুতান্ত্রিক ভাবনায় অর্থনীতির চলককে বিচার করতে চাইলে তিনিই হয়ে ওঠেন সেই চিন্তাবিদ যিনি মার্কসের সহযোগী ভূমিকায় তাপগতীয় সূত্রের প্রচলক। [মার্কস-এঙ্গেলসের বাস্তুসংস্থানবিদ্যা সম্পর্কিত চর্চাধারা সম্পর্কে আজ বহু গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়। বাস্তুনারীবাদ এবং যত্নের নীতিনিষ্ঠতার আলোচনায় এঙ্গেলস প্রসঙ্গে দুটি ছোট নিবন্ধের কথা তাই এখানে বলতেই হয়। এই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কাজের প্রথমটি করেছেন জন বেলামি ফস্টার এবং পল বার্কেট। সেই যৌথ কাজটি “ক্লাসিক্যাল মার্কসিজম এন্ড দ্যা সেকেন্ড ল অব থার্মোডিনামিক্স ” শিরোনামে ২০০৮ সালে অর্গানাইজেনশন এনভাইরনমেন্ট (২১: ৩) পত্রিকায়, সেজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। আলোচনার জন্য পত্রিকাটির ৩-৩৭ পাতা দ্রষ্টব্য। দ্বিতীয় নিবন্ধটি ক্যাপিটালিজম, নেচার, সোশ্যালিজম (২৪: ২) পত্রিকায় ২০১৭ সালে “মার্কস, এঙ্গেলস এন্ড ইকোলজি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১০-২১ পাতা জুড়ে এই প্রবন্ধটি লেখেন মাইকেল লোয়ি। এখানে ‘মেটাবলিক রিফ্ট’ ধারণায় এঙ্গেলস প্রাসঙ্গিক হন।] এঙ্গেলসের ধারণায় বাস্তুতান্ত্রিক অর্থনীতির যুক্তিবাদী রূপরেখা তাপগতি সম্পর্কিত প্রকল্পের মধ্যেই নিহিত থাকে। তাপগতি সম্পর্কিত প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির সমালোচনায় তিনি তার প্রমাণ রাখেন। আবিষ্কৃত এবং প্রচলিত তাপগতি সম্পর্কিত জনপ্রিয় তত্ত্বসূত্রগুলির তীব্র সমালোচনা এবং ক্লাসিয়াস, পোডোলিন্সস্কির তাত্ত্বিক প্রমাণ নস্যাৎ করে বাস্তুতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি এঙ্গেলস সেই ১৮৬৭র সময়ই প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৩র প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতায় তিনি সেই বাস্তুব্যবিদ্যার সমাজতান্ত্রিক সমাধান খোঁজেন। [দেখুন, Friedrich Engels, (1966). The Dialectics of Nature. Moscow: Progress Publishers.]

ধ্রুপদী মার্কসবাদের মধ্যে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক ধারণাটি মূলত এঙ্গেলসের ধারণায় উদ্ভূত হয়েছিল। সামাজিক প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তিকে এখানে একটি সামাজিক অনুশীলন হিসেবে দেখা হয়, যা মানব, প্রকৃতি এবং সমাজের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত থাকে। প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়, কারণ এটি পুঁজিবাদী সম্পর্ককে মূর্ত করে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে এর উপায়গুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে এঙ্গেলস একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উনিশ শতকের বিজ্ঞানের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। পরিবর্তনের সাধারণ নিয়মের বিজ্ঞান হিসেবে দ্বান্দ্বিকতা শুধুমাত্র সমাজ এবং মানুষের চিন্তাধারায় নয়, বহিরাগত জগতেও তা প্রতিফলিত হয়। প্রথমে অ্যান্টি-ড্যুরিং এবং তারপর ডাইলেক্টিকস অফ নেচার গ্রন্থে এঙ্গেলস সমাজের বাইরে প্রকৃতিতে প্রসারিত করার চেষ্টা করেন। [দেখুন, Friedrich Engels, (1969). Anti-Dühring. Moscow: Progress Publishers.] এই প্রমাণগুলি ইঙ্গিত করে যে মার্কস ও এঙ্গেলস ব্যাপকভাবে প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল থাকার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন এবং এটিকে তাদের কাজের সামগ্রিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তবুও মার্কসের দার্শনিক পটভূমি এঙ্গেলসের চেয়ে অনেক গভীর ছিল, এবং প্রকৃতি এবং দ্বান্দ্বিকতার প্রতি তাঁর প্রয়োগমূলক ভাবনা অনেক বেশি জটিল ছিল। সেটি মার্কসের প্রাথমিক দার্শনিক লেখা প্রকাশের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

২৩ বছরের তরুণ এঙ্গেলস, রাজনৈতিক-অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রকৃতির হাজিরাকে অনিবার্য এবং ক্ষয়মূলক অবস্থানে দেখছেন। ১৮৪৩ সালে তিনি লিখেছেন, “পৃথিবীকে ফেরি করার বস্তুতে পরিণত করা, যে-পৃথিবী আমাদের জন্য রয়েছে কেবল একটাই, আমাদের বেঁচে থাকার যা একমাত্র শর্ত, তাকে ব্যবসার পণ্য করে তুললে আমরা নিজেদের ধ্বংস করার শেষ ধাপে পৌঁছে যাবো।” [দেখুন, Friedrich Engels, (1964[1843]). "Outline of a Critique of Political Economy", in Karl Marx, Economic and Philosophical Manuscripts of 1844. New York: International Publishers, P. 210.] ১৮৪৪ সালে মার্কস নিজে তাঁর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি গ্রন্থে বলছেন, “মানুষ বেঁচে থাকে প্রকৃতির জন্যই। প্রকৃতিই তার দেহ, এবং সে যদি জীবিত থাকতে ইচ্ছুক হয়, তবে প্রকৃতির সঙ্গে ক্রমাগত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে বাধ্যতামূলক।” এই একই রচনার অন্যত্র মার্কস অনুযোগ করে বলেছেন যে প্রকৃতির অনুপস্থিতিতে শ্রমিক কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। পুঁজিবাদের প্রভাবে মানুষের যে বিয়োজিত, বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব, তার ফলে “শ্রমজীবীদের অমলিন, নির্মল বাতাস গ্রহণ করার অধিকারও হরণ করা হয়েছে। মানুষ পুনরায় তার গুহাবাসী জীবনে প্রত্যাবর্তন করছে, কিন্তু এখন সেই গুহা সভ্যতার পূতিগন্ধময় মহামারী সৃষ্টিকারী নিঃশ্বাস দ্বারা কলুষিত”। [দেখুন, Karl Marx, (1974). Early Writings. New York: Vintage. P. 328, 359-60.]

কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে মার্কস ও এঙ্গেলস লিখছেন, “ইতিহাসের দিক থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী খুবই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে।” বুর্জোয়া শ্রেণী যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি-শোভন সম্পর্ককে তারা শেষ করে দিয়েছে। মানুষের ব্যক্তি-মূল্যকে এরা পরিণত করেছে বিনিময় মূল্যে। অগণিত অনস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধীনতার জায়গায় বুর্জোয়া সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এক নির্বিচার স্বাধীনতা, যা হল অবাধ বাণিজ্য। বাজারের তাগিদে বুর্জোয়াকে সারা পৃথিবীময় দৌড়ে বেড়াতে হয়। আর তাই বুর্জোয়া তার নির্লজ্জ, পাশবিক শোষণে পৌঁছে যায় পৃথিবীর কোণায় কোণায়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে তাদের ঢুকতে হয়। স্থায়ী আধিপত্য কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। সমস্ত সাবেকী জাতীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে হয়। নতুন শিল্প, যা শুধু দেশজ কাঁচামাল নিয়ে নয়, দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালের সাহায্য নিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। আবার নিজেদের প্রস্তুত করা পণ্যগুলিকে বিক্রির জন্য তাদের অবিরত বর্ধমান এক বাজারের প্রয়োজন হয়। সেই বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী জাতীয় উৎপাদন এবং উপভোগের একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করে। [দেখুন, Karl Marx and Friedrich Engels, (1977 [1848]). Manifesto of the Communist Party. Moscow: Progress Publishers. Pp. 38-39. তাঁরা লিখেছেন, “আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতে, বুর্জোয়া শ্ৰেণী যে উৎপাদন-শক্তির সৃষ্টি করেছে তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদন-শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষের কর্তৃত্বাধীন করা, যন্ত্রের ব্যবহার, শিল্প ও কৃষিতে রসায়নের প্রয়োগ, বাষ্পশক্তির সাহায্যে জলযাত্রা, রেলপথ, ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ, চাষবাসের জন্য গোটা মহাদেশ সাফ করে ফেলা, জলযাত্রার জন্য নদীর খাত কাটা, ভেলকিবাজির মতো যেন মাটি ফুঁড়ে জনসমষ্টির আবির্ভাব – আগেকার কোন শতক তার কল্পনাটুকুও করতে পেরেছিল যে সামাজিক শ্রমের কোলে এতখানি উৎপাদন-শক্তি সুপ্ত আছে?” ইশতেহারের ৪০-৪১ পাতা দ্রষ্টব্য।]    

মার্কস পরিবেশগত অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। জোয়ান মার্টিনেজ-আলিয়ার মতো অনেকেই সেই কথা দাবি করলেও পরিবেশগত অর্থনীতিতে মার্কসবাদের সম্ভাব্য অবদান চারটি মৌলিক বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিকশিত হয়, (i) প্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক মূল্যের মধ্যে সম্পর্ক; (ii) মূলধন হিসাবে প্রকৃতির আচরণ; (iii) অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এনট্রপি আইনের গুরুত্ব; (iv) টেকসই বা ধারণশীল উন্নয়নের ধারণা। [এমন বিতর্কের জন্য দেখুন, Joan Martinez-Alier, (2002). The Environmentalism of the Poor: A Study of Ecological Conflicts and Valuation. Cheltenham, UK: Edward Elgar Publishing Limited. P. 50. এবং Paul Burkett, (2006). Marxism and Ecological Economics: Toward a Red and Green Political Economy. Boston: Brill.] মার্কসীয় অর্থনীতিবিদরা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বৃত্তাকার এবং একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁরা অর্থনীতি এবং প্রকৃতির প্রক্রিয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেন না। কিন্তু পাশ্চাত্যের বাস্তু-সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার গবেষকগণ এবং ভারতের গান্ধীবাদীরা আলোচনার নির্মাণকে সেই দিকে নিয়ে যেতে চান, যেখানে প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্যের সমালোচক হিসেবে নয়, বরং সামাজিক অন্যায়ের সমালোচনা হিসেবে, যা তাদের জন্য, সমসাময়িক পরিবেশগত সংকট। [দেখুন, David Harvey, (1998). ‘Marxism, Metaphors and Ecological Politics,’ in Monthly Review, 49(11): 17–30. ]

এই বিষয়টি নিয়েই পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ, এমনকি বইয়ের দরকার আছে। সেই বিষয়ে খুব গভীরে না গিয়েও বলা যায় যে মার্কসবাদকে নিছক এক সামাজিক তত্ত্ব এবং সেই তাত্ত্বিক ধারাকে বিজ্ঞানের দিকে ঠেলে দিয়ে এঙ্গেলস তার ক্ষতি করেছেন বলে যে ধারণা বারে বারে তোলা হয়, সেটা ঠিক নয়। জর্জ লুকাচ তাঁর হিস্ট্রি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস বইতে বলেন, এই কাজ করে এঙ্গেলস ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে বিষয় ও বিষয়ীর যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, তাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। কিন্তু সেটা না থাকলে যে দ্বন্দ্ব তত্ত্ব আর বিপ্লবী থাকে না। এটাই যে পদ্ধতিগতভাবে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের বস্তুগত ভিত্তি, সেটা বুঝতেও তখন ভুল হয়ে যায়। তাই লুকাচের এমন ধারণার উপর জোর দেওয়া কঠিন, কারণ তিনি একই বইয়ের অন্যত্র এঙ্গেলসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। পরে তিনি প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রসঙ্গে ইতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। [ এমন আলোচনা প্রসঙ্গে দেখুন, Georg Lukács, (1971). History and Class Consciousness. London: The Merlin Press Ltd. P. 207. এছাড়াও দেখুন, John Rees, (2000). “Introduction,” in Georg Lukács, A Defence of History and Class Consciousness: Tailism and the Dialectic, translated by Esther Leslie. London : Verso. Pp. 1 - 38. ]

দ্বান্দ্বিকতা যদি সমাজ বিকাশের বস্তুগত নীতি হয়, তা হলে তাকে ইতিমধ্যেই সমাজ নির্মিত হওয়ার আগে থেকেই প্রকৃতি বিকাশের নীতি হতে হবে। তার মানে এমন না যে সমাজ বিকাশের দ্বান্দ্বিকতা আর প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অভিন্ন হবে। উপরন্তু, বলা যায় যে সামাজিক দ্বান্দ্বিকতার জ্ঞান ছাড়া ও তার মধ্যস্থতা ছাড়া প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে বোঝা সম্ভব নয়। [দেখুন, Georg Lukács, (2000). A Defence of History and Class Consciousness : Tailism and the Dialectic. London : Verso. P. 102.] সুতরাং লুকাচ শেষ অবধি গ্রামশি ও করশ্চের মতোই, বা অন্তত আংশিকভাবে, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন, এবং এঙ্গেলসের বক্তব্য, যে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা আছে, তাকে অতিসরলীকরণ না করে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। জেফ কোল্টারের মতো সমালোচকরা অবশ্য আরও অনেক বেশী একপেশে। সোশ্যালিস্ট রেজিস্টার, ১৯৭১ – এ এঙ্গেলসের ডাইলেক্টিকস অফ নেচার গ্রন্থটিকে কেন বর্জন করা উচিত তার উপর কোল্টার একটি প্রসিদ্ধ ও প্রভাবশালী প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি এঙ্গেলসের এই দ্বান্দ্বিক চিন্তাকে মার্কসবাদী দর্শন থেকে একেবারেই দূর করে দিতে চান।  [দেখুন, Jeff Coulter, (1971). ‘Marxism and the Engels Paradox,’ in Socialist Register, 8(3): 129-156.]

বস্তুত, পরিবেশ চিন্তায় মার্কসবাদীদের আগমনের পর, বিশেষ করে পল বার্কেট বা জন বেলামি ফস্টারের লেখাপত্রের পর, ছবিটা পালটাতে শুরু করে। জন বেলামি ফস্টার বলেন, লুকাচের বইয়ে ছিল একরকম অসংলগ্নতা। তিনি একদিকে বলেন প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিকতা নেই, কারণ সেখানে বিষয়ীগত মাত্রাটা নেই। আবার অন্যদিকে তিনি বলেন যে প্রকৃতিতে এক স্বতন্ত্র দ্বান্দ্বিকতা থাকতেই পারে। ‘পশ্চিমী মার্কসবাদ’ নামে পরিচিত যে ধারা প্রচলিত, তার প্রবণতাও হল স্রেফ আগাগোড়া প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে অস্বীকার করা। কারণ এই ধারা দাবি করে যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক বিষয়গুলি সম্পর্কে যে বিতর্ক আজ ক্রমে জোরালো হচ্ছে সেটা ফ্রাঙ্কফার্ট চিন্তাধারার কারসাজি। [এমন মন্তব্যের জন্য দেখুন, Perry Anderson, (1976). Considerations on Western Marxism. London: Verso. P. 88.] এখানে দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, মার্কস যে সাধারণভাবে এঙ্গেলসের প্রকৃতি বিষয়ক গবেষণাকে সমর্থন করেই কথা বলেছিলেন, সেটা এখানে অস্বীকার করা হয়। এবং দ্বিতীয়ত, এর ফলে দার্শনিক ক্ষেত্রে ভাববাদের দিকে যে ঝোঁকটা তৈরি হয়, তাকে গুরুত্ব দিয়ে পশ্চিমী মার্কসবাদ এঙ্গেলসের রচনার, বিশেষত তাঁর দর্শনের প্রসঙ্গে একটা যান্ত্রিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা খাড়া করতে চায়।

এর বিপরীতে ফস্টার ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন যে মার্কসের “ইন্দ্রিয়গত মানবিক ক্রিয়াকলাপের” ধারণাকে ব্যবহার করে কীভাবে প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখা যায়। [একুশ শতকের মার্কসীয় সমাজতত্ত্বে সেই বাস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণ এবং বিপাকীয় ফাটল সম্পর্কিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দেখুন, John Bellamy Foster, Brett Clark, and Richard York, (2010). The Ecological Rift: Capitalism’s War on the Earth. New York: Monthly Review Press. প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা এবং মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্র প্রসঙ্গে গ্রন্থটির ২১৫ থেকে ২৪৭ পাতা দ্রষ্টব্য।] ফস্টারের মতে, মার্কসের বস্তুবাদ এইরকম “স্বাভাবিক চর্চা”র কথা বলে যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে ইন্দ্রিয়গত মানবিক ক্রিয়াকলাপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতেই গেঁথে থাকে। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই জগতকে অনুভব করি কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদীরা যেমনটা ভাবেন সেটা তা নয়। যে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকৃতি নিজের সম্পর্কে সচেতন হয় সেগুলি জীব জগত থেকে নিষ্ক্রিয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য নয়, বরং তারা স্বাভাবিকতায় সক্রিয়। মানব সমাজের সঙ্গে প্রকৃতির যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিকশিত হয়, সেটাও গভীরতর হয় এবং মানুষের নেতিবাচক কাজ পরিবেশে ক্ষতের সৃষ্টি করে। ফস্টারের মতে প্রকৃতির সঙ্গে সামাজিক চর্চার, অর্থাৎ মানবিক চর্চার এই দ্বান্দ্বিকতা শুধু মার্কস ও এঙ্গেলসের চিন্তার সামঞ্জস্যকেই প্রকাশ করে না, প্রকৃতি সম্পর্কিত চর্চাধারাকেও গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ফস্টারের আরো বক্তব্য যে আজকের যুগের পরিবেশবাদী চিন্তার সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের এই চিন্তার মিল আছে। ধনতন্ত্রে সামাজিক সম্পর্কের যে বিচ্ছিন্নতাপ্রাপ্ত রূপ পরিলক্ষিত হয়, তার সঙ্গে পরিবেশের সংকটকে মিলিয়ে বোঝার জন্য এঙ্গেলসের প্রাকৃতিক দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব একটা ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়। উৎপাদন সবার আগে হল প্রকৃতির সঙ্গে একটা বিপাকীয় আদান-প্রদান বা metabolic exchange। তাই উৎপাদন সম্পর্ক যখন বিচ্ছিন্নতা বোধের সঙ্গে যুক্ত, তখন তার মধ্যে একটা অংশ প্রকৃতির সঙ্গেই বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক প্রকাশ করতে বাধ্য থাকে। তাই যে শক্তিগুলি ধনতন্ত্রে অর্থনৈতিক সংকট ঘটায়, তারাই পরিবেশকে সংকটের দিকে ঠেলে দেয়।

মার্কস ও এঙ্গেলস প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে যে ঐক্য দেখেছিলেন, সেটা এমন এক বিপ্লবী দিশা দেখায় যা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত ক্ষয়ের বিরুদ্ধ-চেতনায় ঋদ্ধ। তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বদলাবে না, বদলাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কও। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে প্রচলিত শিল্প উৎপাদনের প্রাকৃতিক প্রভাবকে উদাহরণ করে পুঁজিবাদী দার্শনিক ধারা এঙ্গেলসের এই অবদানকে বাতিল করলেও এঙ্গেলসের অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে মার্কসীয় পরিবেশবাদ আজকের বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজির যুগেও প্রকৃতির অন্যতম কেন্দ্রীয় সমস্যার আগাম পূর্বাভাস দেয়। [তবুও যে বিতর্ক ওঠে সেখানে বলা হয় যে – ক) সমাজতন্ত্র এবং সবুজ অভিমুখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে; এবং খ) সমাজতন্ত্রের পরিবেশগত ব্যবধান মেটাতে ‘সবুজ সমাজতন্ত্র’ আবির্ভূত হয়েছে। এই দুই বক্তব্য প্রসঙ্গে দেখুন, Rudolf Bahro, (1982). Socialism and Survival. London: Heretic Books. এবং Martin Ryle, (1988). Ecology and Socialism. London: Radius.] 

বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া পরিবেশবাদের বয়ান আমাদের যে জায়গাতে দাঁড়াতে বাধ্য করে, সেখানে পরিবেশের সংকট যে মানব সভ্যতারই প্রধান সংকট, সেটাকেই খুব খাটো করে আমাদের বুঝতে হয়। পুঁজিবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে পশ্চিমী তাত্ত্বিকগণ সেই কারণেই মার্কসীয় ধারণাকে নিছক একটা সামাজিক তত্ত্ব হিসেবেই দেখতে চান। মার্কসীয় দর্শনকে বুর্জোয়া সামাজিক তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার এই প্রয়াসে তাঁরা আসলেই দুটো কাজকে একসঙ্গে করতে চান, যার প্রথমটি হল এঙ্গেলসকে বাতিল করে মার্কসীয় ধারণাকে ভাববাদে আবিষ্ট করা এবং দ্বিতীয়ত, ধনতন্ত্রবিরোধী পরিবেশবাদ গড়ে তোলার বিপ্লবী চর্চাকে স্তিমিত করতে গভীর দৈব পরিবেশবাদের আলোচনাকে আকর্ষণীয় করা।

এই বিতর্কিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে জন বেলামি ফস্টার, এই গ্রহে শান্তি আনার উদ্দেশ্যে বাস্তুতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানান।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in