ভারতের অর্থনীতি কি ডুবন্ত?

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
Published on

কোভিড ১৯ পরবর্তী সময়ে আমাদের চোখের সামনে এসেছে ভারতের অর্থনীতির ডুবন্ত দশা। ভারতের কোভিড সময়ের স্মৃতির সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত হয়ে থাকবে পরিযায়ী শ্রমিকদের সারি বেঁধে বহু কষ্ট অবজ্ঞা সহ্য করে বাড়ির দিকে ফেরার ছবি। স্মৃতিতে এও থাকবে যে ভারতের জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নীচের দিকে নামছে। শেয়ার বাজারে রেকর্ড পতন হয়ে যাচ্ছে। কোভিড যখন স্মৃতির আড়ালে চলে যাবে, তখন ঐতিহাসিক ভাবে কিন্তু এই ঘটনাগুলি স্মৃতির আড়ালে যাবে না।

দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক, আমাদের দেশে রোগ নিরাময়ের জন্য অপরিকল্পিত লকডাউন বুঝিয়ে দিয়েছে যে দেশের সরকার এই বিশ্ব মহামারী নিয়ে একটুও তৈরী ছিল না। মহামারী যখন অনেক দেশে ছড়িয়ে গেছে, তখনো আমাদের দেশে এই মহামারী নিয়ে ন্যূনতম তৈরী হওয়ার বা পরিকল্পনার ছিটেফোঁটাও ছিল না। লকডাউন হওয়ার পরে কেউ কেউ মনে করলেন যে, মানুষ যদি কাজে বেরোয় তাহলে সে আর বাঁচবে না। কথাটা মিথ্যা নয়। সংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় সংক্রমণ না ছড়াতে দেওয়া। তাই এদেশে সংক্রমণ ছড়ানো আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুটোই একসাথে বন্ধ করে দিল সরকার। কিন্তু ফল হল এই যে, সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ হল না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ল। লকডাউন থেকে আনলকডাউনে চলে যেতে বাধ্য হল দেশ। চিকিৎসা নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা হল না। সংক্রমণ আরো ছড়াচ্ছে এবং অর্থনীতি আরো ডুবছে।

এই দুটি পরস্পর বিপরীত নয়, একটা যে আরেকটার পরিপূরক তা জনসমক্ষে সামনে এল না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে যেমন কেরালায় চলেছে সরকার, সংক্রমণ কমানোর চেষ্টা করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তাড়াতাড়ি শুরু করা যেতে পারে। এই সহজ কথাটা আমাদের আলোচনায় আসছে না।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনার তা হল, সারা বিশ্ব জুড়ে যখন আলোচনা চলছে যে কোভিডের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙ্গে যাচ্ছে এবং এমন বিশ্ব মন্দা আসছে যা অতীতে কখোনো আসেনি, ২০০৭-৮ এর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটকেও ছাপিয়ে যাবে এই মন্দা, তখন ভারতের অর্থনীতির দ্রুত পতনকেও এই পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যাখ্যা করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভারতে ক্ষেত্রে প্রাক কোভিড অর্থনীতি ডুবেই যাচ্ছিল। ডুবন্ত অর্থনীতি এই অবস্থাতে পড়লে আরো ডুবে যাবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি? আমাদের দেশের অবস্থা বাড়তি কঠিন, এই কথাকে মান্যতা না দিয়ে সব আর্থিক সঙ্কটের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে দায়ী করলে এই বিপদ থেকে উত্থানের পথ পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঐক্যমত্য তৈরী করা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।

দেখা যাক এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সঙ্কট আমাদের দেশে কতটা? ঠিক যখন এই লেখা লিখছি তখন সেনসেক্স, নিফটির সূচকে গত ৩ সপ্তাহে এক দিনে রেকর্ড পতন হল। জি ডি পির বৃদ্ধির হারের রেকর্ড পতন লক্ষ করা গেছে। মুডি থেকে অন্যান্য বিদেশী ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি জানিয়ে দিয়েছে যে ভারতের বিনিয়োগ যোগ্যতা কমতে কমতে একেবারে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। বিএএ-৩ থেকে বিএএ-২ স্তরে মুডি নামিয়ে দিয়েছে ভারতের বিনিয়োগ যোগ্যতা। দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে যাবে এই আশঙ্কাও তারা করেছে। আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার নিরিখে বিএএ-২ সর্বনিম্ন একটি স্তর। ভারতের কোন আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না বা ভারত গভীর আর্থিক সঙ্কটে পড়বে এমনটাই বলেছে মুডি।

মুডি এই কথা যখন জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা বা আই এম এফ জানাচ্ছে যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ০ থেকে ৩ % কোনমতেই অতিক্রম করবে না। রেকর্ড বেকারি, রেকর্ড উৎপাদন হ্রাস, রেকর্ড শ্লথতা শিল্পোৎপাদনে বৃদ্ধির হার, নোটবন্দী আর পণ্য পরিষেবা করের দাপটে আক্রান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিটগুলি। এই ছিল দেশের আর্থিক অবস্থা। দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, আর্থিক, সামাজিক বৈষম্য, কোভিড ১৯ এর আগেই দেশে ছিল। কোভিড না থাকলেও দেশ তার সরকারী পরিসংখ্যানের নিরিখেই মন্দায় প্রবেশ করেছিল। যদিও সরকারী নথিতে এই মন্দার কোন স্বীকৃতি ছিল না, কিন্তু অর্থনীতির নিয়মে পরপর ৯ মাস ধরে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমতে থাকলে, অর্থনীতি মন্দায় প্রবেশ করছে বলে বলা হয়। কোভিডের আগে ভারতে অর্থনীতি এই রকম মন্দাক্রান্ত ছিল। কোভিড এই অর্থনীতিকে একেবারে নিমজ্জিত করেছে।

ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হারের তথ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে যা জানা যায় তা হল এই বৃদ্ধির হার ০ থেকে ঋণাত্মকও হয়ে যেতে পারে। সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর জানান এই কথা। ২০২০-২১ সালের জিডিপি বৃদ্ধির হার এইরকমই থাকবে এ কথা তিনি বলেন। কোভিডের পরে দ্রুত এই হার নীচের দিকেই নামবে। -৬% থেকে ১ % এর মধ্যে এই হার ঘোরাফেরা করবে এমনটাই আশঙ্কা। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। ভগ্নপ্রায় অর্থনীতির উপর এই লকডাউনের ধাক্কা তাকে এরকমই জায়গায় নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। দেশের সরকার এখোনো আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর কোন অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা এখোনো পর্যন্ত তারা দেশবাসীকে দিতে পারেনি। নীতি আয়োগের কাছ থেকেও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

আরো একটি নতুন বিতর্ক জুড়ে গেছে এই জিডিপি বৃদ্ধির হারকে কেন্দ্র করে। প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন সহ আরো অনেক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন যে, জিডিপি বৃদ্ধির হারের সরকারী পরিসংখ্যানের অনুমান অনেক বেশি করে দেখান হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। পরিসংখ্যান দপ্তর থেকে যে পরিসংখ্যান জানানো হয়েছে এ বিষয়ে সেটি এই হিসেবে অন্তত ২ লাখ টাকা বেশি। গত কয়েক বছর থেকেই ভারতীয় পরিসংখ্যান এক চরম সমালোচনার সামনে পড়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। অনেক সময়ে এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানবিদেরা সর্বসমক্ষে মুখ খুলেছিলেন। যদি কোভিডের মত বিপর্যয়ের সময়েও এই সমালোচনা হয়, তাহলে অর্থনীতির উদ্ধারের পথ খুবই কঠিন হবে। দুঃখের কথা এই যে চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও বিতর্ক পিছু ছাড়ল না অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের।

ঈশিতা মুখোপাধ্যায়,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

SUPPORT PEOPLE'S REPORTER

ভারতের প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুখী সাংবাদিকতা — যা আপনার সামনে সঠিক খবর পরিবেশন করে। পিপলস রিপোর্টার তার প্রতিবেদক, কলাম লেখক এবং সম্পাদকদের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আপনাদের মতো পাঠকদের সহায়তা। আপনি ভারতে থাকুন বা দেশের বাইরে — নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে একটি পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in