জন-গণ (মন) হিতকর

ছবি প্রতীকী সংগৃহীত
ছবি প্রতীকী সংগৃহীত
Published on

“দয়া করে কোনো স্থায়ী জিনিস করা চলেনা। বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে।

সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয়।” প্রায় প্রায় ৯০ বছর আগেকার লেখা। প্রাসঙ্গিকতার বিচারে আজও প্রবল সজীবতার সাক্ষী। বর্তমান রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি বেশি করে ভাবার।

ভাবায় তো বটেই। দেশ ভাবায়, রাজনীতি ভাবায়, মানুষ ভাবায়। ভাববার জন্য মাথার দিব্যি দেওয়া না থাকলেও মানুষের বর্তমান চিন্তা-ভাবনার গতি প্রকৃতি সুস্থ বুদ্ধির মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।

এই সময় ‘পপুলিস্ট পলিটিক্স’ কথাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেহেতু মূল সমস্যাগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে এই মাধ্যমে চটজলদি কিছু জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, তাই অনেকেই সেই পথ ধরেই অভীষ্টে পৌঁছোতে চাইছেন। পপুলিস্ট রাজনীতিবিদদের তালিকায় কে নেই। দেশের তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদরা সহজ পাটিগণিতের পথ ধরেই সহজে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে চাইছেন। তাতে মূল সমস্যা থেকে যাচ্ছে সমস্যার জায়গাতেই। কারণটা তো আগেই বলা। “দয়া করে কোনো স্থায়ী জিনিস করা চলেনা।বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে।” শুধুমাত্র পাইয়ে দেবার রাজনীতি করতে গিয়ে বিকার ঘটছেও।

তবে এ প্রবণতা অবশ্যই বেশ পুরোনো। তা না হলে প্রায় ৯০ বছর আগে ‘তাঁর’ কলম থেকে এ জিনিস বেরোতো না। আমরা অনুধাবন করতে পারিনি, সেটা আমাদের সমস্যা।

ডিমনিটাইজেশন করে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করা বা বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধারের গল্পটা মানুষকে খাওয়ানো খুব সহজ। কিন্তু এই ঘোষণাগুলোর মধ্যে থেকে ‘পপুলিস্ট’ অংশটুকু ছেঁটে ফেললে যা নির্যাস পড়ে থাকে তা একটি বৃহৎ অশ্বডিম্ব। এই কাজগুলো করে কালো টাকা, জাল নোট যে কিছুই উদ্ধার হয়নি তা তো পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। মাঝখান থেকে পপুলিস্ট রাজনীতির মাশুল দিতে বেঘোরে প্রাণ গেছে শতাধিক মানুষের। রুটি রুজি হারিয়েছে আরও কয়েকলক্ষ।

একইভাবে সিঙ্গুরে ৮০ শতাংশ হয়ে যাওয়া কারখানা ভেঙ্গে ভগ্নস্তূপের জঙ্গল তৈরিতে, ক্লাবে ক্লাবে ফি বছর ডোনেশন দিয়ে কিংবা কসমেটিক ডেভলপমেন্টএর নামে ঘন ঘন নীল সাদা রঙে শহর রাঙ্গাতে গিয়ে মাসে মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা ধারের পাহাড় গড়ে তোলা ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী বিশেষ কিছু লাভ হচ্ছে কিনা তা তো সময় বলবে। যদিও সাময়িক লাভ হচ্ছে বইকি। সেখানেই পপুলিস্ট রাজনীতির মোক্ষলাভ।

অথচ নোটবাতিল করে নতুন নোট ছাপাতে যে খরচ, কিংবা শুধু সিঙ্গুরের প্রায় হয়ে যাওয়া কারখানাটা ভেঙ্গে ফেলতে যা খরচ, তা দিয়ে অনায়াসে দেশের অসংখ্য খেতে না পাওয়া মানুষের রোজগারের সংস্থান করা যেত, যায়।অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করে তোলা যায়। দেশের, রাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে ব্যাপকহারে যে বরাদ্দ ছাঁটাই চলছে তা হয়তো করতে হয় না। ক্ষুদ্র পাইয়ে দেবার রাজনীতি করতে গিয়ে কিছু অসহায় গরিব মানুষকে চিরস্থায়ী ডোল পলিটিক্সের দিকে ঠেলে দিতে হয়না। শীতের সময় কম্বল বিলি বা পুজোর সময় নতুন জামা কাপড় বিলি করতে করতে নিজেদের অজান্তেই বেশ কিছু মানুষের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে হয়না।

যার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম আবারও ‘তাঁর’ কথাতেই ফিরে আসি। রাশিয়ার চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল মানুষ থাকে, তাদের সংখ্যাই বেশি, তাঁরাই বাহন। তাদের মানুষ হবার সময় নেই। দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত।” রাজনীতিবিদদের উচ্ছিষ্টে কিছু মানুষকে লালন পালন করার যে প্রক্রিয়া ক্রমশ গেড়ে বসছে এবং নিজেদের চারপাশে সুপরিকল্পিত ভাবে যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে তাদের চিরকাল নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তো? নাকি সেদিন বেশি দূরে নেই, যেদিন তাঁরাই রাজার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে – তুই উলঙ্গ।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in