বাংলাদেশে উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের বিভ্রান্ত হিসাব

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশেও রাজনৈতিক জটিলতা পিছু ছাড়ছে না। যে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অর্ধশতক পরও সেই স্বপ্ন অধরাই আছে।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীএডিবি ব্লগের সৌজন্যে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনা-বৈষম্য ও অসমতা হ্রাস করা। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশের অর্থনৈতিক উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হতো। কৃষি ও শিল্পসহ সব ধরণের উৎপাদন বেশি হতো পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। তথাপি এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল কতিপয় ধনিকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান)। ফলে পূর্ব-পাকিস্তানে কৃষি ও শিল্পসহ অন্যান্য উৎপাদন হলেও তা চলে যেতো পশ্চিম-পাকিস্তানে। এই অঞ্চলের মানুষ নিজেরা উৎপাদক হয়েও সারা বছর অনাহারক্লিষ্ট দরিদ্র জীবনযাপন করতো। এই যে বৈষম্য-বঞ্চনা-অসাম্য তার মূলে ছিল লুটেরা ধনিক শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। যারা পরিচালিত হতো কতিপয় ধনিক শ্রেণির স্বার্থে। পাকিস্তান রাষ্টের এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের পিছনের কারণ ছিল রাজনৈতিক সংকট। শুরু থেকেই রাষ্ট্রটি ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতার দরুণ রাজনৈতিক ক্রাইসিসে পতিত হয়। এর ফলে গোটা দেশের রাজনীতিই ছিল সংকটাপন্ন ভঙ্গুর। ফলে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব সময় রাজনৈতিক বিক্ষোভ, দমন-নিপীড়ন, দাঙ্গা লেগেই থাকতো। মানুষের মনে ক্ষুব্ধতা ছিল পাহাড়সম। একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য-বঞ্চনা-অসাম্য, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকট। একটি সংকট অন্য আরেকটি সংকটের কারণগুলো উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করে চলছিল। যার ফল হয় আপোষে সংকট সমাধানের পথবন্ধ এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশেও রাজনৈতিক জটিলতা পিছু ছাড়ছে না। যে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অর্ধশতক পরও সেই স্বপ্ন অধরাই আছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে তার কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীনতা উত্তর সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি করা হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়বাদ। স্বাধীনতার পর থেকে যে বা যারাই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে এসেছে তাদের কেউই উক্ত চারটি মূলনীতির উপর আর্দশিক বিশ্বাসে ও কর্মপ্রচেষ্টার পূর্ণ আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। এমনকি উক্ত মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জন-আস্থাও অর্জন করতে পারেনি। এসব অনেক পুরনো আলাপ। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হলো দেশে গণতন্ত্রহীনতা, উগ্র-মৌলবাদ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি। রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অন্য সব সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। যার ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এদেশে দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। কতিপয় ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পত্তি জমা হয়েছে। দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, দুর্নীতি গোটা দেশের সব ক্ষেত্রে জেঁকে বসেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এদেশে দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। কতিপয় ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পত্তি জমা হয়েছে। দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, দুর্নীতি গোটা দেশের সব ক্ষেত্রে জেঁকে বসেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে (৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮) যে পার্লামেন্ট গঠন করা হয়েছে সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য যে ধরণের কার্যকরী বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন সেটাই নেই। সংসদে যেমন শক্ত কোনো বিরোধী দল নেই তেমনি মাঠের রাজনীতিতেও বিরোধী দলের অবস্থান নেই। যা আছে নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটা হচ্ছে লুটপাটের অর্থনীতি। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। বৈশিষ্ট্যগত কারণেই দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস না করে কেবল প্রলেপ দিয়ে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করে চলছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটা হচ্ছে উন্নয়নের চুইয়ে পড়া তত্ত্ব (trickle down theory)। যার ফলে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বাংলাদেশে দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে বলা হলেও আসলে আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। বাংলাদেশের ‘দরিদ্র পরিমাপক যন্ত্র’ হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও আইএফএম প্রদত্ত সূত্র। যেখানে কেবল মানুষের খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যে ২১২২ কিলো-ক্যালোরি আছে কি না সেটাই বড় বিবেচ্য। বাংলাদেশের এই থিওরিতেও ধনবৈষম্য, আয়বৈষম্য, মানুষের হাহাকার, দুর্নীতির মহামারি চিত্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাফিয়ার চিত্র আড়াল করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হচ্ছে প্রায় ২১শ’ ডলার। এই হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিস্ময়কর। কিন্তু এই যে ২১শ’ ডলারের হিসাব সেটা প্রত্যেক মানুষের পকেটে আছে কি? এটাই হচ্ছে খাঁটি প্রশ্ন। সাধারণ মানুষ সরকারের উন্নয়নের প্রচারপত্রে দেখছে তার মাথাপিছু আয় ২১শ’ ডলার কিন্তু তাদের বিশ্বব্যাংক ও আইএফএম এর হিসাবে তাদের দৈনিক আয় ৬৭ টাকার বেশি, দৈনিক খাদ্য গ্রহণে ২১২২ কিলো-ক্যালোরি থাকলেই তারা দরিদ্র নয়। তাহলে যারা দৈনিক ৬৭ টাকার বেশি আয় করে ও ২১২২ কিলো-ক্যালোরি খাদ্য গ্রহণ করছে তারা দরিদ্রসীমার উপরে বাস করছে কিন্তু তারা কি সরকারি হিসেবের ২১শ’ ডলার নিজের ভাগে পেয়েছে? তারা পায়নি। যার ফলে বাংলাদেশের বর্তমানে যে ধরণের উন্নয়নের বয়ান সামনে আনা হচ্ছে সেটা বুঝনেওয়ালা মানুষের কাছে বিশ্বাস যোগ্য নয়। এমনকি দরিদ্রসীমার নিচে বাসকারী জনসংখ্যার হিসাব নিয়ে যে উন্নতির আলাপ করা হচ্ছে সেটাও দিন শেষে সত্য নয়। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত হিসেব করে দেখাচ্ছেন যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের বিষয়ে সরকারি যে হিসেব সামনে আনা হচ্ছে সেটা হচ্ছে বিকল্প সত্য যা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করছে। সরকারি হিসাব মতে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ ছিল ৫৫.৭ শতাংশ। ২০০৪ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৪০.৪ শতাংশে নেমে আসে এবং ২০১০ সালে এসে দাঁড়ায় ৩১.৫ শতাংশ। ত্রিশ বছর আগে যখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ তথা ৩ কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করতো। ত্রিশ বছর পর দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে ৩২ শতাংশ মানুষ। মোট জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় ৫ কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। (বারকাত : ২০১৬)

অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য এতো পরিমাণ হয়েছে যে, ক্ষুদ্র একটা শ্রেণির হাতে বিপুল সম্পত্তি জমা হয়েছে। অপরদিকে জনসংখ্যার বৃহৎ একটা অংশ ক্রমে দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্রতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যে অসমতা-বৈষম্য বিরাজ করছে এর সৃষ্টি মূলত রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশে লিবারেল ইকনোমিক পলিসি গ্রহণ করা হয়। এরপর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানে আমলে (৭ নভেম্বর ১৯৯৫-১৯৮১) ১৯৭৮ সালে নিও-লিবারেল ইকনোমিক পলিসি গ্রহণ করা হয়। ১৯৮২ সাল থেকে আরেক সেনাশাসক এইচএমন এরশাদের সময় এই নিও-লিবারেল ইকনোমিক পলিসির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদেশী ঋণ-সহায়তা নির্ভর একটি রাষ্ট করে তোলা হয়। দেশীয় শিল্প-কারখানাগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএফএম’র প্রেসক্রিপশন মেনে দেশ পরিচালনা শুরু হয়। বাংলাদেশ এখনও সেই প্রেসক্রিপশন থেকে বের হতে পারেনি। যার ফলে সেই থেকে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়তে বাড়তে হিমালয় পর্বতসম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য এতো পরিমাণ হয়েছে যে, ক্ষুদ্র একটা শ্রেণির হাতে বিপুল সম্পত্তি জমা হয়েছে। অপরদিকে জনসংখ্যার বৃহৎ একটা অংশ ক্রমে দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্রতে পরিণত হয়েছে। কোন দেশে অর্থনীতিতে বৈষম্য কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটার পরিমাপক হচ্ছে জিনি সহগ পদ্ধতি। একটি দেশের অর্থনীতির জিনি সহগ যখন ০.৫ এর কাছাকাছি কিম্বা সেটাকে অতিক্রম তখন সে দেশকে বলা হয় চরম আয়বৈষম্যের দেশ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল ০.৩৩; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে ২০১৬ সালে খানা আয় ও ব্যয় জরিপ হিসাবে সেটা বেড়ে ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ‘ওয়াল্ট আলট্রা ওয়েলথ রির্পোট-২০১৮’ এ বলা হয়েছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি-ধনি বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বের এক নম্বর দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই পাঁচ বছরে দেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে মাত্র ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্যগোষ্ঠীর হাতে ব্যাপক সম্পদ জমা হয়েছে। ২০১০ সালে দরিদ্র ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় ছিল জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা হ্রাস পেয়ে ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে ১০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীল আয় ছিল জিডিপি’র ২ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা হ্রাস পেয়ে ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। অপরদিকে ২০১০ সালে ১০ শতাংশ ধনাঢ্যের হাতে সম্পত্তি ছিল জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০১০ সালে অতি-ধনীশ্রেণির হাতে সম্পদ ছিল জিডিপি’র ২৪.৬১ শতাংশ; ২০১৬ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৮৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এই যে গুটিকত মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পত্তি পুঁঞ্জিভূত হচ্ছে এর প্রভাব পরছে সর্বক্ষেত্রে। শিক্ষা, চিকিৎসা, রাজনীতি, প্রশাসন সব ক্ষেত্রেই এই শ্রেণির আধিপত্য বাড়ছে। অপরদিকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো ক্রমে প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। (সাদিক : ২০২১)

বাংলাদেশে ক্রমে কোন প্রক্রিয়ায় বৈষম্য-বঞ্চনা ও দারিদ্র্য সৃষ্টি হচ্ছে সে বিষয়ে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম ১২টি ডাইমেনশনের কথা উল্লেখ করেছেন। যথাক্রমে : ১. দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র কৃষি ব্যবস্থা (agrarian system), ২. ক্রমবর্ধমান বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, ৩. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বাজারিকরণ, ৪. সরকারি রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উদ্বৃত্ত আহরণ ও উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ, ৫. ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের সঞ্চয়কে উচ্চবিত্ত জনগণের খেদমতে পাচার, ৬. বৈদেশিক ঋণ/অনুদান আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ৭. কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অব্যাহত ব্যর্থতা, ৮. আমদানি উদারীকরণ ও চোরাচালান এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের উপর এগুলোর মিলিত প্রভাব, ৯. সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার রাজধানী-কেন্দ্রীকতা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এর ফলে সৃষ্ট বঞ্চনা, ১০. স্থানী সরকার ব্যবস্থার অকার্যকরকরণ ও বি-ক্ষমতায়ন (disempowerment), ১১. রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং ১২. রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা (governance failure) এবং সুশাসনের অভাব। (ইসলাম : ২০০৯)

বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের হিসাবটি খুবই ফাঁকিপূর্ণ। কারণ দারিদ্র্যের হিসাব কষতে গিয়ে নাগরিকদের চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পেশাগত বৈষম্য, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোকে আমলে নেওয়া হয় না। অথচ উক্ত বিষয়গুলো সমাজে দারিদ্র্যের হার চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়িয়ে চলছে। অধ্যাপক বারকাত বাংলাদেশের দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা ও বঞ্চনার অন্যতম একটি উৎসব হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘রেন্ট সিকিং’ ব্যবস্থাকে। (বারকাত : ২০১৬) বাংলাদেশে বৈষম্য ও উন্নয়নের হিসেবে এই রেন্ট সিকিংকেও ধর্তব্যে রাখা হয় না। যার ফলে দেশে দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করলেও মাথাপিঁছু আয় ও জিডিপি হুহু করে বাড়ছে। কারণ বাজার অর্থনীতিতে দুর্নীতির টাকা যদি বাজারে থাকে তাহলে সেটাও জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু সেটা ক্রমে সম্পত্তিকে গুটি কতক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত করে ফেলে। যার ফলে দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য ও অসমতা ক্রমবর্ধমান থাকে। বাংলাদেশে এই কাজটিই হচ্ছে। উন্নয়ন যেটা হচ্ছে তা সাধারণ মানুষের নয় কতিপয় মানুষের। পরিস্থিতির উন্নয়ন বলতে আসলে যা হয়েছে সেটা হচ্ছে, আগে একজন ভিক্ষুক খালি গায়ে ভিক্ষা করতো এখন সে পোশাক পড়ে ভিক্ষা করছে।

উপরোক্ত দারিদ্র্য বিমোচন হিসেবে যেমন পসিংখ্যানগত উন্নয়ন বাদে প্রকৃত দারিদ্র বিমোচন হয়নি রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশে সরকারি দল, বিরোধীলসহ অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। সব দলই ক্ষমতায় থাকাকালে তথাকথিত উন্নয়নের বয়ান সামনে এনে রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়ন, লুটপাট, দুর্নীতি, সুশাসন ও গণতন্ত্রহীনতাকে আড়াল করে। এমনকি সরাসরি এই প্রশ্নই তোলা হচ্ছে যে উন্নয়ন চাই না কি গণতন্ত্র চাই? এই প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মুখোমুখী অবস্থান বিপরীত রূপ বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে যে উন্নয়ন চাইলে ‘কম গণতন্ত্র’ মেনে নিতে হবে। এর ফলে দেশে আইনের সুশাসন যেমন প্রায় নেই বললেই চলে অন্যদিকে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটাও ক্রমে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা অধিক হারে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করছে। সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সম্পত্তি ক্রমে ছোট একটি অংশের হাতে পূঞ্জিভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়।

তথ্যপঞ্জী :

বারকাত, আবুল, (২০১৬), বাংলাদেশের দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতার কারণ-পরিণাম ও উত্তরণ সম্ভবনা : একীভূত রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বের সন্ধানে, মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা, ঢাকা।

সাদিক, জি. কে. (২০২১, ২৭ জানুয়ারি), স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বৈষম্য নিরসনে কাজ করতে হবে, দৈনিক বাংলাদেশের খবর, ঢাকা।

Islam, M. (2009), The Poverty Discourse and Participatory Action Research in Bangladesh, Research Initiatives, Bangladesh (RIB), Dhaka.

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in