বেশিদিন আগের কথা নয়। আনুমানিক ১৫০০ দিন। বছরের হিসেবে বছর চারেক। ঠিক সেই সময়টাতে ফিরে গেলে এখনও ভারতবাসীর কানে বাজবে কিছু কথা। ‘বিদেশ সে কালে ধন ওয়াপস লানা হ্যায় কি নেহি?’ সামনে বসে থাকা আধপেটা খাওয়া, ফসলের দাম না পাওয়া, চাকরি না থাকা পোড়া দেশের নাগরিকরা সম্মিলিত স্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে ‘হাঁ’। মুহূর্তে ভায়া নিজস্ব প্রচারমাধ্যম সেই লাইভ সম্প্রচার ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্তে। ফোটোশপ হয়ে সেই জনসভার ছবি ছড়িয়ে যায় প্রান্ত থেকে প্রান্তরে।
‘মসীহা’ এসেছেন, ‘মসীহা’। ইনিই মুখ থুবড়ে পড়া ভারতবর্ষকে উদ্ধার করবেন। অর্থনীতি চাঙ্গা করবেন। দেশের মাঠে মাঠে সোনা ফলবে। কারখানায় কারখানায় চলবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র দাপট। আর ব্যবহার করতে হবে না চীনা পণ্য। 'স্বচ্ছ ভারত' হবে। দেশের প্রতিটি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকবে ১৫ লক্ষ করে টাকা। আর দেখতে হবে না ‘পাকিস্তানের, আমেরিকার দাদাগিরি’। ‘মুসলমানরা বড় বেড়েছে, এবার শায়েস্তা করা যাবে।’ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাজারো না পাওয়া সুপ্ত বাসনা উসকে দিয়ে ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি।
চেনা লাগছে না? লাগাই স্বাভাবিক। কারণ আপামর ভারতবাসী এই ছবির সঙ্গে পরিচিত। যিনি জীবনে কোনোদিন কোনও জনসভায় যাননি, তাঁর ঘরের ড্রয়িংরুমেও সুকৌশলে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেই অমোঘ বাণী – ‘আচ্ছে দিন আনেবালা হ্যায়’।
এটুকু অতীতচারণার বোধহয় প্রয়োজন ছিলো। নাহলে দুর্বল স্মৃতির মানবকুল ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’, দৈনন্দিন রাম-রহিমের মেকি যুদ্ধ আর ‘পাকিস্তান এই ভারত আক্রমণ করলো’র তৈরি করা খবরে হারিয়ে ফেলবেন সত্যি আর মিথ্যার প্রভেদ। মূল সমস্যা আর মেকী সমস্যার দ্বন্দ্বে, প্রচার কৌশলে হারিয়ে যাবে অনেক কিছুই।
আসলে সমস্যা আছে। সমস্যা তার নিজের রুপেই আছে। তার কোনোটা চোখে পড়ে, কোনোটা পড়ে না। কোনোটা প্রত্যক্ষ আবার কিছু পরোক্ষ। এই যেমন গত ২০১৭ সালে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমা টাকার পরিমাণ ছুঁয়েছে ৭০০০ কোটি। ২০১৬র অনুপাতে বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে আপনার মনে হতেই পারে সুইস ব্যাঙ্কে কে টাকা রাখলো তাতে আমার কী? এটা তো সত্যি যে সুইস ব্যাঙ্কে ‘আম আদমি’ টাকা রাখতে যান না। তাঁরা বরং হা পিত্যেশ করে বসে আছেন কবে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মত ১৫ লাখ টাকা ঢুকবে।
নীরব মোদী, মেহুল চোকসির প্রতারণা, কয়েক লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ ছাড় দিয়ে কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া - এগুলো আপনার সমস্যা, নাকি তাজমহল শিবমন্দির ছিলো, আর রামমন্দিরটা ওখানেই তৈরি করতে হবেটা আপনার সমস্যা সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।
আছে প্রশ্নও। একাধিক। প্রথম প্রশ্ন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পালিত হল কি? আপনার আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা ঢোকার দরকার নেই। কিন্তু কত কালো টাকা এই চার বছরে দেশে ফিরলো? নাকি আরও বেশ কিছু টাকা ‘কালো’ হয়ে নীরব মোদীদের মত দেশ থেকে পালিয়ে গেল এই সুযোগে? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন নোট বাতিলের বছরে যখন দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ঘটি বাটি প্রায় বিক্রি হয়ে গেল, হাজারে হাজারে ছোট শিল্প, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, রাতারাতি বেকার হয়ে গেল কয়েক লক্ষ মানুষ, তখন কারা নিঃশব্দে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিলেন? এর জবাব কী ‘রামমন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’ আর সারজিক্যাল স্ট্রাইকের ভিডিওতে পাওয়া যাবে? নাকি 'স্বচ্ছ ভারত' অভিযানের নাম করে ভারতবর্ষকে 'স্বচ্ছ' করে দেবার এ এক অন্য খেলা?
GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।