International Labour Day 2024: মে দিন – যে শপথ ভোলা যাবে না

People's Reporter: মে দিবস শ্রেণি সংঘাতের কুরুক্ষেত্রে শ্রমিকদের পুঁজির বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে শঙ্খে ফুঁ দেওয়ার দিন। এই মূল উদ্দেশ্য যদি কেউ ভুলে যান, তাহলে তাতে মে দিনেরই অপমান।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স - আকাশ

বিংশ শতকের প্রথম দশকের কথা। বিগত শতকের শৈশব আর কৈশোর কাল পেরিয়ে ইউরোপের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন পা রেখেছে যৌবনে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক স্ব-মহিমায় বিরাজমান। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রিটেন – শিল্পোন্নত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে শ্রম-শক্তি শিখেছে পুঁজির চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে। বিশেষ করে জার্মানির শ্রমিক আন্দোলন ইউরোপের সকল দেশের শ্রমিকদের কাছেই আদর্শ স্বরূপ। প্রভাবে ও সংগঠনে কাউটস্কি, লিবনিখট, লুক্সেমবার্গের মতো নেতা-নেত্রীর দ্বারা চালিত জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তুলনা রহিত। দূর দেশ থেকে সমাজতন্ত্রীরা এসে হাজির হন এই দলের কর্মপদ্ধতি দেখে কিছু শেখার উদ্দেশ্য নিয়ে।

ঠিক এই কারণেই কেউই আশ্চর্য হয়নি জার্মানিতে রুশ সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-এর আগমনে। ১৯০৫-এর রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার পর স্বদেশ থেকে নির্বাসিত আলেকজান্দ্রা শিখে নিতে চেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম এস.পি.ডি-দলের সংগঠনের কৌশল ও লড়াইয়ের কায়দা। শেখার উদ্দেশ্যেই তিনি ঘুরেছিলেন জার্মানির প্রদেশ থেকে প্রদেশে। কি দেখেছিলেন আর তার থেকে কি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তা পুরো আলোচনার পরিসর এখানে নেই। আমাদের এই প্রবন্ধের প্রয়োজনে শুধু একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব।

মে দিনের প্রাক্কালে জার্মানির একটি শিল্প শহরে এসেছেন কোলনতাই। উৎসবের মেজাজ চারিদিকে শ্রমিক মহল্লায়। সরকারী ভাবে ছুটি নেই কোনও, মাইনে তাই কাটা যাবে। তবুও মে দিবসে কাজে যাবেন না কেউ। যে মাইনে মালিকরা কাটবেন, সারা বছর ট্রেড ইউনিয়নের সংগৃহীত তহবিল থেকেই তা পেয়ে যাবেন প্রত্যেক শ্রমিক। এমনও শুনলেন কোলনতাই, কোনও কোনও কারখানায় নাকি শ্রমিকশক্তি এত সংগঠিত, মালিকরা যেচে পড়েই কেউ ১-লা মে কাজে না আসলেও টাকা কাটেন না। রাশিয়ায় শ্রমিকদের মালিকরা মানুষই মনে করেন না। মে দিবসে কাজে না এলে চাকরি থেকে ঘাড়ধাক্কা পাকা। চাই কি, পুলিশ জেলেও পুরতে পারে। ট্রেড ইউনিয়নও এত সংগঠিত নয়, যে মাইনে কাটলে তা শ্রমিকদের ফিরিয়ে দিতে পারবে। কোলনতাই শুনলেন, জার্মানিতেও নাকি বছর দশক আগে একই রকম পরিস্থিতি ছিল। এখন সংগঠিত শ্রমিক শক্তির সামনে পুঁজি পিছু হটেছে।  

সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে শুনে যখন আশা আর উত্তেজনায় ফুটছিলেন কোলনতাই, কল্পনা করছিলেন কবে রাশিয়াতেও এইরকম হবে, ঠিক তখনই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এসেছিলেন এক পুরনো শ্রমিক নেতা। অল্প হেসে বলেছিলেন,

‘আপনি খুব খুশি হয়েছেন দেখছি। কিন্তু কমরেড, এটা কিন্তু ফাঁদ। না, না – প্রতিবাদ করবেন না। বলতে দিন আমায়। হ্যাঁ, এটা ফাঁদ। আমরা যখন প্রথম আন্দোলন গড়ে তুলছিলাম মে দিন আমাদের কাছে উৎসবের দিন ছিল না, ছিল আত্মত্যাগের অনুশীলনের দিন, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা ঝালিয়ে নেওয়ার দিন। অনেকে চাকরি হারাত, মে দিনের মিছিল থেকে মারতে মারতে জেলে নিয়ে যেত পুলিশ, দিন আনি-দিন খাই সংসারে মজুরির অভাবে উপোস থাকতে হত একদিন। কিন্তু ওই দিন গর্বের দিনও ছিল আমাদের। কে সাচ্চা, আন্দোলনে ছেড়ে পালাবে না আর কে ভুয়ো, নিজের প্রয়োজনে আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে – পরিষ্কার হয়ে যেত জলের মতো। মালিকরা সামনে মুখ মিষ্টি করে পেছনে ছুরি মারতেন না তখন। সরাসরি পুলিশ লেলিয়ে দিতেন। শ্রেণি সংঘাত ছিল অনেক স্পষ্ট এবং অনেক প্রকট। আর এখন এই দিন হয়ে গেছে ইউনিয়নের তহবিল থেকে একদিনের বেতন নিয়ে বাড়িতে বসে ছুটি কাটানোর দিন। ইউনিয়নের নেতাদের মালিকের সঙ্গে দহরম মহরম আর বৈঠক করার দিন। আমরা, কমরেড, শ্রমের মর্যাদার জন্য চেয়েছিলাম গোটা বছরটা – পুরো ৩৬৫ দিন। তার বদলে ওরা আমাদের ১-টা দিন হাতে ধরিয়ে খুশি রাখতে চাইছে। দোহাই আপনার, রাশিয়াতে যখন ফিরবেন, এই সত্য কখনও ভুলে যাবেন না, যা আমরা ভুলে গেছি। মে দিন নতুন লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার দিন, ঘরে বসে ছুটি কাটানোর দিন নয়।’

উপরের শ্রমিক নেতাটির বক্তব্যের বিরুদ্ধে বর্তমান অনেক পাঠক-ই প্রতিবাদ করবেন। অনেকেই বলবেন, অনন্তকাল ধরে আত্মত্যাগ করে যাওয়াই কি শ্রমিক আন্দোলন নাকি ? দীর্ঘ দিন ধরে বহু লড়াই আর বহু ত্যাগে মে দিনের কর্মবিরতি আদায় করেছে শ্রমিকরা। তা উপভোগ করার মধ্যে অন্যায় কি আছে ? একেবারেই অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু ওই শ্রমিক নেতা কোলনতাই-কে যা বলেছিলেন, তার মূল নির্যাসে কি একেবারেই সত্যি কথা কিছু নেই ? মে দিন থেকে লড়াইয়ের শপথ ঝালিয়ে নেওয়ার অংশ কি বাদ পড়েনি ? আজও যখন মে দিবস পালিত হয়, ক’জন জানেন তার ইতিহাস ? ক’জন জানেন হে’মার্কেটের শহিদদের কাহিনী ? ক’জন জানেন কত আত্মত্যাগ ও আন্দোলনের ফলে মালিকদের মুঠো থেকে বার করা সম্ভব হয়েছিল এই একটি দিন ? মে দিন কি তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে নিছক একটি ছুটির দিনেই পর্যবসিত হয়নি ?

প্রশ্নগুলি কঠিন। কিন্তু এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। বিশেষ করে যখন আমাদের বাস এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে শ্রমের শক্তি পুঁজির সামনে ভয়ংকর দুর্বল, অসহায় ও বিক্ষিপ্ত। যে সংগঠিত শিল্প শ্রমিকরা একদিন পুঁজির গলায় পা রেখে নিজেদের দাবী আদায় করতে পেরেছিলেন, অর্থনীতির চরিত্র বদলানোর ফলে সংখ্যায় ও প্রভাবে তাঁরা এই একুশ শতকে আর পূর্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ নন। শিল্প শ্রমিকদের অবশিষ্ট যে অংশ এখনও রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের পূর্ববর্তী শতকে অর্জিত অধিকারগুলি রক্ষা করতেই অধিক আগ্রহী, নতুন লড়াইয়ে যেতে নয়। এ খুবই স্বাভাবিক। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তাঁদের অবস্থানটি অভিজাত সুলভ। বিপুল অ-সংগঠিত ও ইউনিয়ন বহির্ভুত শ্রমিকদের তুলনায় তাঁরা অনেক ভালো আছেন, এই বোধটা তাঁদের আছে। যেচে কে-ই বা নিজের অবস্থা খারাপ করতে চায়, পুঁজির সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করে ? তার থেকে আপোষ করে নেওয়াই অনেক ভালো।

বর্তমান বিশ্বে পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে সক্ষম শ্রমিক শ্রেণির আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক। এঁদের সংগঠিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ। শিল্প শ্রমিকদের মতোই এঁরা কাজ করেন এক ছাদের তলায় এবং একত্রিত হয়ে। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা হল, পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা মনে করেন, একমাত্র হাতুড়ি পেটানো দৈহিক শ্রমদাতা কাউকেই শ্রমিক বলা যায়। তাঁরা যেহেতু হাতুড়ির জায়গায় কি-বোর্ড চালান আর যে শ্রমপ্রদান করেন তা বৌদ্ধিক তাই তাঁরা শ্রমিক নন। দুটিই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত কথা। কি-বোর্ড আর হাতুড়ির চরিত্রগত কোনও পার্থক্য নেই আর জীব-বিজ্ঞান দৈহিক ও মানসিক শ্রমের কোনও তফাৎ করে না, পেটে খালি থাকলে হাত ঠিক যতটা অচল হয় আর মাথাও ঝিমিয়ে যায় একই ভাবে। সাম্প্রতিক কালে পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক শ্রেণির এই অংশটির শ্রেণি চেতনা ক্রমবর্ধমান, দেশে ও বিদেশে তাঁরা সংগঠিতও হচ্ছেন। কিন্তু এখনও নিজেদের শোষিত শ্রমিক হিসেবে কল্পনা করতে তাঁদের একপ্রকার মানসিক বাধা রয়েছে। অনেকেই বরং ভয়ংকর ভাবে শোষিত হতে হতেও নিজেদের ভবিষ্যৎ মালিক বলে ভাবতেই ভালোবাসেন।

পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের সংগঠিত করার মূল সমস্যা যদি মানসিক হয়, বর্তমান অর্থনীতির শ্রমিক শ্রেণির আরেকটি বিশাল অংশ, অস্থায়ী শ্রমিকদের সংগঠিত করা আরও কঠিন বিষয়। বিগত শতক থেকে পুঁজি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেছে, যে শ্রমিকদের যদি বিকেন্দ্রীভূত করা যায়, তাহলে তাদের শোষণ করা সুবিধাজনক হবে। ডিজিটাল যুগের আগমনের পর এই তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করা হয়েছে সারা বিশ্বে। এই কারণে নতুন অর্থব্যবস্থায় অধিকাংশ শ্রম-ই বিকেন্দ্রীভূত ও অস্থায়ী। এর ফলে উনবিংশ ও বিংশ শতকে কারখানার নিচে সমাবেত শিল্প শ্রমিকদের যেমন খুব সহজেই সংগঠিত করা যেত, এই খণ্ডীকৃত ও বিকেন্দ্রীভূত শ্রমিকদের তা করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে শিল্প শ্রমিকরা আক্রমণের চেয়ে নিজেদের অর্জন রক্ষা করতে আগ্রহী, যেখানে পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা নিজেদের শ্রেণি পরিচিতি ও শ্রেণি স্বার্থ সম্পর্কেই সচেতন নন আর যেখানে শ্রমিক শ্রেণির বৃহদাংশ, অস্থায়ী শ্রমিকরা সংগঠিত ও বিক্ষিপ্ত, সেখানে লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার দিন হিসেবে মে দিনের গুরুত্ব কোথায় ? গুরুত্ব রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজির সংকট আরও তীক্ষ্ণ হচ্ছে, শিল্প শ্রমিকরা এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও অনেক স্থানে আক্রমণে যাচ্ছেন (উদাহরণ - সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেনে National Union of Rail, Maritime and Transport Workers, যা R.M.T নামে বিখ্যাত, তার দেশজোড়া সফল জঙ্গি ধর্মঘট), পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা কি-বোর্ডকে নয়া যুগের হাতুড়ি হিসেবে চিনে নিজেদের শ্রেণি স্বার্থ রক্ষায় সংগঠিত হতে শিখছেন (উদাহরণ - Google-এ ২০২১ সালে Alphabet Workers Union-এর প্রতিষ্ঠা), আর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নতুন পদ্ধতিতে চেষ্টা চলছে বিকেন্দ্রীভূত অস্থায়ী শ্রমিকদের সংগঠিত করার (উদাহরণ - ২০২০ সালে আমাদের দেশেই All India Gig Workers Union-এর প্রতিষ্ঠা)। একথা অবশ্যই ঠিক, এই নব উদ্যোগের ও প্রচেষ্টার সবগুলি-ই এখনও শৈশবে। ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রকৃতি, উৎপাদনের উপকরণের প্রযুক্তিগত বদল ও উৎপাদনের সম্পর্কের জটিলতাকে মাথায় রেখে এই প্রচেষ্টাগুলির ধরণও বদলাবে। একুশ শতকের শ্রমিক আর বিংশ শতকের শিল্প শ্রমিকের সংগ্রামের ধরণ, সংগঠনের কৌশল সব-ই আলদা হবে। শুধু বদলাবে না, বা বলা ভালো বদলাতে দেওয়া যাবে না একটা জিনিস। এই বোধ, যে মে দিন নিছক ছুটির দিন নয়। মে দিবস শ্রেণি সংঘাতের কুরুক্ষেত্রে শ্রমিকদের পুঁজির বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে শঙ্খে ফুঁ দেওয়ার দিন। এই মূল উদ্দেশ্য যদি কেউ ভুলে যান, সংগ্রামের আগুন নিভিয়ে আপোষের চাদর গায়ে জড়ান, তাহলে তাতে মে দিনেরই অপমান। তাই পুঁজি যতই বাকি ৩৬৪ দিন কেড়ে নিতে এই একটা দিন ভালো মানুষ সেজে শ্রমকে সেলাম ঠোকার চেষ্টা করুক, যতই করমর্দনের জন্য হাত বাড়াক, সেই হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বছরের বাকি দিনগুলিতে লড়ার জন্য কোমর বাঁধাই মে দিবসের ঐতিহাসিক দাবী।         

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in