করোনা পর্বে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবস

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

এবছরের ১লা সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবস আমরা পালন করছি এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে। গত ছ-সাত মাসে করোনা অতিমারির আবহে শুধু স্বাস্থ্য-ক্ষেত্র নয়, অর্থনীতি থেকে রাজনীতি, শিক্ষা থেকে ক্রীড়া – গোটা বিশ্ব তোলপাড়। দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কর্মসূচীতে মানুষকে সমবেত করার অপরিহার্যতা বোধহয় সাম্প্রতিক কালে এতটা জরুরী হয়ে উঠেনি।

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে ১লা সেপ্টেম্বর দিনটির তাৎপর্য নিহিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৩৯ সালের এই দিনটিতেই জার্মান নাৎসী বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয় পোল্যান্ড। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ১লা সেপ্টেম্বর দিনটি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন (ডব্লিউ এফ টি ইউ)-র আহ্বানেই। ১৯৮২ সালের ১০-১৫ ফেব্রুয়ারি কিউবার রাজধানী হাভানায় অনুষ্টিত দশম বিশ্বট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এই দিনটিকে বিশ্বব্যাপী ‘ডে অফ ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাকশনস ফর পীস অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট’ হিসেবে পালনের ডাক দেয়। গোড়ায় যা ছিল ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলির ঘোষিত কর্মসূচী তা অচিরেই হয়ে উঠে সর্বস্তরের যুদ্ধবিরোধী সচেতন মানুষের যৌথ কর্মসূচী। আমাদের দেশে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালিত হয় বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের উদ্যোগে। সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থাও এই কর্মসূচীতে শামিল হয়।

এবছর ১লা সেপ্টেম্বর এসেছে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে। বছরের গোড়া থেকেই করোনা অতিমারির কারনে বিশ্ববাসী এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি যার কোন পূর্বনজির নেই। পুঁজিবাদী বিশ্বে আর্থিক মন্দার মধ্যেই এই অতিমারীর কারনে অভূতপূর্ব ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি সমগ্র বিশ্ব। বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক হিসেবে, করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। চলতি বছরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বৃদ্ধিহার ২.৫ শতাংশ থেকে ২. ৩ শতাংশে নেমে আসবে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনিম্ন বৃদ্ধিহার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও-র হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে লাগাতার লকডাউনের দরুণ জীবিকা হারাতে পারেন প্রায় ১৬০ কোটি কর্মক্ষম মানুষ-- বিশ্বের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। করোনা প্রাদুর্ভাবের এক মাসের মধ্যেই বিশ্বে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের আয় কমেছে ৬০ শতাংশের মতো।

করোনার ফলে বিশ্ব জুড়ে দারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি বেকারত্ব এবং শিশু শ্রমের সমস্যা প্রবলতর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রসংঘ। অতিমারির কারণে চলতি বছরের শেষ দিক থেকেই নতুন করে ১৩.২ কোটি মানুষ পেটপুরে খাবার পাবেন না। এই ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ অভুক্ত এবং অর্ধভুক্ত মানুষের সংখ্যা পৌঁছতে পারে ৮৪ কোটিতে।

কিন্তু এর মধ্যেও সাম্রাজ্যবাদের সার্বিক আগ্রাসন ক্রমাগত বাড়ছে। বিগত তিন দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর বিশ্বেও সাম্রাজ্যবাদ সামরিক আস্ফালনের পথ থেকে সরেনি। বিশ্বে সামরিক খাতে মোট খরচের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ অর্থ খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মুহূর্তে নিজের দেশের বাইরে ছোটবড় প্রায় একহাজার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে পেন্টাগনের। প্রায় পাঁচ হাজার পরমাণু বোমা রয়েছে আমেরিকার হাতে।

ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর বিশ্বেও মার্কিন- নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোকে সক্রিয় করা হচ্ছে দক্ষিণ- দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেও। ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর পর্বে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিপদ বেড়েছে বই কমেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, কিন্তু, চীনের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে যাবতীয় ষড়যন্ত্র। করোনা অতিমারির সুযোগে চীনকে একঘরে করার জন্য ওয়াশিংটন মরীয়া।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো সহযোগীরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা-মুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্ব চায় না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার মাঝারি পাল্লার পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র চুক্তি (ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সের ট্রিটি- আই এন এফ) থেকে একতরফাভাবে সরে গেছে গত ২ আগস্ট (২০১৯)। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচ্যভ এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগন আই এন এফ চুক্তিতে সাক্ষর করেছিলেন। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাসের উদ্যোগে এঘটনা বড়সড় ধাক্কা। প্রসঙ্গত দূর পাল্লার পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সাক্ষরিত ‘নিউ স্টার্ট ট্রিটি’-র মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২১-র ফেব্রুয়ারিতে। রাশিয়া চাইলেও আমেরিকা এখন সেই চুক্তির পুনর্নবীকরণ চাইছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্দ পরবর্তী সময়ে ঠিক এমন পরিস্থিতি কখনও ঘটেনি।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন লাতিন আমেরিকাতেও বামপন্থী বিকল্পের পরীক্ষানিরীক্ষার প্রক্রিয়াকে স্বস্তিতে থাকতে দিতে নারাজ। কিউবা ছাড়াও বাম-ঘেঁষা সরকার পরিচালিত দেশগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিউবার বিরুদ্ধে নতুন করে হুমকি দিচ্ছে ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী দেশগুলি ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ জোরদার করেছে। বিরোধী দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে সব ধরণের বেআইনী মদত দিচ্ছে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াতেও তেল ও গ্যাসের ভান্ডারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরীয়া। রাষ্ট্রসংঘে গৃহীত যাবতীয় প্রস্তাব তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের সামরিক দখলদারির সমর্থনে আমেরিকা নির্লজ্জের মতো সাফাই দিয়ে চলেছে। অসলো চুক্তিকে ইজরায়েল কার্যত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। প্যালেস্তাইন ভূখন্ড দখল করে নেবে বলে সরাসরি ঘোষণা করেছে ইজরায়েল। পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী নীতি উগ্র ইসলামী মৌলবাদকে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করেছে। সংকটের পরিণতিতে শরনার্থী সমস্যা এখন ভয়াবহ।

আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট ভারতও। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির জন্য শাসক শ্রেণী অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি উন্মুক্ত করে দেওয়ায় সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ এদেশের সর্বস্তরেই বেশ প্রবল। নয়া উদার নীতির নেতিবাচক প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়ছে বিদেশনীতির উপরও। প্যালেস্তাইনসহ আরব দেশগুলি সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত সময়-পরীক্ষিত নীতি বদলে যাচ্ছে। ইজরায়েলী অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন ভারত। পেন্টাগন একথা গোপন রাখেনি যে, ভারতের মধ্যে তারা এমন এক অধীনস্ত বন্ধু চাইলেই যাদের দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করা যাবে। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কী হবে তাও ঠিক করে দিতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প প্রশাসন কী চোখে ভারতকে দেখে তা হাইড্রোক্সিক্লোরোক্যুইন সরবরাহ প্রসঙ্গে ভারত প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতির চরম অবমাননাকর হুমকি থেকেই বোঝা যায়। করোনার প্রতিষেধক ওষুধ এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসককরা কিছু কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তেমনই একটি ওষুধ। ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের অন্যতম প্রধান রপ্তানীকারক দেশ। কিন্তু করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার গত ৪ এপ্রিল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেয়নি। গত ৬ এপ্রিল হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ভারত যদি হাইড্রোক্সিক্লোরোক্যুইন সরবরাহ না করে তবে আমেরিকা প্রত্যাঘাত (রিটালিয়েট) করবে। ইতিপূর্বে কোন রাষ্ট্র, এমনকি আমেরিকারও কোন পূর্বতন রাষ্ট্রপতি, স্বাধীন ভারতকে এরকম অসম্মানজনক ভাষায় প্রকাশ্যে ব্ল্যাকমেলের হুমকি দেয়নি।

করোনা অতিমারীর সুযোগ নিয়ে বিদেশী বহুজাতিকদের জন্য দেশের বাজার আরও খুলে দিতে মোদী সরকার বদ্ধপরিকর। ‘আত্মনির্ভরতা’র ভাঁওতা দেশবাসীর কাছে নগ্ন হয়ে গেছে। করোনা-গ্রাসে ভারতীয় অর্থনীতিও বেনজির মন্দার মুখে। চলতি আর্থিক বছরে ভারতীয় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার শূন্যেরও নীচে চলে যেতে পারে বলেও অনেকের আশঙ্কা। বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, করোনা সংক্রমণের দরুণ ভারতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে বর্তমান আর্থিক বছরে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে পৌঁছে যাবে তিন দশক আগের সময়ে। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ফিচ রেটিংস-এর মতে, চলতি আর্থিক বছরে জিডিপি-র হার ০.৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। করোনা বিপর্যয়ের পর একের পর এক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে পাতপাড়ি গুটোচ্ছে। করোনার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেচে দিতে চাইছে। ব্যাঙ্ক বীমা বেসরকারীকরণ থেকে কয়লাখনি বিক্রি, কিংবা নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণার মতো বড় বড় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সংসদে কোন আলোচনা ছাড়াই। মোদী সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে জনস্বার্থের ওপর একের পর এক আঘাত হানছে। দেশী বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির কাছে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশকে। এই আগ্রাসী নয়া উদারবাদী কর্মসূচী কার্যকর করতে গিয়ে জাতপাত ধর্ম বর্ণ-ভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি এখন শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ সর্বাত্মক আক্রমণের নীলনকশা সাজাচ্ছে নজিরবিহীন তৎপরতায়।

করোনার জেরে সংকট বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অনাবশ্যক গোপনীয়তা সমস্যা বাড়িয়েছে। উপযুক্ত চিকিৎসা-পরিকাঠামোর সমস্যা আরও প্রকট। রাজ্যে কর্মসংস্থানের হাল এমনিতেই শোচনীয়। করোনা অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুরবস্থা রাজ্যের প্রকৃত পরিস্থিতিকে চেখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ন্যায্য দাবিগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। মানুষকে সংগঠিত করেই এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ব্যাপকতম অংশের মানুষকে শামিল করেই এই সংগ্রামের সাফল্য সম্ভব।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in