উত্তর-সত্য ও সত্য-উত্তর সমাজ – বিশ্ব রাজনীতির পাঠ

ছবি সংগৃহীত
ছবি সংগৃহীত

উত্তর-সত্যের সামাজিক অবস্থান নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে মিথ্যা কিভাবে এই সমাজে গুলে যায় সেই বিষয়ে আমরা অনেকেই অনেক কিছু লিখেছি। আজও লিখতে হয়। সংস্কৃতির প্রবাহে এই সব মোক্ষ নির্দেশক সামাজিক ধারা আমাদের জীবনে চলে আসে। আমরাই সেই সচলতায় শক্তির যোগান দিই। সেগুলোকে গোগ্রাসে গিলি, আবার অচিরেই বমি করি। প্রতিনিয়ত সতর্ক থাকলে সেই সম্ভাবনা কিছুটা কমে।

উত্তর-আধুনিক সংস্কৃতি যে অনিশ্চয়তার এবং অপ্রত্যাশিতের সম্ভাবনা দেখিয়েছিল, কার্যকারণ সম্পর্ক বিন্যাসকে মিথ্যে বলেছিল, জ্ঞানানুর সন্ধান দিয়েছিল - সেই উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি নতুন যুক্তিবিন্যাসের পারে-আখ্যানে উত্তর-সত্যের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। নিশ্চয়তার বিজ্ঞান রাজনৈতিক বয়ানে কেবল মৃত্যুকেই এখানে নিশ্চিত করে। সেই মৃত্যু, মানব সভ্যতার হতে পারে, আবার কালিক বিশ্বায়নেরও হতে পারে।

এই পর্বে পৌঁছানোর মাঝেই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের কথা জেনে গিয়েছিলাম। বাজারের ঝুঁকি আর ঝুঁকির বাজার যে এক নয়, তা বুঝেছিলাম। ঝুঁকির বাজার কিভাবে পুঁজি বিনিয়োগের পরিসর হয় তাও আমরা বিগত তিন দশক ধরে দেখেছি। ঝুঁকি ঠেকাতে ঝুঁকি কিনেছি আমরা। মত্ত হয়েছি ঝুঁকি উৎপাদনে। উদ্বাহু হয়েছি ঝুঁকির বাজার দখল করতে। কোনও দেশই সেখানে পিছিয়ে নেই। কেউ খোলাখুলি, কেউ রেখেঢেকে!

ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের দরজায় আজ কড়া নাড়ে জীবনের ঝুঁকি। পরিবেশের মাথা খারাপ করিয়ে আমরা যখন জীবনের জয়গান গাইতে চাইছি, স্থিতিশীলকে অস্থির করে ধারণশীল বক্তব্যকে যখন লাগু করতে চাইছি, তখনই উদ্ভূত সেই অনাকাঙ্ক্ষিত হারানোর পরিসরকে আমরা ভয় পেতে শুরু করছি। কারণ সেখানে তখন মৃত্যু রয়েছে দাঁড়িয়ে। আর তা সমাজের ওপর অংশ থেকে নামছে বিশ্ব-মহামারীর নভেল পরিচিতিতে!

এমন শঙ্কার প্রতিবেশ তৈরি করেছে নতুন ধরনের এক করোনাভাইরাস। চীন তাকে প্রথমে আঞ্চলিক নামে চিনলেও হু যার নাম দিয়েছে কোভিড-১৯। দ্রুত সংক্রমণের ক্ষমতা রয়েছে এটার। ওষুধ না থাকায় একে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানা গবেষণা, নানা দেশে, নানা ভাবে হচ্ছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও আজ বিতর্কিত। মূলত দুটো দিককে নির্দেশ করে সেই আলোচনা। এক, দেশ বিচারে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভিন্ন হওয়ায় বিপদের মাত্রা বুঝতে এক ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। দুই, রাষ্ট্র সব তথ্য দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে একটা বিতর্ক হচ্ছে।

করোনা যে মানবিক মূল্যবোধের অবনমনকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করলো, মুনাফার কারবারিরা যে মানব জাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি করলো, আগ্রাসনের রাজনীতি যে কল্যাণকামী মননকে নষ্ট করলো, তা আমরা দেখার চেষ্টা করছি না।

সেই বিতর্ক অনাকাঙ্ক্ষিত, তবু সেটা বাস্তব। সেই বাস্তবতায় জন্ম নিচ্ছে উত্তর-সত্য। সত্যের আধারে গুলে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যাকে। করোনা যে মানবিক মূল্যবোধের অবনমনকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করলো, মুনাফার কারবারিরা যে মানব জাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি করলো, আগ্রাসনের রাজনীতি যে কল্যাণকামী মননকে নষ্ট করলো, তা আমরা দেখার চেষ্টা করছি না।

বিষয়টাকে উদাহরণে বোঝা যেতে পারে। এই চীনের কথা ধরুন। কোভিড-১৯ সম্পর্কে চীনের জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অন্য যেকোনো দেশের থেকে বেশী। এখানেই যেহেতু অজানা জ্বর ও মৃত্যুর ঘটনা প্রথম ঘটে এবং সেই অজানাকে জানতে বেশ কিছু ভাইরাস বিশেষজ্ঞকে জীবন দিতে হয়, তাই আজকের নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পৌঁছানোর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাদের আছে। অন্য দেশকে সাহায্য করতে তাই তারা এগিয়ে আসার সাহস দেখায়। আমেরিকা সেখানেও রাজনীতি করে। চাইনিজ ভাইরাস বলে দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়, অথচ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রেখে অমানবিক থেকে যায়। আমরা নিজের সুরক্ষার কথা না ভেবে, চীনের এক কোটি মোবাইল গ্রাহককে খুঁজি! পিছনে তাড়া করে হান্টারভাইরাস।

আমাদের শিক্ষিত সমাজ রোদে বসে ট্রাম্পের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। সমাজের এই অংশ জানেন যে এই ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে তৈরি নয়। আমার বিশ্বাস, ভাইরাস সম্পর্কে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জ্ঞান তাদের আছে। তবু চীন চীন চিৎকার করতেই হয়। এটাই নাকি এখন বেশী দরকার। পরিকল্পনাহীন পূর্বকাজ ঢাকতেই সেটা দরকার। সেই দরকারে লি ওয়েনলিয়াং পূজ্য হলেও শি ঝেংলির সহকর্মীগণ যারা ভাইরাসটাকে চিহ্নিত করেছিলেন, এবং তাঁদের আত্মবলিদান, সংগঠিত চিল চিৎকারে চাপা পড়ে যায়। নয়া-উদারবাদের হাতিয়ার হন লি। এই প্রচারের সাহায্যে আমাদের কুসংস্কারে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ভাবতে থাকি, আমি যখন এখনও আক্রান্ত হইনি, তখন সব ঠিকঠাকই চলছে। উত্তর-সত্য সেখানেই প্রতিষ্ঠা পায়।

আমার দেশপ্রেমে জারিত আমার মাতৃভূমি কেন আমার দায়িত্ব নেবে না সেই ভাবনা দূরে সরে যায়। সামনে আসে অন্য দেশ। অন্য কিছু। বলসেনারো বলে বসেন, ‘ও কিছু না। করোনা হল মিডিয়ার দেখানো ভয়।’ আর আমরা তখন রাস্তায় সিংহ ঘুরে বেড়ানোর ছবি দিয়ে রাশিয়ার লকডাউন বোঝাই। পুতিনের বুদ্ধি আর আমার সাধারণ জ্ঞান মিলে যায়। সকলের অবুঝ সমর্থনে সাধারণ জ্ঞান বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পেয়ে যায়। বাঁচার পন্থা খুঁজতে ভুলে যাই।

আমরা চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল সরঞ্জাম কতটা আছে জেনে নিতে ভুলে যাই। আত্মসুরক্ষার নামে রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াই। ঠিক তখনই আমাদের কাছে সত্য হয়ে ওঠে করোনা আক্রান্তকে গুলি করে মারায় কিমের কারসাজি। মিথ্যা হয়ে যায় উন্নত দেশের বিপুল খরচ বহুল বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার ভঙ্গুর দশাটা। বিজ্ঞান আর পুঁজিবাদ সমার্থক হয়ে বিকল্প সন্ধানী আমাদের মনকে করে তোলে জরাগ্রস্থ। আতঙ্কের পরিবেশে কালোবাজার, অদ্ভুত এক হার-জিতের খেলায় অজান্তেই আমাদের জুয়ারি করে তোলে।

আপাতত ১০ জন দেশবাসী, আমাদের সহনাগরিক, সেই জুয়ায় আর কোনোদিন খেলতে পারবেন না। আপৎকালীন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা সবাই। তাই জীবন যুদ্ধে বেঁচে থেকে দেশকে আগামীতে সুন্দর করতে আপাতত সামনের মাসের ১৫ তারিখ সকাল পর্যন্ত ঘরে বসে কাজ ও পরিকল্পনা করি চলুন।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in