স্মরণ: চলমান জীবনে ঝরে পড়ার গল্প

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

নিভল যেই প্রদীপ
খোয়াই থেকে উঠে এল
লালমাথা টিট্টিভ!

কবি সেই টিট্টিভের লাল রঙের মাথাটা কেটে নিলেন। লালমাথা কেটে ফেলাটা খুবই দরকার। ওটা তীব্র বিচ্ছুরণ ঘটায়। সেই বিচ্ছুরণে শুধু কলকাতার কেন, অনেকেরই ভালো ঘুম আসে না। শাসকের নেশাতুর চোখে কি আর বিকীর্ণতা পছন্দের বিষয় হয়? হয় না।

এই প্রতিবাদী কবিতায় আমরা যখন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি, প্রতিনিয়ত স্বজন-হারা বেদনার মাঝে যখন আর এক কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা উঠে আসছে, তখন ভারাক্রান্ত হচ্ছে আপামর গুণমুগ্ধের মন।

এই সব প্রতিভাধর স্বখ্যাত মানুষের চলে যাওয়া একটা সমাজের কাছে অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁদের বহুমুখী প্রতিভা মানুষের মনের সকল অবতলে কতশত ছোঁয়া রেখে যায়। দাগ রাখে অবচেতনের অন্দরে।

এই সৌমিত্রের কথাই ধরুন না। অভিনেতা, বাচিক শিল্পী, থিয়েটার কর্মী, নাট্যকার, নাটককার, এবং-ইত্যাদির বহুমাত্রিক-পরিচয় সৌমিত্রের কবি-পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়। এই স্মরণক্ষণ সেই সব ঘটনার অবগুন্ঠন সরিয়ে তাঁদের সামনে নিয়ে আসে। মূর্ত হয় বিমূর্ত জিজ্ঞাসা।

কিন্তু একজন চাষি। তার তো একটাই পরিচয়। তার তো একটাই গুণ – সে শুধু বীজ বুনতে পারে। ফসল ফলাতে পারে। হয়তো ভালো করে লিখতে-পড়তেও পারে না। ছোট্ট গ্রামীণ গন্ডীর বাইরে তাকে কেউ চেনেও না। তবু সে আনন্দে বাঁচে। তার কল্প-জগতে তারারাও জড়ো হয়। সে সোনালী ধানের শিষে লেগে থাকা শিশির বিন্দুর গায়ে খেলে যাওয়া হাওয়ার সঙ্গেই ভেসে বেড়ায় স্বপ্নে ঘেরা প্রকৃতির অন্তঃপুরে।

সেই স্বপ্নালু গেঁয়ো চাষিগুলো আজ মরছে। মড়কের থেকেও বেশী হারে তারা মরছে। আর যে বেঁচে আছে, সেও তো আজ জীবন্মৃত। সরকারের খাতায় এদের কোমর্বিডিটি ফ্যাক্টরটাই নথিভুক্ত হয়। সেখানে কারণ হিসেবে পারিবারিক অশান্তি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

এমনই কোমর্বিডিটিতে ঘোষিত মৃত চাষির নাম প্রান্তিক ভূমিজ। গ্রামের লোক তাকে অপু বলেই ডাকে। সে বেটা এই বছর আলু চাষের আগেই গলায় দড়ি দিয়েছে। শোয়ার ঘরেই সে ঝুলে পড়ছে। যখন সে এই ঝোলার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেছিল, তখন তার বৌ আকায় খড়ি দিয়ে ভাত রাঁধছিল, আর দশ বছরের ছেলেটা উঠোনের পুঁইমাচাটার কাছে আজ কেন টিট্টিভ পাখিটা আসেনি সেই খেয়ালে ধুলো মেখে চিলচিৎকার জুড়েছিল।

সেই অতিষ্ঠক্ষণে অপু আত্মহত্যা করে। আলু চাষের আগেই সে সেটা ঘটিয়ে ফেলে। অজানা করোনাতঙ্ক সে আগেই কাটিয়ে উঠেছিল। কাটাতে পারেনি সে তার চাষাতঙ্ক। সেই আতঙ্কে পরাজিত হয়েই সে মরেছে। নিজেই নিজেকে মেরে ফেলেছে।

সে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। তাই বউ যখন বলেছিল, “সবাই চাষ করছে, আর তুমি পারবে না? ডুবলে ডুববে। মুরোদহীন মরদ মূল্যহীন।”

মূল্য যে তার নেই তা সে অনেক আগেই জেনে গেছে। তার শ্রমের মূল্য সে ঠিক করতে পারে না। কোনো স্তরেই তার শ্রমে উৎপাদিত ফসলের দাম ঠিক করার স্বাধীনতার সে ভোগ করে না। ফলে সে পরাধীনতায় ডুবে থাকে, যেখানে তার মতো আর সকল চাষিরা অক্ষমতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ। এই ডুবে থাকার জন্য সে নিজে কোনো ভাবেই দায়ী নয়। স্বাধীনতার নীতি তাকে যে জালে ফাঁসিয়ে রেখেছে তা সে আজ আর কাউকে বোঝাতে পারে না। সকলেই যে সেই সমাজে ডুবে আছে। কেউ কম, আর কেউ বেশী।

অপু জানে কাশবন ঢিঙিয়ে রেলগাড়ি দেখার মতো শহরের বাবুরা তাদের কাদামাখা শরীরের ছবি দেখিয়ে শিকড়ের কাছাকাছি পৌঁছতে চায়, কিন্তু যন্ত্রণার গোড়া উপড়াতে সাহায্য করে না। রাজনৈতিক ভাষণে তাই চাষীর আয় তিনগুণ, চারগুণ বেড়েছে বলে নেতা থেকে নেত্রী যখন উৎসাহ নিয়ে ঘোষণা দেন, তখন ঐ বিবর্ণ মাথার বিচ্ছুরণে অপুরা খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়।

এদিকে অপুর বউ দেখে লাল গামছাটা মাথায় বেঁধে, শতছিন্ন গেঞ্জি পরে যে মানুষটা ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে গেল, সেই মানুষটাই কখন ঘরে ঢুকে আড়া থেকে ঝুলে পড়ল - সে ভাবতে পারে না। এই না জানাটাও সমাজের চোখে দোষের কারণ হয়। ব্যবস্থার চরিত্র কাটাছেঁড়া না করে, মুখরোচক হয় আর্তনাদের যৌন অভিব্যক্তি।

অপু জানতো তার বিঘে চারেক জমিতে সোনা ফলে। কিন্তু সে সারাদিন মাঠে পড়ে থেকেও কোনোদিন সোনা খুঁজে পায়নি।

সে শুনতো কোনো বছরই তেমনভাবে সে ফসলের-মার খায়নি। মাঠে পড়ে থেকে সে সেটা করেছে। প্রকৃতির-মার যখন হয়েছে, তখন তো তারা সকলেই মরেছে। তবুও তার মধ্যে সে বেঁচে থাকার পথ খুঁজেছে। নতুন উদ্যমে পরের ভোরে মাঠে নেমেছে। ধান, আলু, সব্জি ফলিয়েছে। ঘামের গন্ধ আর শ্রমের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরেও সোহাগ এসেছে তার মনে। সেই সোহাগেই পাড়ার রতন, অলোক, দিনুরা যখন পেপসির সঙ্গে চুক্তি-চাষে নিরাপত্তা খুঁজেছে, অপু তখন ভূমিজ পরিচিতির গর্বে স্বাধীন কৃষক হয়ে বাঁচার ঝুঁকি নিয়েছে। বাজারের-মারকে বুঝে নেওয়ায় বিকল্প নির্মাণের সাহস সে দেখিয়েছে।

অপু জানতো গতবছর সে ১০-১২ টাকা কেজি দরে মাঠ থেকেই আলু বিক্রি করেছিল, যা তার আগের বছর ছিল মাত্র ৩-৪ টাকা। এতে তার পুরোনো ঘা খানিকটা শুকিয়েছিল। কিন্তু ব্যথা কমেনি। সেই অক্ষমতাতেও তার দম ছিল। কিন্তু সে ভাবেনি যে এই বছর তাকে ৪৮০০ টাকা করে আলুর বীজ কিনতে হবে। এই মানের বীজ কিনলে, তার চার বিঘেতে খুব কম হলেও ১৫টা বস্তা তাকে কিনতেই হচ্ছে। আর সবচেয়ে কমা বীজটা কিনলে? সেই বীজও তো আজ ১৫০০ টাকা বস্তা। সেটা আবার বেশী না কিনলে কুলোয় না। সেটা থেকে আবার পরের বারের বীজও হয় না। নির্ভরতা থেকেই যায়।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আজ কাজে আসে না। সব কিছুই যেন গোলমাল হয়ে যায়। ১৩ থেকে ১৭ হাজার টাকার বীজের সঙ্গে গোবর সার, রাসায়নিক সারের খরচও তো আজ বিঘা প্রতি প্রায় হাজার পাঁচেকের বেশী হয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে আছে চষার খরচ, জলকর, ওষুধ, কিষেনের খরচ, যা এগারোর কাঁটা পার করে যায়। তাহলে সবমিলিয়ে অপুর এখন চার বিঘেতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দরকার। কোথায় পাবে সে এতো টাকা? পাড়ার মুদির দোকানীও এখন চাষীদের ধারে মুদিখানার মাল দেয় না। কে দেবে তাকে আকালের সাহায্য?

কৃষি সমবায়?

সেই প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ডে উন্নয়নের ঘুণ পোকা আগেই ধরে গেছে। সরকারের নীতিতেই সেগুলো এখন পঙ্গু হয়েছে। অপুরা সেই সব গোপন বাস্তবতার কথা জানে।

বিকল্প-সন্ধানী অপু জানে দীর্ঘদিন তার এলাকায় পেপসি কোম্পানীর লোকাল এজেন্টরা চাষীকে দিয়ে আলু চাষ করাচ্ছে। এই বছর চাষের খরচ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারণে বহু চাষী বাধ্য হয়েই এই চুক্তি-চাষে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। সরকারের কল্যাণকামী ভাবের থেকে বিচ্ছিন্নতা দিয়ে যার শুরু হয়, তার অন্তে থাকে চাষীর নিজের থেকে নেজেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতা।

পেপসির লোক তাকে বীজ, সার, কীটনাশক সবই দেবে। কোম্পানির নিযুক্ত কৃষি-বিজ্ঞানী মাঠে নেমে ফসলের তদারকিও করবে। ফসলের দামও ৪৮৫ টাকা প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় এবার যে দেওয়া হবে, তাও কোম্পানির তরফে আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপু জানে সেই দাম থেকে যখন খরচ বাদ যাবে তখন হাতে পড়ে থাকবে শুধু তার হাড়-জিরজিরে, কঙ্কালসার শরীরটা টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম রসদ। সেটা জীবন নয়। সেটা বেঁচে থাকাও নয়। সেটা হল এক নির্মম যাপন।

এখান থেকেই বিকল্পবাদী অপু এসকেপ করতে চায়। আগে ভাগেই পালাতে চায়। সে জানে এই জীবন বিমুখ হয়ে ওঠার জন্য সে নিজে দায়ী নয়। এটা তার কাছে ব্যক্তিবাহ্য এক কর্কশ সরকারী হাজিরা। যেখানে সরকার ভোটের লোভে উদ্ধৃত্ত-ভোগীদের আলু খাওয়ানোর জন্য ১৪ টাকা প্রতি কেজি বলে দর হাঁকেন, কিন্তু ১০০ টাকা কেজি দরের বীজ আলুর ক্ষেত্রে থাকেন নিরুত্তর।

কেন তাকে ১২০০ টাকায় এক বস্তা ইফকো কিনতে হয়? কেন ইউরিয়ার ৫০ কেজি বস্তা ২০ টাকা দাম বাড়িয়ে ৪৫ কেজির বস্তায় পরিণত হয়? কেন ৭০০ টাকার পটাশ ৯০০ টাকায় কালোবাজারী হয়? কেন চাষী ১০ টাকায় বেচা আলু ৪০ টাকায় কিনে খায়? কেন চাষীকে বিকল্প-চাষের ব্লককেন্দ্রিক প্রশিক্ষণের সরকারী উদ্যোগে খামতি থাকে? কোন কারণে চাষের খরচ তিনগুণ বেড়ে যায়? এই বহু কেন(?)র উত্তর অপুদের কেউ দেয় না। তাই সকলের প্রতিনিধি হয়ে অপু অন্ধকারে ডুবে যায়। সে জানে তার সাথীরাও সেই অন্ধকারে কাল ডুব দেবেন যখন ফসল তোলার সময় আসবে। জলের দরে ফলের রস তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা খাবেন। ঠিক তখনই ঐ পেপসির পটেটো প্রোডাক্ট গালে ফেলে হুইস্কি সহযোগে বুদ্ধিজীবী তার পাছা চুলকিয়ে কোন ক্ষমতা-চরিত্রকে কোথায় রাখবেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে বসবেন এবং আত্মতুষ্টির লাভ-ক্ষতি অঙ্কে কষবেন।

কৃষক-সভা আজ কঙ্কালকীর্ণ।

অপু তার মৃত্যুর কোনো খতিয়ান লিখে যাননি। তার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। বাগড়ম্বপূর্ণ সরকারী পদক্ষেপের সারবত্তাহীন অবস্থার কথা সে বুঝেছে, কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারেনি। এটা তার অক্ষমতা। সে শুধু জানিয়ে গেছে যে সে হেরে গেছে, যেটা নিছক কোন ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সে বুঝে গেছিল যে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর শাসক তার দানখয়রাতিতে উন্নয়নের উজালায় লালমাথার বিচ্ছুরণকে স্তব্ধ করতে চায়।

সেই নিস্তব্ধতায়, নীরবতায়, পাঠক স্মরণক্ষণের অংশীদার হন। অপুর কথা শুনতে শুনতে, অথবা কৃষিকুলের সমস্যা জর্জরিত দৈনন্দিন দিকের নানা কথা ভাবতে ভাবতে তারা হয়তো অলোকরঞ্জন, সৌমিত্রর সঙ্গে এক প্রান্তিক চাষির হারিয়ে যাওয়ার তুলনামূলক প্রসঙ্গটি মনে এনে কিছুটা ক্ষুন্ন হতে পারেন।

সেই ক্ষুন্ন হওয়ার কোনো অবকাশ আদতেই নেই। আন্তিগোনে পড়লে পাঠক যেমন নাটকের বিশ্লেষক হিসেবে কবি অলোকরঞ্জনকে খুঁজে পান, ট্রাজেডি, বন্যনাট্য, আর কমেডিতে গ্রীক নাটককে বুঝতে পারেন, ঠিক তেমনভাবেই আবার হে সায়ংকাল কাব্যগ্রন্থে পাঠকের কাছে হকি খেলোয়াড় সৌমিত্র হয়ে ওঠেন কবি। সেই লেন্সকে আর একটু ঘুরিয়ে দেখলেই পাঠক দেখবেন ফসল রোপনে অপুরা কেমন করে হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ শিল্পী। তারা জানে হাতে কটা আলু বসালে ফসলের পরিমাণ বেশী পাওয়া যায়। ঘাম-রক্ত জল হয়ে কেমন করে ফলে সোনার ফসল।

যদি তা না দেখা হয়, খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে অপুর দৃঢ়ভাষ্য তখনই কালপেঁচার কোলাহলে প্রতিধ্বনিতে ফিরে আসে। তখনই অপু তার অনিবার্য গন্তব্যে আগে পৌঁছাতে চায়। সে জানতে চায় চাষার বসাতিতে সবাই কি সুখে অচেতন থাকেন? কেউ কি জানেন কতখানি ব্যবধান এই অন্ধকার থেকে শেষ ইস্টিশানের? গন্তব্যের কত দূরে কৃষক আজ দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ বলবেন?

শত প্রশ্নের নিরুত্তরের মৌনধ্বনি শ্রবণে কর্তৃত্বাভিমানে জরাকীর্ণ সমাজের স্মরণক্ষণ অতিবাহিত হয়। কিন্তু চলমান জীবনে ঝরে পড়ার গল্প শেষ হয় না।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in