“এখন আর গ্রাম বাঙলার মাটিতে পা রাখার জায়গা মমতা ব্যানার্জির নেই। তৃণমূল তার পায়ের তলা থেকে মাটি হারিয়ে ফেলেছে। পঞ্চায়েতের ভোটে উনি হেরে যাচ্ছেন সেটা উনি মেনে নিয়েছেন। তৃণমূল বুঝে গেছে ভোট হলে মানুষ বিরুদ্ধে ভোট দেবে। তাই তৃণমূল ভোট চায়নি। শেষদিন পর্যন্ত তৃণমূল এবং বিজেপি চেষ্টা করেছে ভোটের যাতে দফারফা করে দেওয়া যায়। প্রতিদিন তৃণমূল বিজেপি ভাঙছে।” মঙ্গলবার কলকাতায় দলীয় রাজ্য দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম বলেন, আমরা বামপন্থীরা সবসময় মনে করি নির্বাচন একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম। মানুষ দুর্নীতির জঞ্জাল থেকে, দুষ্কৃতীর সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি চাইছে। মানুষের ন্যূনতম যে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার তার জন্য লড়ছে। এ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সাধারণ প্রশাসনের একটা অংশ এবং পুলিশের একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে পরিণত করছেন।
নির্বাচনে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক বলেন, নিরাপত্তা চায় মানুষ। অথচ দেখা যাচ্ছে বোমা গুলির কারখানা। প্রতিদিন বোমা ফেটে মারা যাচ্ছে মানুষ। কীসের যুদ্ধের প্রস্তুতি? এত উন্নয়নের জোয়ার। এত সব ভান্ডার। তাহলে কেন শাসকদল বিরোধীদের প্রার্থী হওয়া আটকাতে চাচ্ছে, জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে চাইছে? যদি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া থাকত আমাদের রাজ্যে তাহলে এরকম অসংখ্য কাহিনি বেরোতো। কীভাবে গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার হয়েছে এবং হচ্ছে। তা সত্ত্বেও লড়াই হচ্ছে। মানুষের এই জেদকে আমরা কুর্ণিশ জানাচ্ছি। গোটা রাজ্য জুড়ে গ্রামবাঙলায় মানুষের জেদ প্রতিদিন বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন চেয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করবে। আর তৃণমূলের কিছু মুখপাত্র বলবে প্রার্থীরা কেউ নেই তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছে। এখনও মিডিয়ার কেউ কেউ এরকম বলছে। স্পষ্ট করে জানাচ্ছি কোনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি। ফর্ম জমা দিতে দেওয়া হয়নি। আজ এখনও পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েতে অনলাইনে তৃণমূলের প্রার্থীদের কাগজপত্র আপলোড করা হয়নি। আসলে কাগজপত্র নেই। আর অন্যদিকে প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, মনোনয়ন পর্বে একটা যুদ্ধ, প্রত্যাহার পর্বে আর একটা যুদ্ধ। আর এখন প্রচার পর্বেও প্রতিদিন যুদ্ধ চলছে। কুচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত হাঙ্গামা, হামলা, হুমকি চলছে। আর যত হামলা হচ্ছে তত মানুষের তত জেদ বাড়ছে। আর পুলিশের একটা অংশ গিয়ে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আরা আক্রান্ত তাঁদের গ্রেপ্তার করছে। পাড়া ছাড়া করছে। আর যারা অপরাধী তাঁরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ।
নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যবহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে। গড়িমসি করছিল। দিল্লীর সরকারও। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ জাগাতে হবে। নির্বাচন কর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে। বুথে যাবার সময় রাস্তা আটকালে কে নিরাপত্তা দেবে? তৃণমূল বলছে ভোটের দিন খেলা হবে। কিন্তু ওঁদের কাছে খেলোয়াড় নেই। তাই ভোটের দিন এক্সট্রা পোশাক পরিয়ে কখনও সিভিককে, কখনও ডেলি ওয়েজের নাম করে ভলান্টিয়ার জোগাড় করে কাজ চালাবে। হাইকোর্ট যাদের বলে দিয়েছে নির্বাচন কর্মী করা যাবে না তাদেরকেও নির্বাচন কর্মী করা হচ্ছে।
এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, ভোটের দিন আমরা চাই সমস্ত মানুষ, প্রার্থী, ভোট কর্মী, পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তাঁরা তা পালন করুক। এখনও পর্যন্ত প্রাক পঞ্চায়েত পর্বে যে কটা মৃত্যু হয়েছে তার প্রত্যেকটার জন্য দায়ী রাজ্যের নির্বাচন কমিশন। কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে যাতে আর কোনও মৃত্যু না হয়।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন তিনি বলেন, এবার তৃণমূল বিজেপির হয়ে যাতে কেউ ভাড়া না খাটে তাই আমরা আগাম হুঁশিয়ারি দিচ্ছি। ২০১৮তে যেমন শহুরে গুন্ডা ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভোট লুঠের জন্য, শুভেন্দু অধিকারী সেটা মোবিলাইজ করেছিল। কিন্তু এবার গ্রামের মানুষের জেদ বুঝুন। মেজাজ বুঝুন। টেলিভিশন চ্যানেলে যা দেখাচ্ছে, কাগজে যা লিখছে সেটা বাস্তব নয়। বাস্তব হচ্ছে ভাড়ায় খাটার লোকজন যদি যায় তাহলে পরিণতি ভালো হবেনা। আর ভিন রাজ্য থেকে যাতে কেউ না আসে তাই নির্বাচন কমিশনকে ভোটের আগে থেকে সিল করতে হবে। ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট, ইন্টার স্টেট বর্ডার সিল করতে হবে।
স্পর্শকাতর বুথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এদিন সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক বলেন, নির্বাচন কমিশন এত স্পর্শকাতর হয়ে গেছে যে বুথের মধ্যে যে ভূতগুলো আছে সেগুলো দেখতে চাইছেন না। এখন তো মনে হচ্ছে বিজেপি আর তৃণমূলের যেখানে ভোট পাবার সম্ভাবনা আছে সেটাকে প্রোটেক্ট করবে আর বাকি জায়গায় গণ্ডগোল পাকিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে। বেশিরভাগ জায়গায় যেখানে বামপন্থীরা, কংগ্রেস, আইএসএফ ভালো জায়গায় আছে সেখানে সেখানে গণ্ডগোল করা হচ্ছে। ওইজন্য ৭ শতাংশ বুথকে স্পর্শকাতর বলা হয়েছে। অর্থাৎ ওখানেই তৃণমূল বিজেপির জেতার সম্ভাবনা আছে। আমরা আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় স্পর্শকাতর বুথের তালিকা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এজন্যই মানুষ শৃঙ্খল মুক্ত হতে চাইছে। যুদ্ধ নয়। ভোট যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গতবারের ভোটে সবথেকে বেশি ভোট লুঠ হয়েছিল গণনা কেন্দ্রে। বার করে দেওয়া হয়েছিল এজেন্টদের। প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে লুট করতে সাহায্য করেছে। এখানে এখন লুটেরাদের পাহারা দেবার জন্য পুলিশ আছে। প্রতিটা বুথে যাতে সিসিটিভি থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন হলেই আদালতে সেই ফুটেজ দেখাতে হবে। কাউন্টিং সেন্টারেও সিসিটিভি থাকতে হবে। কিন্তু আমরাও এবার নজরদারি রাখবো। মানুষের যা ইচ্ছা তার প্রতিফলন ঘটুক। গত কয়েকটা নির্বাচনে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে দেওয়া হয়নি।
মিডিয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, একদিকে বায়াসড মিডিয়া স্পনস্রড প্রোগ্রাম অনুযায়ী বিভাজনের রাজনীতির খেলা খেলছে। কেউ কেউ ভোট লুঠকে মান্যতা দেবার চেষ্টা করেছে। আর তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এখনও সেই চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মানুষের যে ঐতিহ্যপূর্ণ লড়াই, পঞ্চায়েতকে লুটেরাদের হাত থেকে মানুষের হাতে নিয়ে আসা, গ্রামসভা যাতে গুরুত্বপূর্ণ হয় তার জন্য মানুষ নিজের পঞ্চায়েত তৈরি করতে চাইছে। সেখানে সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম, সিভিল সোসাইটির সহায়তা লাগবে। মানুষ সজাগ সতর্ক থাকলে অনেককিছুই আটকানো যাবে।
তিনি বলেন, গোটা দেশের প্রচারমাধ্যম দেখলে মণিপুর যে ভারতের অংশ তা বোঝা যাবে না। এইজন্য মিডিয়ার স্বাধীনতা দরকার। যাতে বাস্তবে যা ঘটছে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে সংবাদমাধ্যম।
রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মিডিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষ কী বলছে সেটাই বড়ো কথা। যারা জেদ নিয়ে লুটেরাদের তাড়াতে চাইছেন তাঁরা কী বলছেন সেটাই এই মুহূর্তে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়াকে মানুষের কথা বলতে হবে। গোটা রাজ্যে যা ঘটছে তা রাজ্যপালের চোখ দিয়ে কেন দেখতে হবে? মিডিয়া কেন দেখতে পাবেনা? গণতন্ত্র কখনও ভায়া গভর্নর হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়না। যে মুহূর্তে গণতন্ত্র গভর্নর হাউসে ঢুকে যাবে সেই মুহূর্তে বুঝতে হবে গণতন্ত্রের সমাধি হয়েছে। সবথেকে বড়ো নমিনেটেডের পক্ষে ইলেকটেডের পোষ্ট বোঝা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে না পারলে মানুষের ঐক্যকে বাঁচানো যাবে না। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। রাজ্যের পুনরুজ্জীবন নির্ভর করছে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ওপর। কোনও ৫৬ নয়, কোনও রাজ্যপাল নয়, কোনও রাজভবন নয়, কোনো ৩৫৬ নয়। বাঙলার গণতন্ত্র, বাঙলার মানুষের ঐক্য, বাঙলার মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আসন্ন নির্বাচনে সিপিআইএম-এর হেল্প লাইন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন তিনি বলেন, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পাহারায় পাবলিক চালু করছি। এখানে রাজ্যের সমস্ত সাধারণ মানুষ, নির্বাচন কর্মী তাঁদের সমস্ত অভিযোগ জানাতে পারবেন। আজ থেকে এটা শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলে এটা সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এটা শুধু বামপন্থীদের জন্য নয়, রাজ্যের সমস্ত সাধারণ মানুষের জন্য। এটা একটা পিপলস রেজিস্টেন্স। বাঙলায় কী ঘটছে তা রাজ্যের মানুষকে জানানোর জন্য, দেশের মানুষকে জানানোর জন্য এই নজরদারি চলবে।
তিনি আরও বলেন, পঞ্চায়েতে ঘুঘুর বাসা তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতির যোগ হয়েছে। দুর্জন এবং মহাজনদের জোট হয়েছে। এই টাকার একটা ভাগ পুলিশ এবং প্রশাসনের একটা অংশ নিয়মিত পায়। ফলে তাঁদের মধ্যেও একটা একপেশে ভূমিকা দেখা যায়। কোথাও কোথাও মিডিয়ার একাংশও এই ভাগ পায়। তাই সেখানেও একপেশে রিপোর্ট দেখা যায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, কৃষিজীবী মানুষ তার ফসলের দাম পাচ্ছে না। অন্যদিকে আদা, কাঁচালঙ্কা, সমস্ত সবজি, মশলার দাম মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ কেন্দ্র রাজ্য কেউ কিছু বলছে না। এই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন জিএসটি বসলে সব জিনিসের দাম কমে যাবে। মমতা ব্যানার্জি তো কিষাণ মান্ডি করেছিলেন। কোথায় গেল সেই কিষাণ মান্ডি। এখন মানুষের আয় কমছে আর ব্যয় বাড়ছে। এটাই ধান্দা পুঁজির ফল।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন