'যদি গুন্ডামি দিয়ে ভোট হয় তাহলে গুন্ডারা নেতা হয়। মমতা ব্যানার্জি বলতেন তিনি গুন্ডা কন্ট্রোল করতেন। তারই এক আনকন্ট্রোলড গুন্ডাকে এখন বিজেপি কন্ট্রোল করছে।' বুধবার সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা জানালেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম।
এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সেলিম বলেন - নির্বাচনে এক পর্বে ভোট হয়েছে। আগামীকাল আরও একটি পর্ব। অবাধ, সুস্থ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যাতে হয় তাঁর দায়িত্ব কমিশনের। নির্বাচন অবাধ করানোর দায়িত্ব কমিশনের। রাজ্যের গণতন্ত্রকে সন্দেহাতীত করে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এটা একটা অগ্নিপরীক্ষা। বিজেপি যেরকম বাংলার মাঠ ঘাট তাঁর সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল নেতাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করেছে তেমনই রাজ্য সরকারও একইভাবে যেভাবে তাঁর শক্তির নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে এ রাজ্যের মানুষ তার অবসান চাইছে। যে ক'পর্বের নির্বাচন বাকি আছে সেখানে এই সমস্ত কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে তাঁর নিশ্চয়তা আমরা চাইছি কমিশন, বাহিনী, পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে। সামান্য একটা অপরাধীকে ধরতে পুলিশ প্রশাসনের হাত পা কাঁপছে। এটা কাম্য নয়।
মিডিয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন সিপিআই(এম) নেতা বলেন - গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচার মাধ্যমের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। কিন্তু যেভাবে সংবাদ পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে, কিছু ওপিনিয়ন পোল, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিথ্যার বেসাতি যেভাবে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে তা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করবো। স্পনসর্ড প্রোগ্রাম এই সময় যত কম হয় তত ভালো। যাদের গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হবার কথা তাদের এই ভূমিকা এটা নির্লজ্জভাবে প্রমাণিত।
নির্বাচনে টাকা, নেশার সামগ্রী ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন - আমাদের রাজ্যে এখন উত্তর ভারত পশ্চিম ভারতের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা, নেশার সামগ্রী বিতরণ আগে ছিলোনা। কোকেন সেবীরা, ২০ টাকার পাউচে ভোট কেনার লোকেরা এখন সক্রিয় হয়েছে। এখানে এখন বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হচ্ছে। কিছু জায়গায় নাকা চেকিং হচ্ছে। কিন্তু হেলিকপ্টার চেক করার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি আরও বলেন - বেআইনি অস্ত্রের মজুত ভান্ডার বাজেয়াপ্ত করা উচিত। কদিন আগেই বর্ধমানে ফেলে রাখা বোমা থেকে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আমরা এরকম দেখেছি। একদিকে তৃণমূল বলছে খেলা হবে, বিজেপি বলছে খেলা হবে – আর এই খেলার জেরে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের। চোর জোচ্চোরদের নাটকে নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণ যাচ্ছে।
বিজেপি প্রার্থীদের প্রতি কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য বলেন - গত কয়েক পর্যায়ে যে মনোনয়ন জমা হয়েছে সেখানে দেখা গেছে বেশ কিছু বিজেপি প্রার্থীর এফিডেভিট সময়মত আপলোড করা হচ্ছে না। একদম শেষ মুহূর্তে এই এফিডেভিট আপলোড করা হচ্ছে। এটা আমি নির্দিষ্ট করে বলছি। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে? আমরা এই বিষয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানাবো।
নির্বাচনে ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার প্রসঙ্গে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন - ধর্মীয় আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মের নামে ভোট চাওয়ার রীতি এই রাজ্যে ছিলো না। কিন্তু এখন সেটাও দেখা যাচ্ছে। জাতিগত ধর্মগত বিষয়গুলো নিয়ে যেভাবে তৃণমূল বিজেপি রাজনীতি করছে তা বন্ধ করা উচিত। এর বিকল্প হিসেবে আমরা বাম কংগ্রেস আইএসএফ জোটকে সমর্থন করার আবেদন জানাচ্ছি।
এদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ সেলিম বলেন – আজকে বাংলার মানুষ সংযুক্ত মোর্চার সঙ্গে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। নতুন প্রজন্ম তাঁরা বুঝতে পেরেছেন লোকসভা ভোটের সময় কীভাবে ঠকবাজি হয়েছে। কিন্তু মানুষ এখন অনেক বেশি সজাগ ও সতর্ক। মিডিয়াকে বলবো স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে মানুষের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করুন।
নন্দীগ্রাম কান্ডে মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রতিক স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন – গতকাল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যা তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও তিনি বলেছিলেন। সেই কথাই এখন প্রমাণিত হয়েছে। ওই সময় অনেক কথাই বলা হয়েছিলো মিডিয়ায়। মমতা ব্যানার্জি তো এতদিন নন্দীগ্রামে ছিলেন। একটাও প্রমাণ দেখাতে পারতেন তো। যে মিথ্যা তখন বলা হয়েছিলো, আজও যে মিডিয়া সেই মিথ্যাকে তুলে আনতে চায় এর পেছনে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থটা বোঝা যায়। আর এখন যে অপরাধীর নাম মমতা ব্যানার্জি নিয়েছেন তাঁকে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাহারা দিচ্ছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম জানান - যে তৃণমূল কংগ্রেস জন্মের সময় থেকে বিজেপির কোলে বেড়ে উঠেছে, বিজেপির সহায়ক হয়েছে সেই তৃণমূল সংযুক্ত মোর্চা নিয়ে কী বলছে তাতে কিছু যায় আসে না। এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের কথার কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক কালও ছিলো, আজও আছে এবং আগামীদিনেও থাকবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সিপিআই(এম) নেতা বলেন - গোধরাকে ব্যবহার করে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর এবার মমতা ব্যানার্জি গোত্র ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হতে চাইছেন। বিজেপি এবং তৃণমূল এবারের লড়াইকে সফট হিন্দুত্ব এবং হার্ড হিন্দুত্বের মধ্যে নিয়ে যেতে চাইছে প্রথম থেকে। তৃণমূল বিজেপি কেউ বেকার সমস্যা, অর্থনীতির সমস্যা, কৃষকদের সমস্যা, মানুষের সমস্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে কিছু বলে না। মমতা ব্যানার্জি এখন মা মাটি মানুষ ভুলে গেছেন। এখন তিনি গোত্র নিয়ে পড়েছেন। এই রাজনীতি আসলে বিভাজনের রাজনীতি, বিভ্রান্তির রাজনীতি। একদিকে মীনাক্ষী যখন কাজের কথা বলছে তখন তৃণমূল বিজেপি এই বিভ্রান্তির, বিভাজনের রাজনীতি করেছে। যার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন - নন্দীগ্রামে যা যা হয়, হয়েছে তারজন্য তৃণমূল এবং বিজেপি – অর্থাৎ প্রাক্তন তৃণমূল উভয়েই দায়ী। ১৮-র পঞ্চায়েত, ১৯-এর লোকসভা ভোটে শুভেন্দু ও মমতা একসাথে মিলে এই কাজটা করেছে। সমস্ত গুন্ডাদের, ভোট লুটেরাদের রিক্রুট করে এইসব কাজ করেছে। রাজ্যে তো তৃণমূলের সরকার ছিলো। কিন্তু রাজ্যের সমস্ত রিসর্ট, গেস্ট হাউস, হোটেল কিছু নামধারী, কিছু বেনামধারী প্রচারকের নামে ভরে আছে। কী করছিলো মমতা ব্যানার্জির পুলিশ। দিল্লিতে যিনি হিংসা সংগঠিত করেছিলেন তিনি তো তৃণমূলের মালিকানার আরামবাগের গেস্ট হাউসে গত কয়েক মাস ধরে আছে। পুলিশ জানে না? সাংবাদিকরা জানেন না? জেলা পুলিশ, নির্বাচন কমিশন কেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকবে?
নির্বাচনে গুন্ডামি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন - মূল্যবোধ, বিবেক গত দশ বছর ধরে রাজ্যে আরএসএস ভেঙ্গেছে তৃণমূলকে দিয়ে। কেনা এবং বেচা হয়েছে সাংবাদিকদের বিবেক, সম্পাদকদের বিবেক, বুদ্ধিজীবীদের বিবেক। বিভিন্ন পেশার মানুষের বিবেক কেনাবেচা হয়েছে। কিন্তু মানুষ এখনও বিবেকবান। ভোট রাজনীতির ভোট, অর্থনীতির ভোট। খুব কম লোকই আছে যারা তোলাবাজির টাকায়, জালিয়াতির টাকায়, বিজেপির টাকায় পেট্রোল, গ্যাস কিনতে পারে। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ভোট দেবে। বাড়ির বেকার ছেলেটাকে দেখে ভোট দেবে। দশ বছর ধরে যে জালিয়াতি হয়েছে তা দেখে ভোট দেবে মানুষ। যে সাংবাদিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে খুনী সাজিয়ে এম পি হয়ে জেল খেটে এখন মুখপাত্র হয়েছেন তাঁকে দেখে মানুষ ভোট দেবেনা।
রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন - নির্বাচন কোনো ব্যক্তির খেলা নয়। এটা টিমের খেলা। শুধু ক্যাপ্টেন খেলে না। এইজন্যেই সংযুক্ত মোর্চা। তাতে পুরোনো খেলোয়াড়দের সঙ্গে টগবগে তাজা খেলোয়াড় এসেছে। রাজনীতির পরিভাষায়, অর্থনীতির পরিভাষায় কথা বলতে হয়। বেকাররা যখন কাজের কথা বলছে তখন মিডিয়া খেলার কথা বলছে। যখন চিটফান্ডের টাকা ফেরত দেবার কথা বলছে তখন বলছে খেলা হবে। এবারের ভোটে কার টীমে কে আছে বোঝা যাচ্ছে না। এখনও পর্যন্ত বিজেপি বিজেপি করে এরকম ২০০ প্রার্থী খুঁজে পায়নি। এদের হয়ে খেলছে কিছু টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজ। সংযুক্ত মোর্চা বিকল্প নীতি নিয়ে বিকল্প সরকার গঠন করবে।
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।