
২৯ জুলাই দিনটা ভারতবাসীর কাছে এক বিশেষ দিন। আমাদের বাঙালির জীবনে তো স্মরণীয় বটেই। শিক্ষার আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে এই দিনটিকে নিয়ে যদি আমরা ভাবি, তবে সত্যিই এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণের কথা মনে আসে। একদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রয়াণ দিবস, অন্যদিকে ৩৪ বছর পর দেশের শিক্ষানীতিতে আমূল সংস্কার। এক অদ্ভুত সমাপতন, নাকি সবটাই পরিকল্পিত?
এটি হল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তিরোধান, আর শিক্ষা মন্ত্রকের আবির্ভাব দিবস। সেই শুভক্ষণে আরএসএসের ইচ্ছাপূরণ হল। ‘ইউজিসি’, ‘এআইসিটিই’ এবং ‘এনসিটিই’-এর মতো সংস্থাকে মিশিয়ে ‘হেকি’ গঠন করা হল। সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরও বৃদ্ধি করার সুযোগ রাখা হল। সংসদে ‘আইন’ হিসেবে পাশ না করেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনুমোদনে ‘নীতি’ হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োগ করার জোরদার প্রয়াস গত বুধবার থেকে শুরু হল।
তাতে কার কী বা এসে গেল? সমস্যারই বা কী হল? ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করেও তো সেই সময়েও উপনিবেশীয় ধারাকেই জিইয়ে রাখা হয়েছিল! আজ যেটা চালু হল তা তো বিগত এক বছর ধরে সারা দেশের শিক্ষাবিদদের মধ্যে আলোচনা করেই করা হয়েছে? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে কাজটা করা হয়েছে। সেখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই কি মূর্খ?
নিশ্চিতভাবেই তাঁরা মূর্খ নন, তবুও এই পরিবর্তনে এসে যায়। খসড়া প্রকাশের সময় থেকেই আজ এক বছর ধরে সেটা বলে আসা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং মাথা পিছু আয় যখন অনেক কিছুর নির্ধারক হয়, তখন এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরকে একমাত্রিক পরিবর্তনে সামিল করে তোলাটা অবশ্যই সমস্যার সৃষ্টি করে। আপাতভাবে তা দেখা না গেলেও আগামীতে সেটা যে বিমুদ্রায়নের সুফল, আর ঐ ২০০০ টাকার নোটে চিপ না পাওয়ার মতোই হবে, তা বলাবাহুল্য। আবার এটাও বলা হয়েছে যে বিশ্বায়নের যুগে, রাজনৈতিক স্বার্থে জ্ঞানকে এমনভাবে একটা দেশের পরিধিতে বেঁধে রাখতে শিক্ষাবিদদের সামনে রেখে মূর্খের ইচ্ছাপূরণ, আপাতভাবে সম্ভব হলেও তার সুদূর প্রসারী সুফল ঘরে তোলা সম্ভব হবে না। কিছুতেই অপচয়হীনভাবে হতে পারে না।
তর্ক অথবা বিতর্ক তো কখনও একা একা হয় না। আবার সবটা সহমতের ভিত্তিতেও চলে না। ফলে এই ধরনের মন্তব্যে আপনি/আপনারা খুশী নাও হতে পারেন। পাল্টা যুক্তি হিসেবে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের এখানে এসে তাদের ক্যাম্পাস যে খুলবে, সেই দিকটিকে নির্দেশ করতে পারেন। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে সুফল হিসেবে দেখাতে পারেন এবং ধর্ম ও মাদ্রাসা শিক্ষার সংযোগকে উদাহরণ করতে পারেন। প্রশ্ন তুলতে পারেন যে পুঁথিগত বিদ্যা এতদিন কী কাজে এসেছে?
এই ভাবনার মধ্যে থাকা স্ববিরোধ সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করবো। ভাবতে বলবো জ্ঞানের কার্যকরী রূপদানের সক্ষমতাকে। প্রশ্ন থাকবে, বিদেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় এখানে তাদের ক্যাম্পাস খুলবে এই প্রত্যাশাতেই কি শিক্ষানীতিতে বদল ঘটানো হল? শিক্ষানীতির ওপর কি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের এখানে আসাটা পুরোপুরি নির্ভর করে? কোনটা আমাদের কাছে বেশী প্রয়োজনীয় – শিক্ষার বুনিয়াদকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো, নাকি শিক্ষাকে বাণিজ্যের পরিসর করে তোলা? কোনটা? আবার দেখুন, এক দেশ, এক ভাষা, এক আইন কার্যকরী হলে যেমন সামাজিক বৈচিত্র্যে লাগাম পরানো হয়, সামাজিক রীতিগুলোকে (যা আইনের উৎস) গুরুত্বহীন করে তোলা হয়, ঠিক তেমন ভাবেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির যোগসূত্রকে বজায় রাখতে তাকেও একমুখী কেন্দ্রীকরণের জাতায় ফেলাটা ঠিক হয় না। মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রমে বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ যে নেই, সেটা নিছক রাজনৈতিক প্রচার।
তর্কের খাতিরে আপনি প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোর বিরোধিতা করতেই পারেন। প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন পদার্থবিদ্যার সঙ্গে ইতিহাস কিম্বা সংস্কৃত পড়া যাবে না? তা না হলে জ্ঞানের ফিউশন ঘটবে কীভাবে? কোন আলোকে জ্ঞান চর্চা সফল হবে যদি না তা মাতৃভাষার ওপর ভিত্তি করে হয়? এই প্রশ্নগুলো জাতীয় শিক্ষানীতির পক্ষে দাঁড়াবে।
অন্য পক্ষে দাঁড়িয়ে বলতেই হয়, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে সেখানে তিনটি ভাষার নিরিখে মাতৃভাষাকে বেঁধে ফেলা হচ্ছে কেন? বিশ্বায়নের পরিসরে যদি শিক্ষাকে ধামাধরা কাঠামো থেকে বাইরে নিয়ে আসাটাই লক্ষ্য হবে, তবে কেন তিন ভাষার নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে? এতে কি ভাষার বৈচিত্র্য হারাবে না? সেই বৈচিত্র্যকে মুছে ফেললেই কি শিক্ষার অগ্রগতি অনিবার্য হয়ে উঠবে? এটাই কি পরিবেশবান্ধব, ন্যায়সঙ্গত, অনুদানশীল এবং বুদ্ধিমত্তার জ্বালানি হয়ে কাজ করবে শিক্ষিত নাগরিকের চেতনায় যা সুস্থির সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। কীভাবে?
এমন প্রশ্ন সম্বলিত উত্তরে আপনি বিরক্ত হবেন। অঙ্ক ও বিজ্ঞান ভাবনা বাড়াতে পেশাদারী শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুফলকে আপনি সামনে আনতে চাইবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের সুযোগকে বড় করে দেখাতে চাইবেন। শিক্ষক-শিক্ষণের গুরুত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলবেন। কেন নিম্নমানের ও অকেজো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে না? – সেই প্রশ্ন তুলবেন।
আমিও আপনাকে সমর্থন করবো। বলবো, নিম্নমানের ও অকেজো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিপালনের কোন দায় কল্যাণকামী সরকারেরও থাকা উচিৎ নয়। এতে জাতীয় সম্পদের অপচয় হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সামগ্রিক উন্নয়ন যেখানে অধরা, সেখানে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে তো থাকবেই। সেই বাস্তবতা মানতেই হবে। দিল্লীর কোন স্কুল তো আর দিলদারপুরের স্কুলের তুলনায় নিম্নমানের হবে না! তাহলে অকেজো প্রতিষ্ঠানের বিচার কোন মাপকাঠিতে হবে? আবার যে প্রতিষ্ঠান অকেজো কলঙ্ক নিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে তার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কোথায় যাবেন? নিম্নমানকে উচ্চমানে নিয়ে যেতে কেন সেখানে বৃত্তিমূলক ও পেশাদারী শিক্ষার সুযোগকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা হবে না? তেমন কথা তো শিক্ষানীতিতে বলা নেই! বন্ধ করে দেওয়াটাই কি এই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য? শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে যে গালভারী বর্ণনা এখানে দেওয়া হয়েছে তা বর্তমান শিক্ষক সমাজকে অশ্রদ্ধা করে।
মোটেই না – আপনি চিৎকার করে উঠতে পারেন। বলবেন, বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং মুনাফার লক্ষ্য এই শিক্ষানীতিতে নেই। সর্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার পরিসরকে আরও সুদৃঢ় করে, গবেষণার পরিসরকে প্রশস্ত করাই এই শিক্ষানীতির লক্ষ্য। তাই এখানে উচ্চশিক্ষায় উদ্ভাবন ও গবেষণায় জোর দিয়ে একগুচ্ছ নীতি বদলের ঘোষণা করা হয়েছে।
আপনাকে এবার আমায় থামাতেই হবে। এটাই হল এই শিক্ষানীতির মূল দুর্বলতার একটি। তাই আপনি চিৎকার করলেও সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এমফিল তুলে দিয়ে গবেষণার একটা প্রাথমিক ধাপকে যারা মুছে ফেলে, তারা ঘটাবে গবেষণার বিস্তৃতি! সুনির্দিষ্ট কোন একটি বিষয়ে যে প্রতিষ্ঠান স্বনামধন্য, তাকে বন্ধ করে, কেবলমাত্র বহুমাত্রিক বিষয়ের ওপর চলা প্রতিষ্ঠানের জয়গান যে নীতিতে নেওয়া হয়, সেটা আর যাই হোক ছাত্রবন্ধু নীতি হতে পারে না। সেটা ‘ইনক্লুসিভ এডুকেশন’ হতে পারে না। স্বশাসনের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁধে আগামীতে যদি আর্থিক দায় চাপানো হয় (যা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রগুলিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে), তবে সকলের জন্য শিক্ষা কথাটা মিছে হয়ে যাবে। শিক্ষা বিতরণের প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসে সরকারী লাগাম কখনোই শিক্ষার মুক্তিকে নির্দেশ করে না। এক বাগাড়ম্বরপূর্ণ অতিকথনকে ইঙ্গিত করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০র পক্ষে দাঁড়িয়ে আপনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় প্রশ্ন ছুঁড়তে পারেন- এমন সম্ভাবনার জন্যই কি জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা সরকার বলছেন? আগামীতে খারাপ হবে বলে আপনারা মিথ্যা কল্পনাশ্রয়ী হয়ে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে নয়া শিক্ষানীতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল৷ তবুও অদ্ভুতভাবে কোন কিছুকেই ভালো বলতে পারছেন না! বিরোধিতার জন্য বিরোধ বাঁধানোর অভ্যাস ছাড়ুন। দেখুন, ১৫ বছরের স্কুলশিক্ষাকে কি সুন্দরভাবে ভাগ করা হয়েছে ৫+৩+৩+৪ ভাগে, যেখানে ৩ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত হল পড়ুয়াদের ফাউন্ডেশনাল স্টেজ। ৮ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত প্রিপেটরি স্টেজ, এরপর আসছে মিডল স্টেজ, যা ১১ থেকে শুরু হয়ে তিন বছর চলছে। পরের ১৪ থেকে ১৮ বছর হল সেকেন্ডারি স্টেজ। শিক্ষা ক্ষেত্রে সমানাধিকার যোগ্য শিক্ষা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি সকলের পৌঁছনোর ক্ষমতা সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক থাকছে এই এনইপির আওতায়। এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই খারাপ বলাটা সমীচীন হবে না?
বলছিও না। ভালো তো। প্রচলিত তিন ভাগকে পাঁচ ভাগে ভাগ না করে, চার ভাগ করা হয়েছে। তাই এখনকার প্রচলিত ১০+২ ব্যবস্থার পরিসরে বিষয়টিকে একটু বুঝে নেওয়া যেতে পারে। ৩ বছরের পর শিশু অঙ্গনওয়ারিতে ভর্তি হয়। ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে সেটাকে টডলার বললেও, গ্রামের দিকে যেটাকে ‘ছাতু স্কুল’ বলে। এখানে শিশু ৭ বছর বয়সের শেষে তার দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ সম্পূর্ণ করে। নতুন নীতিতে এটাকে ভিত বলছেন, একদম ঠিক। এবার দেখুন, ৮ বছরে তার তৃতীয় শ্রেণীতে পা রাখা এবং এই প্রস্তুতি পর্বে তার ১১ বছরে পঞ্চম উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকছে, যা আগেও ছিল। এই নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। মধ্যবর্তী পর্যায়ের ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সে সেই পড়ুয়া আগের মতোই ষষ্ঠ থেকে অষ্টম সম্পূর্ণ করছে। আমরা যদি সেকেন্ডারি পর্বের ১৪ থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়সে ১২ ক্লাসে পৌঁছানোর কথায় যাওয়ার আগে, প্রথম দিকের এই তিন পর্বের পাঠক্রম ও পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা যদি আমরা ভাবি, তবে প্রথমেই বলতে হবে যে কি পড়ানো হবে তা এখনও এই নীতিতে স্পষ্ট নয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরের প্রধান-প্রধান ধারণা এবং সেই সম্পর্কিত জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে এমনভাবে যা ঠিক প্রচলিত মনে রেখে পরীক্ষা দেওয়ার মতো নয়। এই পরীক্ষা খুব সাধারণ এবং এটা তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম গ্রেডে হবে। খুব ভাল। কিন্তু প্রশ্নের অবকাশ কিছু ধোঁয়াশার কারণে তৈরি হচ্ছে। যেমন ধরুন পাঠ্য বই কারা, কোথায়, কীভাবে সরবরাহ করবে তা খুব স্পষ্ট নয়। সেই কাজে রাজ্যগুলির ভূমিকা স্পষ্ট করা হয়নি। পাঠক্রমে ভাষা ব্যবহারের বিতর্ক, এবং বাংলা ভাষা না থাকার সমালোচনা এড়িয়েও প্রশ্ন উঠে যায় যে জাতীয় ও আঞ্চলিক পাঠ বলতে এই নীতিতে কি বোঝানো হয়েছে? আঞ্চলিক বা স্থানীয় জ্ঞান ও ধারণার গন্ডি ঠিক কতটা বিস্তৃত? নাগা শিশুর আঞ্চলিক পরিসরকে কীভাবে নাগপুরের আঞ্চলিক জ্ঞান ও ধারণার সমরূপী করে তোলা সম্ভব হবে?
সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। এতো বড় একটা দেশে অঞ্চল বিচারে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে তা করা যেতে পারে। এই ৬০ পাতায় সবটা বলা যায় না। একটা দিশা শুধু দেখানো যেতে পারে। সেটা আছেও। ফলে এই তিন স্তরে তেমন কিছু খারাপ নেই মানছেন? সেই চোখেই দেখুন, ৯ থেকে ১২ ক্লাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন এবং টেস্টের পর একটা ফাইনাল পরীক্ষা রাখা হয়েছে। তাই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে কার্যত গুরুত্বহীন মাধ্যমিক পরীক্ষা। বেশ কিছু পার্বিক মূল্যায়নের সাহায্যে বিষয়টাকে সহজ করে তোলা হয়েছে। এই সব বিষয়ে রাজ্যগুলোকে সবটা গাইড করবে ন্যাক্সে (NACSE)। এখানেও কি প্রশ্ন উঠবে?
দেখুন, তর্কের জন্য তর্ক নয়। নিতান্তই বুঝে নেওয়া। প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে নেওয়া। দেখা যাচ্ছে যে এই পর্বের পাঠক্রমে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য – এই তিন বিভাগ থাকছে না, বরং মূল্যায়নের পর্বে পড়ুয়া জীবনের গোড়া থেকে সেদিন পর্যন্ত যা শিখলেন সেটার পর্যায় ক্রমিক বিচারে তার দক্ষতা পরিমাপ করা হবে। শিক্ষার্থী এই পর্বে তার পছন্দের বিষয় পড়বেন। উচ্চ শিক্ষায় যেমন এখন সিবিসিএস চলছে, তেমন একটা ধাঁচে পড়ুয়া তার বিষয় বেছে নেবেন। ফলে সিবিসিএস যেমন চয়েস বেসড্ না থেকে কলেজ বেসড্ ক্রেডিট সিস্টেম হয়েছে, এটাও স্কুল বেসড্ চয়েসেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ? সেই শিক্ষা পরিকাঠামোর অনুপস্থিতি। সেই পরিকাঠামো (স্কুল বাড়ি, শিক্ষক সংখ্যা, শিক্ষা সহায়ক উপাদান বা টিএলএম, ইত্যাদি) নিশ্চিত না করেই এই শিক্ষানীতির প্রয়োগ, বাস্তবে জটিলতা বাড়াবে। ফলে বিষয় বাছাইয়ে বাধ্যবাধকতাও থাকছে না বললেও সেটা থাকতে বাধ্য। এই পরিকাঠামোয় সেটা একটা অনিবার্য বিষয়। যেমন ধরুন ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কোডিং শেখাবেন ভাবছেন, সেটা ভালো। কিন্তু সব স্কুলে সেই শিক্ষার পরিকাঠামো আছে কি? এই সমস্যা দূর করতে চুক্তির ভিত্তিতে সরকার নিজেই সবকিছু নিয়োগ ও ব্যবস্থা করবেন, নাকি কোন এজেন্সিকে বরাত দেবেন? স্কুলের সময়ের পর স্কুল বিল্ডিংকে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে তারাই কি চালাবেন? এই ধরনের নানান প্রশ্নের অবকাশ এখানে থাকছেই।
পাল্টা যুক্তি হিসেবে পরিকাঠামো সহ অন্যান্য সকল সমস্যা দূর করতে সরকার যে শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে সেই কথা আপনি বলবেন। তুলবেন ই-কোর্স, ই-লার্নিং গুরুত্ব পাওয়ার কথাটা। গোটা দেশে যে ৪৫ হাজার কলেজ রয়েছে তাতে সামনের ১৫ বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ এনরোলমেন্টের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে কেন্দ্র, সেই কথা মনে করিয়ে দেবেন৷ বলবেন, উচ্চশিক্ষায় নাট্যশাস্ত্র, খেলার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে৷ শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকবে। ৪ বছরে ইন্ট্রিগ্রেটেড বিএড করা গ্রামীণ ছেলে-মেয়েদের জন্য থাকবে বিশেষ সুবিধা। এছাড়া কলেজগুলিকেও আর্থিক দিক থেকে আরও কিছু সুবিধা দেওয়া হবে৷ কলেজগুলিকে গ্রেডের উপর ভিত্তি করে স্বশাসন দেওয়া হবে৷ ক্রমান্বয়ে অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। আইন এবং মেডিক্যাল ছাড়া বাকি সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছাতার তলায় আসতে চলেছে। একাধিক এন্ট্রি-এগজিট পদ্ধতি কার্যকরী হচ্ছে৷ পুরো কোর্স শেষ করতে না পারলেও পড়ুয়ার জন্য থাকছে স্বীকৃতির ব্যবস্থা৷ প্রথম বছর শেষ করলে পড়ুয়া পাবেন সার্টিফিকেট৷ দ্বিতীয় বছর শেষ করতে পারলে পাবেন ডিপ্লোমা৷ পুরো কোর্স শেষ করলে থাকছে ডিগ্রি৷ পছন্দমতো বিষয় বেছে নিতে পারবেন পড়ুয়ারা৷ কলেজে বিষয়ের ওপর থাকবে গবেষণার সুযোগ৷ এগুলো কম?
পাল্টা প্রশ্ন- স্নাতকোত্তরে ১ বা ২ বছরের কোর্স পড়ানো হবে বিদেশের মতো, কিন্তু এবার থেকে স্নাতক কোর্স তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের করা হচ্ছে কেন? এতে প্রতিটি বিভাগের জন্য ‘স্মার্ট ক্লাস রুম’ না হলেও একটা শ্রেণীকক্ষ সামনের বছর থেকেই বেশী লাগবে। আবার দেখুন, একসঙ্গে ৫ বছরের ইন্ট্রিগ্রেটেড কোর্স হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠক্রমও থাকবে বলা হচ্ছে, যা কিছু ক্ষেত্রে আজও আছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় পড়ুয়ারা তাদের পছন্দের বিষয় আজ কেমন মাত্রায় বেছে নিতে পারছেন তা আমরা প্রতিবছর দেখছি। ইউজিসি তুলে দেওয়ার হুমকির মুখে সিবিসিএস চালু হয়েছিল। কতটা এগোতে পেরেছি, তা আমরা জানি। দিল্লীর কলেজ তার ছায়ায় পটলডাঙ্গা মহাবিদ্যালয়কে দেখছে। আর উল্টোডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে পড়ুয়া পাচ্ছেন পুরো কোর্স শেষ না করেও তার একটা স্বীকৃতি৷ সুতরাং ফলাফল কী? যতটা কড়ি ফেলবেন, ঠিক ততটাই তেল মাখবেন। যাইহোক সেই কথা না ধরেও, শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগকে না দেখেও, মনে আসে- শিক্ষাছুটদের দিশা কি তবে ঐ ই-লার্নিং, ই-কোর্স! এই অতিমারির পর্বে আকস্মিক অনিবার্যতায় আমরা তো অনলাইন শিক্ষায় থাকা বৈষম্যকে দেখে নিয়েছি। এই মাধ্যমের গর্ভে লালিত হওয়া অসাম্যের প্রকট রূপটিকে স্পষ্ট হাজিরায় আমরা আজ প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। রামগড়ে বিঘে দুই কৃষি জমির ভাগচাষি লালু তার চরম দারিদ্রেও ১০ বস্তা ধান বেচে দেয় ছেলে সূর্যের মোবাইল ফোন কেনার জন্য! এই পরিস্থিতি কোন সুদিনের ইঙ্গিত বহন করে?
তাহলে কি ওগুলোর দরকার নেই? -এই প্রশ্ন আপনি প্রথমেই তুলবেন। বলবেন, বিদেশে এমন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন আমরা কিন্তু সবাই দেখছি। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলি আজ এই পথেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কেন? কেন এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ জাপান শিশু শিক্ষাকে এমনভাবেই দেখছে? এই পন্থা তবে কি ভুল? এগুলো ভারত মাতার কাছে অপ্রয়োজনীয়? দেশদ্রোহীর যুক্তিতে তর্ক কেন, দেশের জন্য কোনোরকম ভালো কাজও করা যায় না বলে হয়তো আপনি আক্ষেপও করবেন। তাই আপনি/আপনাদের দাবি থাকবে এমন এক ঘোষণাপত্রের প্রতি যাতে খুব সহজে এই বিরোধিতাকে অবিলম্বে বন্ধ করা যায়।
সমকালীন সরকারী উদ্যোগ ও উদ্দেশ্যের ইতিহাস জেনেও ভেবেচিন্তে বলবো, সব কিছুরই দরকার আছে। অনলাইন শিক্ষা নতুন কি? সেটা তো এখনও চালু আছে। ধীরে ধীরে তার পরিসরও বাড়ছিল। আয়ের জন্য কাজে থেকেও শিক্ষালাভের সুযোগ, অথবা অন্য অনেক কারণে, একসঙ্গে বেশী পড়ুয়াকে শিক্ষার আঙিনায় আনতে এটা দরকার। জ্ঞান চর্চায় তো ক্ষতি নেই। একটা বিশেষ মাধ্যম হিসেবেও এই ডিজিটাল প্লাটফর্ম যথেষ্ট উপযুক্ত। কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটাকে বাণিজ্যিকভাবে কাল থেকেই মুক্ত করে দিতে হবে এমন পদক্ষেপের অনিবার্যতা হানিকর হতে পারে। বিশেষ করে যে দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে ‘বিগ ডেটা ব্যাঙ্ক’কে অপরের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটে, এবং সেই শাসকের সরকারী মুখোশের অন্তরালে থাকা কদর্য মুখটাও আমরা যেহেতু দেখে ফেলেছি, তাই সতর্ক না হয়ে পারা যায় না। বিভাজনের রাজনীতিতে পুষ্ট বেচে খাওয়া সরকারের থেকে লিঙ্গ-সাম্যের বার্তা তারা এই নীতিতে আমাদের দেখাবেন –এমন আশাও করি না। নকল সত্যের মোড়কে, ভণিতার বয়ানে যাই প্রকাশ পাক, আসল সত্য হল পরিষেবা বাণিজ্য। তাই বৃহৎ পুঁজির লক্ষ্য এখন শিক্ষা। এটাই বাস্তব। আপনি মানুন, আর নাই মানুন। বিগ ডেটার সংশ্লেষে নজরদারির পন্থা পরিচয় এবং পরিষেবা অর্থনীতিতে জ্ঞানানুর মূল্য, কেমন হবে তার প্রমাণ উত্তর-কভিড-১৯ সমাজ দেবে। তর্কটা সেই আগামীর জন্য তোলা থাক।
(লেখক ফারাক্কা এস এন এইচ কলেজের অধ্যাপক)
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন