বাংলাদেশে এক মহিলা সাংবাদিককে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলার অপবাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে নিপীড়ন ও তার নামে মামলা দায়েরের ঘটনায় দেশ জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে। গত ১৭ মে দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সংবাদ সংগ্রহের কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে তাকে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলা ও লুকিয়ে ফটো তোলার অপরাধে টানা ৬ ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পরে শাহবাগ থানায় পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।
টানা নির্যাতনের ফলে রোজিনা ইসলাম অসুস্থ হয়ে পরেন। তাকে চিকিৎসার হাসপাতালে নেয়ারও সুযোগ দেয়া হয়নি। রাতভর থানায় আটক রেখে সকালে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় তাকে হাতকড়া পড়িয়ে বিশাল পুলিশি প্রটোকলের মধ্যে রাখা হয়। আদালতের কাছে রিমান্ড দাবি করা হলে আদালত তা খারিজ করে তার জামিন নামঞ্জুর করেন।
এই ঘটনায় ইতোমধ্যে সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ করা হয়েছে। ঘটনার দিন রাতভর সাংবাদিকরা শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। প্রতিবাদ স্বরূপ সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে কোন ধরণের সংবাদ সম্মেলন বয়কট করার ডাক দিয়েছেন। এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের বিচার দাবি করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এছাড়াও সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গত কিছুদিন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর করেন। যেখানে স্বাস্থ্যখাতে বড় ধরণের কিছু দুর্নীতি ও অনিময়মের ঘটনা প্রকাশিত হয়। এনিয়ে সারাদেশে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু নিয়োগ ঘিরে ব্যাপক হারে ঘুষ লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে আলোচনার সৃষ্টি করে দেন। এই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ মে তিনি সংবাদ সংগ্রহের জন্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তাকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ও গোপনে ফটো তোলার অভিযোগে আটক করে নির্যাতন চালানো হয় এবং টানা ৬ ঘণ্টা নির্যাতনের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়। রাতে তার নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
রোজিনা ইসলাম তার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও জার্মান ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক বেশ কয়েকবার পুরষ্কার প্রাপ্ত।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হয়রানির এই ঘটনা নতুন কিছু হয়। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৫ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে হত্যার শিকার হয়েছেন। অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় বিচার না হওয়ার ফলে ক্রমেই নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে। এমনকি আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন পিছিয়েছে ৭৮ বারের মতো। ২০১২ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি এই হত্যার পরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিনে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেফতার করা হবে। ঘটনার ৯ বছর গড়ালেও এখনও তদন্ত প্রতিবেদনই পেশ করা হয়নি। এই ঘটনা নিয়ে সারাদেশে সাংবাদিকতা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ মুখোর হলেও তা ছিল খুবই ক্ষীণ। আলোচিত এই হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও সাংবাদিকরা তেমন কোনো জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
একইভাবে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দু গোষ্ঠীর সংঘর্ষে সিরাজগঞ্জে প্রাণ হারান দৈনিক সমকালের জেলা প্রতিনিধি আবদুল হালিম শিমুল। গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই ঘটনা নিয়েও সাংবাদিক সংগঠনগুলো তেমন কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন করেনি। যার ফলে ক্ষমতাসীনদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলছে। দৈনিক মানব জমিনের ফটো সাংবাদিক কাজলের ঘটনা নিয়ে দেশে বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও তাকে নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও সাংবাদিকরা তেমন প্রতিবাদ করেনি। এছাড়াও সম্প্রতি গত ৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে লেখক মুশতাক হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সারাদেশে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠলেও সাংবাদিক সংগঠনগুলো মুখে কুলুপ এটে ছিল। এভাবে প্রত্যেকটি ঘটনা নিয়ে নীরবতাই সাংবাদিকদের উপর নিপীড়নের মতো ঘটনা বারবার হচ্ছে।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমে সংকট নিয়ে সবাই সচেতন, সবাই বিষয়টি জানেন। সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মোটামুটি সব সাংবাদিকই ফেইস করছে কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও সাংবাদিক নেতারা সব সময়ই নীরব ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে যা ঘটেছে সেটা নিয়েও এখন পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। অনেক সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে তার মধ্যে গুটিকত বাদে আর কেউ ঘটনাটি নিয়ে এখনও মুখ খুলেনি। সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন, নিরবতা ও দলীয় স্বার্থে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়ার ঘটনায় সাংবাদিকদের জন্য গোটা পরিবেশই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর একই সংকটের পিছনে রয়েছে সংবাদমাধ্যমের মালিকানার সমস্যা। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে মিডিয়া হাউজ করে টাকা দিয়ে কিনে সাংবাদিকদেরকে স্বার্থের কাজে ব্যবহার করা। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর মালিকানা সাংবাদিকদের হাতে নেই। তারা সেখানে বেতনভুক্ত কর্মচারী মাত্র। যার ফলে সংবাদ প্রকাশে ও ট্রিটমেন্ট নিয়ে তাদের স্বাধীনতা খুবই কম।
গত ২৬ এপ্রিল ঢাকার গুলশানে একটি ফ্লাট থেকে মুসারাত জাহান মুনিয়া নামে কলেজ পড়ুয়া এক তরুণীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি ও মালিকের ছেলে আনভীরের নামে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে থানায় মামলা করে। ঘটনাটি প্রথমে সংবাদমাধ্যমে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি ছড়িয়ে পরলে পরে তখন সংবাদমাধ্যমগুলো আর চেপে যেতে পারেনি। কিন্তু তারা প্রথমে যে নিউজ করে সেখানে প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যমেই এই ঘটনায় অভিযুক্তের নাম ও প্রতিষ্ঠানে নাম উল্লেখ করেনি।
নিউজের ভাষ্য ছিল, ‘প্রভাবশালী এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এমডির বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ।’ এমন নিউজের বিষয়ে যখন সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা ও জোর প্রতিবাদ শুরু করে তখন দুয়েকটা সংবাদমাধ্যম নাম প্রকাশ করে নিউজ করে। এই ঘটনা নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি সংবাদমাধ্যমের- তিনটি দৈনিক পত্রিকা, একটি টিভি চ্যানেল ও একটি রেডিও স্টেশন- একটিও মুখ খুলেনি।
বেশ কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এই ঘটনা নিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং করে নিহতের পরিবার ও তার চরিত্র হনন করতে কোমর বেঁধে লেগে পরে। এই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মালিকানা ও সাংবাদিকদের নৈতিকতা বিষয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যেগুলো নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো অকল্পনীয় নীরবতা প্রদর্শন করে।
প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে যা ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীনরা সংবাদমাধ্যমের উপর যে খড়গহস্ত হয়েছে এই ঘটনা তারই প্রকাশ। এই ঘটনা বহু আলামতের একটি মাত্র। সাংবাদিকরা যতো তাড়াতাড়ি এই আলামত বুঝতে পারবে ততই ভালো।
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।