কেন্দ্রের 'পুশব্যাক' নীতির জেরে বাংলাদেশী সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে আটক বঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা!

People's Reporter: পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সভাপতি মহম্মদ রিপন জানিয়েছেন, "শুধু বীরভূমেরই চারশোর বেশি শ্রমিককে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখার খবর মিলেছে। এরকম যে আরও কত আছে তা বলা মুশকিল।"
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি - সংগৃহীত
Published on

আবারও বাংলায় কথা বলায় বাংলাদেশী সন্দেহে ভিন রাজ্যে হেনস্থার শিকার হতে হল পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের। কাজের জন্য ভিন রাজ্যে গিয়ে আটক বীরভূমের ৭ জন পরিযায়ী শ্রমিক। এছাড়া হুগলির এক শ্রমিককেও আটক করা হয়েছে।

বীরভূমের পাইকর থানার কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা লিপটন শেখ ও সাবিরউদ্দিন শেখ ওড়িশায় গিয়েছিলেন। পেশায় তাঁরা রাজমিস্ত্রি। রাজ্যে বহুদিন ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়েই ভিন রাজ্যে কাজের জন্য যেতে হয়েছে তাঁদের। সেখানে গিয়ে হেনস্থার শিকার হতে হল তাঁদের। বিভিন্ন সূত্র মারফত খবর নিয়ে জানা গিয়েছে, ওড়িশার গান্ধীচক এলাকা থেকে কামালপুরের এই দুই পরিযায়ী শ্রমিককে পুলিশ আটক করে প্রথমে থানা, তারপর এসডিও অফিস নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে ব্রজরাজনগর এসডিপিও অফিসের অধীনেই এক ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন তাঁরা।

এছাড়া মুরারই থানার কাহিনীনগর গ্রামের আরও ৫ জন নির্মাণ শ্রমিক নাজিমুদ্দিন সেখ, মুস্তাক দেখ, সেতাবুল দেখ, সানির সেখ ও আতাউল শেখকেও বাংলায় কথা বলায় বাংলাদেশী সন্দেহে আটক করেছে পুলিশ। তথ্য যাচাইয়ের জন্য বালেশ্বর থানার হাতে আটক হয়েছেন এই ৫ শ্রমিক। এর ফলে চরম উদ্বেগ ঘনিয়ে এসেছে এই শ্রমিকদের পরিবারে।

লিপটন শেখের স্ত্রী'র কথায়, "খবর পেলাম গত রাতে স্বামীকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। স্বামী বাংলা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। স্বামীকে নাকি বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করছে। কিন্তু আমাদের কাছে সব কাগজ আছে। খুব চিন্তা হচ্ছে।" সাবিরউদ্দিনের স্ত্রী জানিয়েছেন, "আমরা দু'তিন পুরুষ ধরে এখানেই আছি। সব কাগজ আছে, দলিল-পরচা সব আছে। তবুও কেন এমন করছে জানি না। স্বামী কী অবস্থায় আছে কোনও খবর পাচ্ছি না।"

অন্যদিকে, বাংলাদেশী সন্দেহে ওড়িশার ঝড়সুগদা জেলায় আটক হুগলি জেলার চুঁচুড়ার ২ নম্বর ব্লকের রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা দেবাশিস দাস। পরিবারের অভিযোগ, বাংলাদেশী সন্দেহে তাঁকে আটক করেছে পুলিশ। জানা গেছে, গত ১৪ জুন বেশ কয়েক জনের সঙ্গে ওড়িশায় কাজ করতে গিয়েছিলেন দেবাশিস। একটি সংস্থার হয়ে তাঁরা বিভিন্ন প্রজেক্টে ফায়ার সিস্টেমের কাজ করতেন। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ তাঁদেরকে কর্মস্থল থেকে অন্যত্র তুলে নিয়ে যায়। আটক করে চলে হেনস্থা। অভিযোগ, তথ্য যাচাইয়ের পরেও তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি বরং তাঁর কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেওয়া হয়।

ছেলের হেনস্থা প্রসঙ্গে মা বিভা দাস বলেন, ‘‘এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলার মানুষ বাইরে গিয়ে কোনও কাজই করতে পারবে না। এ ভাবে চলতে পারে না।’’ তাঁর প্রশ্ন, সব নথি থাকলেও কী করে এই হেনস্থা করা হয়?

অন্যদিকে, কেএন কাটজু মার্গ থানার রোহিনীতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতেন মুরারই-২ ব্লকের পাইকর গ্রামের বাসিন্দা দানিশ শেখ। তাঁর স্ত্রী সোনালী বিবি ও পাঁচ বছরের ছেলে সাবির শেখও তাঁর সাথে থাকতেন। কাগজ ও পুরাতন লোহা কুড়িয়ে রোজগার করতেন তাঁরা। অপরদিকে, মুরারই-১ ব্লকের ধিতোড়া গ্রামের সুইটি বিবি দুই সন্তান কুরবান শেখ ও ইমাম শেখকে নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু বাংলাদেশী সন্দেহে এদের আটক করে পুলিশ।

অভিযোগ, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পঞ্চায়েতের স্থায়ী বাসিন্দার শংসাপত্র ও বাড়ির দলিল দেখানোর পরেও ছাড় মেলেনি। গত ২২ জুন এক হেড কনস্টেবল তাঁদের গ্রেফতার করে। এরপর কিছু দিন ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী রাখার পর বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মাত্র দিনতিনেক আগে বীরভূমেরই লোহাপুর, পাইকরের আরও ১৯জন ফেরিওয়ালা ওডিশায় সাত রাত ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটানোর পর কোনোরকমে মুক্তি পেয়েছেন। শুধু বীরভূমই নয়, নদীয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরেও এমন নির্যাতনের খবর মিলেছে ইতিমধ্যেই।

এই ব্যাপারে পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সভাপতি মহম্মদ রিপন জানিয়েছেন, "ইতিমধ্যে শুধু বীরভূমেরই চারশোর বেশি শ্রমিককে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখার খবর মিলেছে। এরকম যে আরও কত আছে তা বলা মুশকিল। কারণ মোবাইল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সবাই তো যোগাযোগ করতে পারছে না। হেনস্থা করার জন্য অযথা তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তকমা সাঁটিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে"।

সিআইটিইউ বীরভূম জেলা সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর বক্তব্য, "এখানকার বাসিন্দারা রাজ্যে কোনও কাজ না পেয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলমান ও বাংলাভাষী হওয়ার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের 'বাংলাদেশী' তকমা দিয়ে তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও চরম হেনস্থা করা হচ্ছে। সব দেখেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চুপ"।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in