অমর একুশে ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হল ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বে ভর করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতারাতি নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেলেন। বিশ শতকের তিনের দশক থেকে যে সাম্প্রদায়িক বৃক্ষ ক্রমে মাথা চাড়া দিচ্ছিল, তা অন্তিম পরিণতি পেল।
অমর একুশে ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি
ফাইল ছবি, সংগৃহীত
Published on

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভাগ হল ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভর করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতারাতি নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেলেন। বিশ শতকের তিনের দশক থেকে যে সাম্প্রদায়িক বৃক্ষ ক্রমে মাথা চাড়া দিচ্ছিল, তা তার অন্তিম পরিণতি লাভ করল। যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের বিরুদ্ধে ক্রমে সোচ্চার হচ্ছিল। দেশভাগ তাঁদের মধ্যেও এনে দিল হতাশা। তাঁদের পক্ষে এই বিভাজিত স্বাধীনতা মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। ১৯৪৮ সালের কলকাতা কংগ্রেসে গৃহীত হল রণদিভে থিসিস। এই থিসিস অনুসারেই স্লোগান উঠল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হে !’। এই লাইন অনুসারে মনে করা হল যে ভারত আদৌ স্বাধীন হয় নি, যা হয়েছে তা হল ব্রিটিশ কর্তৃক মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই লাইনে লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে বিপ্লবাত্মক সশস্ত্র সংগ্রামের নীতি গৃহীত হল। ঠিক হল, পার্টি ভাগ করা হবে এবং প্রত্যেক অংশের কমিউনিস্ট পার্টি সেই দেশে এই নীতির প্রয়োগ ঘটাবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ৬ই মার্চ কলকাতার সম্মেলন শেষে পাকিস্তান থেকে আগত প্রতিনিধিরা আলাদা করে এক কংগ্রেসে মিলিত হন এবং গঠন করেন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অংশ হিসেবেই গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। সম্পাদক হন খোকা রায়। এই পার্টির প্রধান নেতারা ছিলেন মণি সিংহ, কৃষ্ণ বিনোদ রায়, ফণী বাগচি, মনসুর হাবিব, নেপাল নাগ, মারুফ হোসেন, আব্দুল কাদের চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই পার্টি রণদিভে লাইনের অনুসরণে পূর্ব বঙ্গের বহু স্থানে সংগ্রামী সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলে – মণি সিংহ ময়মনসিংহে, ইলা মিত্র নাচোলে সশস্ত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫১ সালে অবশ্য দল এই অবস্থান থেকে সরে আসে। বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশে কমিউনিস্টদের উপর নেমে এসেছে অকথ্য দমন-পীড়ন। তাঁদের ভারতের এজেন্ট বলে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী চিহ্নিত করে চলেছে।

একুশে, অমর একুশের যে সংগ্রাম – সে বিশেষ কোন দলের সংগ্রাম অবশ্যই নয়। এই সংগ্রাম বাঙালির সংগ্রাম, বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। কিন্তু অত্যন্ত সচেতন ভাবে এই সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে মুছে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা বর্তমান, যা কখনই কাম্য নয়।

কমিউনিস্টরা যখন এই লড়াই চালাচ্ছেন, তখন নব গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিরোধ ও বিতর্ক ক্রমে অন্য মাত্রা লাভ করছে। ক্রমশ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জোরদার হচ্ছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে মহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ভাষণে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে নাকচ করে যখন বলেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি, তা হল উর্দু…’ তখন তাকেই ছাত্রদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। এই সময় এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টেট ল্যাঙ্গোয়েজ মুভমেন্ট’ গড়ে ওঠে, তার নেতৃত্বও দেন এক কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছাত্রনেতা – আব্দুল মতিন। ১৯৪৮-এর মার্চ মাস থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ধর্মঘটে ছাত্র-পুলিশ সংঘাতে ২০০ জন আহত ও ৯০০ জন গ্রেপ্তার হলেন। বেগতিক দেখে প্রথমে লীগ সরকার পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে পিছিয়ে আসে। এপ্রিল মাসের মধ্যে আন্দোলন অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায়।

ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি প্রাথমিক ভাবে একে দেখেছিল এক প্রদেশের স্বায়াত্বশাসনাধিকারের বিষয় হিসেবে। এই হিসেবে তাঁরা শুধু মাত্র বাংলা ভাষা না, পাকিস্তানের সকল ভাষার অধিকার দাবী করেন। কমিউনিস্ট পার্টির এই সময়ের একটি প্রচারপত্র থেকে উদ্ধৃতি করা যাক – ‘ইংরেজি বা উর্দু এই দুইটি ভাষার একটিকে, পাকিস্তানের বাঙালি, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচি প্রভৃতি সকল ভাষাভাষী জাতির উপর চাপিয়ে রাখাই (মুসলিম) লীগ সরকারের মতলব। কারণ পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণকে নিজ নিজ মাতৃভাষার শিক্ষালাভ ও রাষ্ট্র কার্য পরিচালনার সুযোগ না দিয়া সকল জাতিকে পশ্চাৎপদ করিয়া রাখা ও এই পশ্চাৎপদতার সুযোগে সামন্তবাদী শোষণ-ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখাই হইল ভাষার প্রশ্নে লীগ সরকারের নীতি।’ ভাষা প্রশ্নকে এর পাশাপাশি তাঁরা দেখেছিলেন পাকিস্তানের সামন্তবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নিরিখে। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মানুষকে রাজনীতি সচেতন করে তোলা সম্ভব – এই উপলব্ধিও তাঁদের হয়েছিল। বলা বাহুল্য – এই সবই তাঁদের পাকিস্তানী রাষ্ট্রের প্রবল শত্রুতে পরিণত করে।

মুসলিম লীগও কমিউনিস্ট পার্টির এই আন্দোলনকে আরও তীক্ষ্ণ ও জঙ্গি অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সচেতন ছিল। তারা বারবার প্রচার করতে থাকে ভাষা আন্দোলন হল ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘হিন্দু’-দের কারসাজী এবং দেশপ্রেমিক পাকিস্তানীদের এই ‘ফাঁদ’-এ পা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়।

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ থেকে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন ক্রমশ ধুঁইয়ে উঠতে থাকে, তার পাশে এই কারণেই কমিউনিস্টরা প্রথম থেকেই ছিলেন। ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় ও নাজিমুদ্দিনের ভাষানীতির নিন্দার পর সিদ্ধান্ত হয় ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হবে। কমিউনিস্ট পার্টি তৎক্ষণাৎ ২রা ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা ভাষার অধিকার ও সকল ভাষার সমান মর্যাদা কায়েম করুন’ শিরোনামে লিফলেট প্রকাশ করে। এতে বলা হয় – ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি যেমন – বাঙালি, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচি – প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী উন্নতি লাভ করুক, সমস্ত ভাষা যেমন – উর্দু, বাংলা, পুস্ত, পাঞ্জাবী, সিন্ধি সমস্ত ভাষাকেই রাষ্ট্রে সমান অধিকার দেওয়া হোক ইহাই পাকিস্তানবাসী সকল জাতির কাম্য। কিন্তু লীগ সরকার উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে চালু করার চেষ্টা করিয়া শুধু বাঙালির অধিকার ও কৃষ্টির উপরই আক্রমণ করিতেছেন।…তাই ’বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা ও সকল ভাষার সম-মর্যাদা দান’-পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী ব্যক্তির দাবী। এই দাবীর পেছনে বাঙ্গালি-অবাঙালি সকল জনসাধারণকে সমবেত হওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাইতেছি।‘

৪ঠা ফেব্রুয়ারি সফল ধর্মঘট শেষে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ২০শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় গণপরিষদের অধিবেশনের পরেই ২১শ তারিখ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এই দাবীর স্বপক্ষে দেড় মাইল লম্বা মিছিল ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি ও ইউনিভার্সিটি রাষ্ট্রভাষা কমিটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কমিউনিস্ট পার্টি ১১ই ফেব্রুয়ারি আবার ‘বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ করার স্বপক্ষে দাবী জানায় ও ঘোষণা করে – ‘এই দাবী বাঙালি জাতির জাতীয় অধিকারের দাবী, এই দাবী বাঙালি জাতির জন্মগত অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী। অতএব রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন বাঙালি জাতির জাতীয় অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।‘ একুশে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট সফল করার জন্যও আবেদন ব্যক্ত করা হয়। এই সময়ের পার্টির নথি থেকে আমরা জানতে পারি। কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় এই ধর্মঘটকে ঢাকা থেকে জেলায় আর সমাজের ছাত্র-মধ্যবিত্ত থেকে শ্রমজীবীদের মধ্যে ছড়াতে হবে। উর্দু ভাষীদের মধ্যেও দাবীর স্বপক্ষে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তান সরকার উর্দুভাষী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত না লাগিয়ে দিতে পারে। যে পার্টি তখনও নিষিদ্ধ, তখনও গোপনে কাজ করছে, তার প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টি এক ব্যপক পোস্টারিং-এর কর্মসূচী গ্রহণ করে। গোপন সিদ্ধান্তে বলা হয় – ‘ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য…প্রত্যেকটি পার্টি ইউনিট ও পার্টি সভ্য সম্মিলিতভাবে কার্যকরী প্ল্যান লইয়া অগ্রসর হউন…এই আন্দোলনের ভিতর দিয়া বহু কর্মী ও পার্টি মিলিট্যান্ট বাহির হইয়া আসিবেন। এই নতুন নতুন কর্মীদের পার্টি গ্রুপে সংগঠিত করা ও পার্টির নীতিতে করা ও পার্টির নীতিতে শিক্ষিত করিয়া তোলার জন্য…বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।‘

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলেন। ২০শে ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ তা নিয়ে আলচনায় দেখা গেল নেতৃত্বের অনেকেই দ্বিধান্বিত। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের কমিউনিস্টদলের প্রতিনিধি মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহাদ দৃঢ় ভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি সভা ও শোভাযাত্রার স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। তাঁদের বক্তব্য অপর দলের নেতৃত্বকেও প্রভাবিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কমিউনিস্ট ছাত্র সংগঠন ক্রমশ জঙ্গি আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করতে থাকে। মুসলিম লীগও কমিউনিস্ট পার্টির এই আন্দোলনকে আরও তীক্ষ্ণ ও জঙ্গি অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সচেতন ছিল। তারা বারবার প্রচার করতে থাকে ভাষা আন্দোলন হল ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘হিন্দু’-দের কারসাজী এবং দেশপ্রেমিক পাকিস্তানীদের এই ‘ফাঁদ’-এ পা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। ঢাকার লীগপন্থী মর্নিং নিউজে এও প্রকাশ করা হয় – ‘ভারত থেকে ১০০ জন কমিউনিস্ট পূর্ববঙ্গে এসেছে এবং…নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টরা সভা করে আন্দোলন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।‘

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। নুরুল আমিন সহ সমগ্র প্রাদেশিক লীগ মন্ত্রীসভার সদস্য তাঁদের আসন হারান। কমিউনিস্ট পার্টি দমন পীড়নের মধ্যেও চারটি আসনে জয়লাভ করে। ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলায় অনেক শক্তি ও জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হল।

অবশেষে এল সেই একুশে ফেব্রুয়ারি, ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা শহীদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ক্যাম্পাসের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আব্দুল মতিনের সভাপতিত্বে। ছাত্র পুলিশে সংঘর্ষ শুরু হয়। বেলা তিনটের পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন সালাহউদ্দীন, আব্দুল জাব্বার, আবুল বরকত, আব্দুস সালাম,রফিক উদ্দিন আহমেদ। আগুনে যেন ঘি পড়ে। ঐ দিনই কমিউনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনে নিহতদের প্রতিবাদে লিফলেট প্রকাশ করে সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী ধর্মঘট ও আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। লিফলেটে বলা হয় – ‘নিজ মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাহারা শহীদ হইয়াছেন তাহারা জাতির বুকে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। যে ঢাকা নগরী আমাদের প্রিয় শহীদদের খুন লাল হইয়া উঠিয়াছে সেই ঢাকা নগরীর বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ নুরুল আমিন সরকারের বর্বর হত্যাকান্ডের জবাব দেবার জন্য আগাইয়া আসুন।’ পার্টি আরও আহ্বান জানায় ‘আজ লীগ সরকারের পৈশাচিকতার সামনে দ্বিধা নয়, সংশয় নয়, অনৈক্য নয়। আজ শহীদগণের জীবন দান আমাদের সংকল্পকে আরও করুন। শহীদদের রক্তের বন্ধনে সকল দল, সকল মতের নর-নারীর ভিতর গড়িয়া উঠুক ঐক্য।‘ কমিউনিস্ট পার্টি শুধু কথাতেই তাদের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রাখল না দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যপক ধর্মঘটের আয়োজন করল। সরকারও তাঁদেরকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ দাগিয়ে নামিয়ে আনে ব্যপক দমন পীড়ন। অবশেষে মার্চ মাসের শুরুর দিকে এই ধরপাকড় ও সরকারী দমননীতির ফলে ভাষা আন্দোলন তখনকার মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমও।

কিন্তু এই প্রচেষ্টা একেবারে বিফলে গেল না। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ভাষ্য রাতারাতি পাল্টে যায়। ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতির স্থানে দ্রুত জায়গা করে নিতে থাকে বাঙালি ভাষা সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তায় ব্যপক ধ্বস নামে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। নুরুল আমিন সহ সমগ্র প্রাদেশিক লীগ মন্ত্রীসভার সদস্য তাঁদের আসন হারান। কমিউনিস্ট পার্টি দমন পীড়নের মধ্যেও চারটি আসনে জয়লাভ করে। ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলায় অনেক শক্তি ও জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হল। এই আন্দোলনের সুত্র ধরে উঠে এল একদল নতুন পোড় খাওয়া প্রজন্ম, যেমন আব্দুল মতিন, যিনি পরবর্তী কালে পাবনা জেলার পার্টির দায়িত্ব লাভ করেন। এই প্রজন্মই মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করবেন।

একুশে, অমর একুশের যে সংগ্রাম – সে বিশেষ কোন দলের সংগ্রাম অবশ্যই নয়। এই সংগ্রাম বাঙালির সংগ্রাম, বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। কিন্তু অত্যন্ত সচেতন ভাবে এই সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে মুছে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা বর্তমান, যা কখনই কাম্য নয়। আজ একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস স্মরণের মাঝে সচেতন ভাবে রেখে যাওয়া সেই শূন্যস্থান যদি এই প্রবন্ধ সামান্য হলেও পূর্ণ করতে পারবে এই আশা রাখি।

SUPPORT PEOPLE'S REPORTER

ভারতের প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুখী সাংবাদিকতা — যা আপনার সামনে সঠিক খবর পরিবেশন করে। পিপলস রিপোর্টার তার প্রতিবেদক, কলাম লেখক এবং সম্পাদকদের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আপনাদের মতো পাঠকদের সহায়তা। আপনি ভারতে থাকুন বা দেশের বাইরে — নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে একটি পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in