
২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ ২৬ হাজার জনেরই (আদতে ২৫ হাজার ৭৫২ জন) চাকরি গেল। ব্যতিক্রম শুধু একজন – ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষিকা সোমা দাস।
প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছে, ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াতেই কারচুপি করা হয়েছে। ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট আরও জানিয়েছে, যাঁরা অন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালের এসএসসির মাধ্যমে স্কুলের চাকরিতে যোগদান করেছিলেন, তাঁরা চাইলে পুরনো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারবেন। তিনমাসের মধ্যে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজ্য সরকারকে শুরু করতে হবে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই দুর্নীতির ইতিহাসঃ
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসিতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই বছর ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দুবছর পর ২০১৮ সালে ১২ মার্চ প্রকাশিত হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ আগষ্ট প্রকাশিত হয় প্রার্থীদের মেধাতালিকা। এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতরা।
২০১৬ সালে প্যানেলে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাইকোর্টে এই নিয়ে মামলা দায়ের হয় একাধিক। গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর এই মামলায় সিবিআইকে তদন্তভার দেয় তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তারপরে দু’বছরে প্রায় ১০ টি মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিবিআইকে। পাশাপাশি, বেআইনি নিয়োগ বাতিল করার নির্দেশও দেন বিচারপতি।
যদিও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গেল বেঞ্চের কিছু রায় স্থগিত করে দেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি হরিশ টন্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। পরে সিঙ্গেল বেঞ্চের কিছু রায় বহাল রাখেন কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ। এরপরে সেই সমস্ত নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু এবং বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করবেন। সেখানেই এসএসসির নিয়োগ দুর্নীতির যাবতীয় মামলার শুনানি হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বিশেষ বেঞ্চ এই মামলার শুনানি শুরু করে। সেই বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে মোট ১৭ টি শুনানি হয়। এরপর ওই বছর ২২ এপ্রিল ২৮২ পাতার রায় ঘোষণা করে বিশেষ বেঞ্চ। সেই রায়ে ২০১৬ সালের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, চাকরি হারা হন ২৫,৭৫২ জন। ব্যতিক্রম কেবল ক্যান্সার আক্রান্ত সোমা দাস।
পাশাপাশি, সমস্ত ওএমআর শিট স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যাঁরা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের বেতন ১২ শতাংশ সুদ-সমেত ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, কারণ ওই টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই মামলায় সিবিআইকে আরও তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে নিম্ন আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
হাইকোর্টের এই রায়ের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে রাজ্য। ২৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। পৃথক ভাবে শীর্ষ আদালতে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। দফায় দফায় মামলা করেন চাকরিহারারাও। ওই বছর ৭ মে হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। তবে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে সিবিআইকে বেআইনি ভাবে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।
ওই বছর ১৬ জুলাই শীর্ষ আদালত জানায়, এই মামলার পাঁচটি পক্ষ - পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, হাই কোর্টের মূল মামলাকারীরা, হাই কোর্টের নির্দেশে যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে তাঁদের এবং সিবিআই-এর বক্তব্য শুনবে আদালত। মোট ২০ বার শুনানি হয়েছে এই মামলার। ৪০০ আইনজীবী এই মামলায় অংশ নেন।
অবশেষে ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই মামলার শুনানি শেষ হয় বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। রায় দান স্থগিত রেখেছিলেন। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে পুরো প্যানেলই বাতিল করল শীর্ষ আদালত।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন